ঢাকা ০৬:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
ছাতকে ইউএনও ওসি’র সাথে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের সৌজন্য সাক্ষাৎ সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে আড়াই কোটি টাকার ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ জগন্নাথপুর উপজেলা উন্নয়ন সংস্থা ইউকে’র উদ্যোগে সেলাই মেশিন বিতরণ উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড বিএনপির কমিটি গঠন -সভাপতি তারা মিয়া, সম্পাদক ফজলুল হক ধর্মপাশায় কনে দেখতে গিয়ে নৌকাডুবি, উকিল ও শিশু কন্যার লাশ উদ্ধার দুর্নীতি ও অপশাসনের কারণে দেশ পিছিয়ে আছে — এডভোকেট মুহাম্মদ শামস উদ্দিন সিলেটের পাথর কুয়ারী লুটপাটে জামায়াত জড়িত নয়: প্রমাণের চ্যালেঞ্জ নেতৃবৃন্দের ছাতকে বিদেশি রিভলভার উদ্ধার সিলেটের নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন মো. সারোয়ার আলম তাহিরপুরে ডা. মির্জা রিয়াদ হাসানের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

ছোট গল্প # অর্জুন #ডা. এম. নূরুল ইসলাম

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:৫৫:২৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ মার্চ ২০২২
  • / 301
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ছোট গল্প #অর্জুন

–ডা. এম. নূরুল ইসলাম

ভারী ফ্রেমের পাওয়ারফুল চশমাটি সুতোর সাহায্যে বুকে ঝুলানো আছে। কাঁধভর্তি শাদা চুল। লম্বা দাঁড়িতে মেহেদী লাগানো কারনে শাদা-হলুদে্র দাঁড়িতে একটা স্বর্গীয় শোভা কাজ করছে। পোড়া বেতের লাঠিতে ভর করে প্রতিদিনকার মতো নিজেরর মজা পুকুরের ইয়া বড় অর্জুন গাছটির নিচে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ। নাম রমিজ উদ্দিন। বয়স ৭৫এর কাছাকাছি হবে হয়তো।

সুতোয় বাঁধা বুকে ঝুলানো চশমাটি চোখে লাগালেন রমিজ উদ্দিন। চারিদিক ফরসা হতে শুরু করছে। পাখিদের কিচির-মিচিরে ভোরের নিশ্তব্ধতা কেটে যাচ্ছে। শহরতলীর সুরমা নদীর পাড় ঘেসেই তার গ্রাম। নাম কুতুবপুর। বসন্তের আগমনে শীতের বিদায় হলেও সুরমার শীতল বায়ুতে ভোরের দিকে একটা শীতের আবেশ কাজ করে। বড়ই আরামদায়ক সেই আবেশ। পাঞ্জাবীর উপর ধবধবে শাদা চাদরটা মুড়িয়েই তিনি পুকুরপাড়ে এসেছেন।

প্রতি শুক্রবারকে কেন্দ্র করে তিনি ইবাদত-বন্দেগী একটু বেশি করার চেষ্টা করেন। ফজরের আজানের আগে তাহাজ্জুদ পড়েন, দোয়া-দুরুদ পাঠ করেন। নিজের ও পরিবারের গুনাহ মাপের জন্য পরদেগারের কাছে কান্না-কাটি করেন। এরপর ফজরের নামাজ শেষ করে পবিত্র কোরান পাঠ করেন। গতো তিনমাস ধরে তিনি কোরানের বাংলা অর্থসহ অল্প অল্প পড়ার চেষ্টা করছেন।

তার প্রায় সময় খুবই আফসোস হয়, কেনো তিনি অনেক আগ থেকেই অর্থসহ কোরান পড়তে শুরু করেননি।

বিশাল অর্জুন গাছটির উপরের দিকে তাকাতেই রমিজ উদ্দিনের মন খুব ভালো হয়ে গেলো। অগণিত পাখিরা বিশাল গাছটির বিভিন্ন ডালে বসে ভোরের গান গাইছে। বসন্তের আগমনের কারনে নতুন নতুন পাতায় যেনো পরিপূর্ণ যৌবন ফিরে পেয়েছে গাছটিতে। ঘন ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে বিস্তৃর্ণ ভোরের অপরুপ নীলাভ আকাশ দেখা যাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি প্রতিটা বস্তুই না কতো সুন্দর। সদ্য পাঠ করে আসা কোরান মাজিদের সূরা আর রাহমানের একটি আয়াত রমিজ উদ্দিন বিড়বিড় করে পাঠ করে যাচ্ছেন-

“ফাবিআইয়্যি আ-লা-য়ি রব্বিকুমা-তুকায্যিবা-ন্।”
-“অতএব, হে মানুষ ও জীনজাতি, রবের কোন নিআমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে ?”

কুতুবপুরের তার বাড়িতে এই অর্জুন গাছটি নিয়ে রমিজ উদ্দিনের একটি বিরাট গর্ব কাজ করে। অনেকে বলে থাকেন, কুতুবপুর গ্রামের অক্সিজেন তৈরির সবচেয়ে উঁচু বুক্ষটিই নাকি তার বাড়ির অর্জুন গাছটি!

গাছটি নিয়ে রমিজ উদ্দিন অন্য একটি বিশেষ কারনেও গর্ব ও প্রশান্তি লাভ করেন। কারন অর্জুনের ছাল হাঁপানি, আমাশয়, ঋতুস্রাবজনিত সমস্যা, ব্যথা, প্রদর ইত্যাদি চিকিৎসায়ও উপকারী। ফলে গাছটি রোপন করার পর থেকে আজ অবধি কতো মানুষ যে, গাছটির ছাল রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করেছে, তার ইয়ত্বা নাই।

গাছটি রমিজ উদ্দিন রোপন করেছিলেন ১৯৭২ সালে। তখন তিনি টগবগে যুবক। তার বউ পোয়াতি। প্রথম বাচ্চা পৃথিবীতে আসতেছে। তার যেনো আর তর সইছিলো না। একদিন রাতে বউয়ের প্রশব ব্যাথা উঠে। সারারাত প্রশব ব্য্যথায় বউ গোঙ্গড়াতে থাকে। বাচ্চা খালাস করতে আসা সবার কপালে চিন্তার ভাজ পরে। হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেয় কেউ কেউ। রমিজ উদ্দিন সারারাত নির্ঘুম থেকে ছটপট করতে থাকে। সকাল হলেই নদী পার করে সদরের হাসপাতালে নিয়ে যাবে। সুরমার ঘাটে একটি খেয়া নৌকা রেডি করতে ভোর হওয়ার আগেই নদীর পাড়ে যায় রমিজ উদ্দিন। নৌকা রেডি করে বাড়িতে পৌঁছতেই বাড়িতে তার বাবার বেসুরা কন্ঠে আজানের শব্দ শুনতে পায় রমিজ! তার মানে কি? তার কি ছেলে হয়েছে?

কুতুবপুরে রমিজের সংসারে ভোরের আলো ফোটার আগেই জগত আলোকিত করে জন্ম নিলো তার প্রথম সন্তান।

প্রথম সন্তানের মুখ দেখে খুশিতে আত্মহারা রমিজ উদ্দিন। বাড়িতে আগত লোকজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য তিনি তড়িগড়ি করে সুরমার ঘাটে পূর্বের প্রস্তুত রাখা নৌকা করেই রওয়ানা হলেন সুনামগঞ্জ টাউনে। মিষ্টি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে তিনি রওয়ানা হলেন বাড়ির পানে। পথিমধ্যে গাছের চারা বিক্রেতার কাছ থেকে আট আনা পয়সা খরচ করে কিনলেন একটি ঔষুধী গাছের চারা। চারাওয়ালা বলে দিয়েছিলেন, এটা নাকি অর্জুন গাছের চারা।

ছেলের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাড়ির সদ্য কাটা পুকুড় পাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে অনেক যত্ম করে রোপন করলেন সেই চারা। সেই চারা যুগের পর যুগ অতিক্রম করে আজকের এই মহীরুহ বৃক্ষে পরিনতো হয়েছে। ছেলে মতিউর রহমানের বয়স এখন ৫০ বছর। গাছটির বয়সও ৫০ বছর!

কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে গাছটিকে ঘিরে। ভাঙ্গা-গড়ার সংসারের এই ৫০ বছরে হালখাতায় কতো হিসাব-নিকাশ। বাবা-মাসহ কতো আপনজনের প্রয়াণ আবার নতুন করে জন্ম নেওয়া ছেলে-মেয়ে ধরাধামে আসা, তাদের ঘরে আবার নতুন তৃতীয় প্রজন্মের নাতী-নাতনীদের আগমন! মজার ব্যাপার হচ্ছে এই কিছুদিন আগে সংসারে তার চতুর্থ প্রজন্মের একজনের আগমন ঘটেছে। সব প্রজন্মের কাছেই রমিজ উদ্দিনের মতো ৫০ বছরের অর্জুন গাছটিও এক অগ্নি সাক্ষি হিসাবে বেঁচে আছে।

চারিদিক ক্রমশ ফর্সা হয়ে গেছে। রমিজ উদ্দিন লাঠির সাহায্যে পায়চারি করতে করতে নিজের ঘরে এসে বললেন- ‘মতির মা, এক গেলাস পানি দাওতো।’

মতিউর জন্ম নেওয়ার পর বউকে তিনি ‘মতির মা’ বলে ডাকেন। বউয়ের ভালো নাম হলো গুলেছার নেছা।

গুলেছার নেছা পানি হাতে স্বামীকে বললেন-‘আইজ নাকি গাছ কাটার লাগি লোকজন আইবো?’
কথাটা শোনামাত্র রমিজ উদ্দিনের ভেতরটা ধক করে উঠলো। তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন তার প্রিয় অর্জুন গাছটি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আজ সেই গাছ কেটে ফেলা হবে!

সত্যি বলতে কি গাছটি বিক্রি করার কোন উদ্দেশ্যই ছিলো না। তার পুরানো ঘরটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে অনেক আগেই। একটি নতুন ঘর বানানো জরুরী হয়ে উঠেছিলো। দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলের ঘরে নাতী-নাতনী হয়েছে। একমাত্র ছোট ছেলে অবিবাহিত। পড়াশোনা শেষ করে চাকুরীর সন্ধানে আছে। জীবীত থাকতেই তিনি ছোট ছেলের বউ ঘরে আনতে চান। মেয়েরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান-পার্বনে নাতী-নাতনীদের নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসলে, কাউকেই ভালো করে থাকতে দিতে পারেন না। তার মনে যে তখন কি কষ্ট কাজ করে, সে কথা গুলেছার নেছা ছাড়া হয়তো কেউই ভালোভাবে জানে না।

অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না রমিজ উদ্দিনের। নিজের বেশ কিছু কৃষি জমির ফল-ফসলাদি এবং বড় ছেলে মতিউর রহমানের ছোট্ট চাকুরীর অর্থেই তার সংসার চলে। তিনি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। জমিতে আগের মতো আর কাজও করতে পারেন না। সীমীত আয়ের সংসারে নতুন ঘর বানানো যে কতো বড় কষ্টসাধ্য ব্যাপার তিনি হারে হারে টের পাচ্ছেন।

পারিবারিকভাবে রমিজ উদ্দিনের বাড়ি থেকে তিনটি গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। পুরাতন ঘরের পেছনের বানরলাঠি ও কাঁঠালের গাছদ্বয়ের কাঠ ব্যবহৃত হবে নতুন ঘরের দরজা-চৌকাঠ তৈরির কাজে এবং পুকুরপাড়ের অর্জুন গাছটির বিক্রির টাকা দিয়ে মেঠানো হবে নতুন ঘরের অন্যান্য সামগ্রী কেনার কিছু খরচপাতি।

পারিবারিক সভায় রমিজ উদ্দিন অর্জুন গাছটি না কাটার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করেছেন। কিন্তু তার অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি। কারন বৃহত অর্জুন গাছটির বাজারমূল্য অনেক এবং কাঠক্রেতাদের কাছে অর্জুন কাঠের কদর বেশি।

কুতুবপুরের অক্সিজেন তৈরির বড় গাছ হিসাবে এক বৃদ্ধের গর্বেভরা বুক, অপ্রকাশিত আবেগ, হাজারো সুখ দুঃখের স্মৃতির চেয়ে নগদ অর্থের কদর যে অনেক বেশি মূল্যবান, পারিবারিক সভায় রমিজ উদ্দিন হারে হারে টের পেলেন। সেদিন থেকেই তিনি খুব ভোরে ধর্ম-কর্ম শেষে গাছটির নিচে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। অন্তর ও বাহিরের চোখ দিয়ে গাছটির ডাল,পালা, পাতা, পাখিদের বাসা, পাতার উপরের আকাশ, আকাশের উপরে গাছটিকে কেন্দ্র করে নানান রকম স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে থাকেন।

গাছ দেখার জন্য বিভিন্ন কাঠক্রেতারা রমিজ উদ্দিনের বাড়িতে আসতে শুরু করলো। বিভিন্ন রকম দরদাম হচ্ছে অর্জুন গাছটির। গাছের দরদামের সময় তিনি পারতপক্ষে কাছাকাছি না থাকার চেষ্টা করেন। একদিন বড় ছেলে মতিউর অনেক দর কষাকষি শেষে রমিজ উদ্দিনের পঞ্চাশ বছরের পুরানো অর্জুন গাছটি পঞ্চান্ন হাজার টাকায় বিক্রি করে দিলেন!

গুলেছার নেছার প্রশ্নে স্ত্রীর দিকে বড় চোখ করে তাকালেন রমিজ উদ্দিন। কাঁপা হাতে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে বললেন-‘ আসুক, গাছ কাটার লোক! আমার কি? আমারে জিগাও কেনো?’ ফোপাতে ফোপাতে তিনি বেতের লাঠিটায় ধরে ধপাশ করে ঘরের চৌকিটায় মাথা নিচু করে বসে পড়লেন। স্ত্রী বললো-‘আপনার কি শইল খারাপ করছে? ‘
-‘না, আমার শইল খারাপ না! তুমি তোমার কাজে যাও।’ রাগত মেজাজে রমিজ উদ্দিন স্ত্রীকে শোবার ঘর থেকে বিদায় দিলেন। তার শরীর সত্যি খারাপ লাগতেছে। তিনি চৌখির উপর শুয়ে পড়লেন।

সকাল প্রায় দশটার দিকে গাছক্রেতা তার কাছকাটার দলবল নিয়ে রমিজ উদ্দিনের বাড়িতে হাজির হলো। ইলেকট্রিকের করাত, কুঠার, বড় বড় রশি, কতো কি?

কুতুবপুরের সবচেয়ে বড় গাছটি কাটার দৃশ্য দেখার জন্য বাড়িতে আশেপাশের অনেক লোকজন হাজির হলো। কাটুক তারা গাছ! রমিজ উদ্দিন আজ ঘর থেকে বের হবেন না বলে মনোস্থির করলেন।

গাছ কাটার তোড়জোড় প্রায় শেষ। এক্ষুণি ইলেকট্রিকের করাত চালু করা হবে। সবাই গাছের মালিক রমিজ উদ্দিনকে খোঁজ করছে। গুলেছার নেছা স্বামীকে ডাকতে গেলেন। অনেক অনুনয়-বিনয় করে স্বামীকে গাছ কাটার অনুমতির জন্য সেখানে নেওয়া হলো।

কাঁপা কাঁপা শরীরে অর্জুন গাছটির অদূরেই দাঁড়ালেন রমিজ উদ্দিন। তিনি অনুমতি দিলেন বটে! করাত চলতে শুরু করছে। করাতের শব্দে গাছের পাখ-পাখালিরা চিৎকার চেঁচামেচি করে উড়ে যাচ্ছে। দুটি বুলবুলি পাখি অর্জুন গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে ডানা ঝাঁপটিয়ে অদ্ভূত এক শব্দে জানান দিচ্ছে, তাদের বাসায় সদ্যফোটা বাবুদের নিয়ে যাওয়ার কোন জায়গা নেই! রমিজ উদ্দিন তার প্রথম সন্তানটি পৃথিবীতে আসার রাতে ফিরে গেলেন! তিনি আর কিছুই সহ্য করতে পারছেন না!

রমিজ উদ্দিনের হাতের লাঠি ঠকঠক করে কেঁপে উঠছে।

গাছতো সবেমাত্র কাটা শুরু হয়েছে। তার এতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কেনো? এর আগেতো তার শ্বাসকষ্টের কোন রোগ ছিলো না! তবে কি অর্জুন গাছটি কুতুবপুরে অক্সিজেন তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে!

লাঠিটি হাতছাড়া হলো রমিজ উদ্দিনের! ধপাশ করে মাটিতে পড়ে গেলেন! গুলেছার নেছার গগনবিদারী চিৎকারে সবাই রমিজ উদ্দিনের কাছে ছুটে চললো। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। একজন ছুটলো ভ্যানগাড়ি জাতীয় কিছু একটা আনার জন্য। প্রায় অবচেতন রমিজ উদ্দিনকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ভ্যানে তোলা হলো।

গাছ কাটতে আসা লোকজন হতবম্ব। কিছুক্ষণের জন্য তারা কাজ বন্ধ রেখেছে। তারা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। গুলেছার নেছা কাঁদতে কাঁদতে ভ্যানে উঠার সময় গাছক্রেতাকে বললো-‘মতির বাপ সুস্থ্য অইয়া বাইত না আওয়ার গাছ থিক্কা একটা পাতাও ছিড়ুইন্না আফনেরা।’

হাসপাতালে শুয়ে আছেন রমিজ উদ্দিন। তাকে অক্সিজেন লাগানো হয়েছে। পালস, ব্লাড প্রেসার, ফুসফুস, হার্ট সব ঠিক আছে। আবাসিক চিকিৎসক ডা. আনিসুল হকের তত্বাবধায়নে তার চিকিৎসা চলছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার রোগ ধরা হলো ‘সিনকোপাল এ্যাটাক’। বড় কোন সমস্যা না। রেস্ট নিলে দ্রুতই সেরে উঠবেন রমিজ উদ্দিন।

একদিন পরেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলো রমিজ উদ্দিনের স্বাস্থ্য। ডা. আনিসুল হক তার বড় ছেলে ও স্ত্রীর কাছ থেকে সবিস্তারে সব জানলেন। রমিজ উদ্দিনের সাথেও তাঁর একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হলো রমিজ উদ্দিনকে।

সুরমার কূলঘেঁষে শহরতলীর অদূরেই অসাধারন একটি গ্রাম কুতুবপুর। অক্সিজেন তৈরির একটি গাছ কিনেছেন ডা. আনিসুল হক, মূল্য পঞ্চান্ন হাজার টাকা। গাছের মালিক রমিজ উদ্দিন, বিক্রেতা রমিজ উদ্দিনের বড় ছেলে মতিউর রহমান!

বাড়িটি খুঁজে পেতে মোটেও সমস্যা হয়নি ডা. আনিসুলের। কুতুবপুরের সবচেয়ে বড় বৃক্ষের বাড়িতেই এক সকালে ঢুকে পড়লেন তিনি। পুরো বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখলেন তিনি। পুরাতন একটি ঘরের পাশেই নতুন একটি ঘর বানানো হচ্ছে।

অর্জুন গাছটির ঠিক নিচেই দাঁড়ালেন ডাক্তার সাহেব। গাছের গুড়িতে অল্প একটু সদ্য কাটার দাগ! গুলেছার নেছা বড় গোমটা পড়ে ছুটে এসে বললেন-‘ডাক্তর সাব না? আফনি এইহানে?’ তার যেনো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তড়িগড়ি করে তিনি ছুটলেন মতির বাপের খুঁজে।

প্রকান্ড এক অর্জুন গাছের নিচে আনিসুল হক রমিজ উদ্দিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়ির বউ-ঝিয়েরা অদূরেই দাঁড়িয়ে আছেন উৎসুক চোখ নিয়ে।

রমিজ উদ্দিন কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ডাক্তার সাহেবকে ঘরে নিয়ে বসানোর জন্য তিনি তোড়জোড় শুরু করলেন।

-‘এখানেই ভালো লাগছে চাচা। আপনার শরীরের কি অবস্থা এখন?’
-‘খুব ভালা আছি, স্যার। আর কোনু সমস্যা হয় নাই। বয়স অইছেতো, স্যার। স্যার ঘরে গিয়া বন।’
-‘না চাচা, ঘরে যাবো না।’
অনেকটা ইতস্তত করে রমিজ উদ্দিন বলেন-
-‘ছেলে কইলো আফনি নাকি টাকা দিয়া গাছ কিনা নিছেন? যার কাছে গাছটা বেচ্ছিলাম, হেরে গতোকাইল সহালে টাকা ফিরত দিয়া আইছে মতিউর। ‘
-”হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। একটা গাছের দরকার ছিলো আমার।’
-‘ভালা করছেন, স্যার। এই গাছের কাঠ খুবই ভালা অইবো। কি বানাইবেন’ স্যার।’
-‘কিছু একটা করবো, দেখি।’
-‘ গাছ কবে কাটবেন?’

বৃদ্ধের প্রশ্নে কিছুক্ষণ নিরব থাকে আনিসুল হক। এই সসময় অর্জুন গাছটির উঁচু ডালে একটি ঈগল পাখি ডানা ঝাঁপটিয়ে বসে পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আনিসুল হক বলেন-
‘আপাতত গাছটি কাটার দরকার নাই আমার। কিনে রাখলাম, পাঁচ-দশ বছর থাকুক আপনার তত্বাবধায়নে। ভবিষ্যতে গাছ কাটার প্রয়োজন হলে আমি জানাবো, চাচা। এর আগ পর্যন্ত গাছের মালিক আপনিই। আপনিই গাছটিকে দেখেশুণে রাখবেন।’

ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে ছানাবড়া হয়ে উঠলো রমিজ উদ্দিনের চোখ। নিজের কানকে তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন। তার মানে? তিনি প্রকান্ড অর্জুন গাছটির উপরের দিকে তাকালেন। গাছের ডালে ডালে পাখিরা বসে আছে আছে, বসন্তের আগমনে সদ্য জন্ম নেওয়া সবুজ কচিপাতাদের ফাঁকে ফাঁকে অপূর্ব নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। রমিজ উদ্দিন মনে মনে কোরান মাজিদের আর রহমানের একটি আয়াত মনে করার চেষ্টা করছেন।

“ফাবিআইয়্যি আ-লা-য়ি রব্বিকুমা-তুকায্যিবা-ন্।”
-“অতএব, হে মানুষ ও জীনজাতি রবের কোন নিআমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে ?”

-‘দেইক্কা রাকমু স্যার, অবশ্যই দেইক্কা রাকমু। মরনের আগ পর্যন্ত দেইক্কা রাকমু।’

সুরমার শীতল বাতাস কুতুবপুরের গ্রামকে প্রশান্ত করে ডা. আনিসুল হকের গায় স্পর্শ করে যাচ্ছে ক্রমাগত। অর্জুন গাছের উঁচু ডালে বসা ঈগল পাখিটি হঠাৎ গাছটির ডাল-পালা কাঁপিয়ে শূণ্যে উড়াল দিয়েছে। কুতুবপুরবাসীর মতো বুকভরে অক্সিজেন বুকে টেনে নিজ গন্তব্যে ফিরে চলেছেন আনিসুল হক।

আনিসুল হকের পায়ের গতির কারনে ঝাঁপসা থেকে ঝাঁপসাতর হচ্ছে কুতুবপুর গ্রাম। এক বাড়িতে অস্পষ্ট একটি বড় বৃক্ষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

ছোট গল্প # অর্জুন #ডা. এম. নূরুল ইসলাম

আপডেট সময় : ০৮:৫৫:২৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ মার্চ ২০২২

ছোট গল্প #অর্জুন

–ডা. এম. নূরুল ইসলাম

ভারী ফ্রেমের পাওয়ারফুল চশমাটি সুতোর সাহায্যে বুকে ঝুলানো আছে। কাঁধভর্তি শাদা চুল। লম্বা দাঁড়িতে মেহেদী লাগানো কারনে শাদা-হলুদে্র দাঁড়িতে একটা স্বর্গীয় শোভা কাজ করছে। পোড়া বেতের লাঠিতে ভর করে প্রতিদিনকার মতো নিজেরর মজা পুকুরের ইয়া বড় অর্জুন গাছটির নিচে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ। নাম রমিজ উদ্দিন। বয়স ৭৫এর কাছাকাছি হবে হয়তো।

সুতোয় বাঁধা বুকে ঝুলানো চশমাটি চোখে লাগালেন রমিজ উদ্দিন। চারিদিক ফরসা হতে শুরু করছে। পাখিদের কিচির-মিচিরে ভোরের নিশ্তব্ধতা কেটে যাচ্ছে। শহরতলীর সুরমা নদীর পাড় ঘেসেই তার গ্রাম। নাম কুতুবপুর। বসন্তের আগমনে শীতের বিদায় হলেও সুরমার শীতল বায়ুতে ভোরের দিকে একটা শীতের আবেশ কাজ করে। বড়ই আরামদায়ক সেই আবেশ। পাঞ্জাবীর উপর ধবধবে শাদা চাদরটা মুড়িয়েই তিনি পুকুরপাড়ে এসেছেন।

প্রতি শুক্রবারকে কেন্দ্র করে তিনি ইবাদত-বন্দেগী একটু বেশি করার চেষ্টা করেন। ফজরের আজানের আগে তাহাজ্জুদ পড়েন, দোয়া-দুরুদ পাঠ করেন। নিজের ও পরিবারের গুনাহ মাপের জন্য পরদেগারের কাছে কান্না-কাটি করেন। এরপর ফজরের নামাজ শেষ করে পবিত্র কোরান পাঠ করেন। গতো তিনমাস ধরে তিনি কোরানের বাংলা অর্থসহ অল্প অল্প পড়ার চেষ্টা করছেন।

তার প্রায় সময় খুবই আফসোস হয়, কেনো তিনি অনেক আগ থেকেই অর্থসহ কোরান পড়তে শুরু করেননি।

বিশাল অর্জুন গাছটির উপরের দিকে তাকাতেই রমিজ উদ্দিনের মন খুব ভালো হয়ে গেলো। অগণিত পাখিরা বিশাল গাছটির বিভিন্ন ডালে বসে ভোরের গান গাইছে। বসন্তের আগমনের কারনে নতুন নতুন পাতায় যেনো পরিপূর্ণ যৌবন ফিরে পেয়েছে গাছটিতে। ঘন ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে বিস্তৃর্ণ ভোরের অপরুপ নীলাভ আকাশ দেখা যাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি প্রতিটা বস্তুই না কতো সুন্দর। সদ্য পাঠ করে আসা কোরান মাজিদের সূরা আর রাহমানের একটি আয়াত রমিজ উদ্দিন বিড়বিড় করে পাঠ করে যাচ্ছেন-

“ফাবিআইয়্যি আ-লা-য়ি রব্বিকুমা-তুকায্যিবা-ন্।”
-“অতএব, হে মানুষ ও জীনজাতি, রবের কোন নিআমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে ?”

কুতুবপুরের তার বাড়িতে এই অর্জুন গাছটি নিয়ে রমিজ উদ্দিনের একটি বিরাট গর্ব কাজ করে। অনেকে বলে থাকেন, কুতুবপুর গ্রামের অক্সিজেন তৈরির সবচেয়ে উঁচু বুক্ষটিই নাকি তার বাড়ির অর্জুন গাছটি!

গাছটি নিয়ে রমিজ উদ্দিন অন্য একটি বিশেষ কারনেও গর্ব ও প্রশান্তি লাভ করেন। কারন অর্জুনের ছাল হাঁপানি, আমাশয়, ঋতুস্রাবজনিত সমস্যা, ব্যথা, প্রদর ইত্যাদি চিকিৎসায়ও উপকারী। ফলে গাছটি রোপন করার পর থেকে আজ অবধি কতো মানুষ যে, গাছটির ছাল রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করেছে, তার ইয়ত্বা নাই।

গাছটি রমিজ উদ্দিন রোপন করেছিলেন ১৯৭২ সালে। তখন তিনি টগবগে যুবক। তার বউ পোয়াতি। প্রথম বাচ্চা পৃথিবীতে আসতেছে। তার যেনো আর তর সইছিলো না। একদিন রাতে বউয়ের প্রশব ব্যাথা উঠে। সারারাত প্রশব ব্য্যথায় বউ গোঙ্গড়াতে থাকে। বাচ্চা খালাস করতে আসা সবার কপালে চিন্তার ভাজ পরে। হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেয় কেউ কেউ। রমিজ উদ্দিন সারারাত নির্ঘুম থেকে ছটপট করতে থাকে। সকাল হলেই নদী পার করে সদরের হাসপাতালে নিয়ে যাবে। সুরমার ঘাটে একটি খেয়া নৌকা রেডি করতে ভোর হওয়ার আগেই নদীর পাড়ে যায় রমিজ উদ্দিন। নৌকা রেডি করে বাড়িতে পৌঁছতেই বাড়িতে তার বাবার বেসুরা কন্ঠে আজানের শব্দ শুনতে পায় রমিজ! তার মানে কি? তার কি ছেলে হয়েছে?

কুতুবপুরে রমিজের সংসারে ভোরের আলো ফোটার আগেই জগত আলোকিত করে জন্ম নিলো তার প্রথম সন্তান।

প্রথম সন্তানের মুখ দেখে খুশিতে আত্মহারা রমিজ উদ্দিন। বাড়িতে আগত লোকজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে মিষ্টিমুখ করানোর জন্য তিনি তড়িগড়ি করে সুরমার ঘাটে পূর্বের প্রস্তুত রাখা নৌকা করেই রওয়ানা হলেন সুনামগঞ্জ টাউনে। মিষ্টি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে তিনি রওয়ানা হলেন বাড়ির পানে। পথিমধ্যে গাছের চারা বিক্রেতার কাছ থেকে আট আনা পয়সা খরচ করে কিনলেন একটি ঔষুধী গাছের চারা। চারাওয়ালা বলে দিয়েছিলেন, এটা নাকি অর্জুন গাছের চারা।

ছেলের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাড়ির সদ্য কাটা পুকুড় পাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে অনেক যত্ম করে রোপন করলেন সেই চারা। সেই চারা যুগের পর যুগ অতিক্রম করে আজকের এই মহীরুহ বৃক্ষে পরিনতো হয়েছে। ছেলে মতিউর রহমানের বয়স এখন ৫০ বছর। গাছটির বয়সও ৫০ বছর!

কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে গাছটিকে ঘিরে। ভাঙ্গা-গড়ার সংসারের এই ৫০ বছরে হালখাতায় কতো হিসাব-নিকাশ। বাবা-মাসহ কতো আপনজনের প্রয়াণ আবার নতুন করে জন্ম নেওয়া ছেলে-মেয়ে ধরাধামে আসা, তাদের ঘরে আবার নতুন তৃতীয় প্রজন্মের নাতী-নাতনীদের আগমন! মজার ব্যাপার হচ্ছে এই কিছুদিন আগে সংসারে তার চতুর্থ প্রজন্মের একজনের আগমন ঘটেছে। সব প্রজন্মের কাছেই রমিজ উদ্দিনের মতো ৫০ বছরের অর্জুন গাছটিও এক অগ্নি সাক্ষি হিসাবে বেঁচে আছে।

চারিদিক ক্রমশ ফর্সা হয়ে গেছে। রমিজ উদ্দিন লাঠির সাহায্যে পায়চারি করতে করতে নিজের ঘরে এসে বললেন- ‘মতির মা, এক গেলাস পানি দাওতো।’

মতিউর জন্ম নেওয়ার পর বউকে তিনি ‘মতির মা’ বলে ডাকেন। বউয়ের ভালো নাম হলো গুলেছার নেছা।

গুলেছার নেছা পানি হাতে স্বামীকে বললেন-‘আইজ নাকি গাছ কাটার লাগি লোকজন আইবো?’
কথাটা শোনামাত্র রমিজ উদ্দিনের ভেতরটা ধক করে উঠলো। তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন তার প্রিয় অর্জুন গাছটি বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আজ সেই গাছ কেটে ফেলা হবে!

সত্যি বলতে কি গাছটি বিক্রি করার কোন উদ্দেশ্যই ছিলো না। তার পুরানো ঘরটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে অনেক আগেই। একটি নতুন ঘর বানানো জরুরী হয়ে উঠেছিলো। দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলের ঘরে নাতী-নাতনী হয়েছে। একমাত্র ছোট ছেলে অবিবাহিত। পড়াশোনা শেষ করে চাকুরীর সন্ধানে আছে। জীবীত থাকতেই তিনি ছোট ছেলের বউ ঘরে আনতে চান। মেয়েরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান-পার্বনে নাতী-নাতনীদের নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসলে, কাউকেই ভালো করে থাকতে দিতে পারেন না। তার মনে যে তখন কি কষ্ট কাজ করে, সে কথা গুলেছার নেছা ছাড়া হয়তো কেউই ভালোভাবে জানে না।

অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না রমিজ উদ্দিনের। নিজের বেশ কিছু কৃষি জমির ফল-ফসলাদি এবং বড় ছেলে মতিউর রহমানের ছোট্ট চাকুরীর অর্থেই তার সংসার চলে। তিনি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। জমিতে আগের মতো আর কাজও করতে পারেন না। সীমীত আয়ের সংসারে নতুন ঘর বানানো যে কতো বড় কষ্টসাধ্য ব্যাপার তিনি হারে হারে টের পাচ্ছেন।

পারিবারিকভাবে রমিজ উদ্দিনের বাড়ি থেকে তিনটি গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। পুরাতন ঘরের পেছনের বানরলাঠি ও কাঁঠালের গাছদ্বয়ের কাঠ ব্যবহৃত হবে নতুন ঘরের দরজা-চৌকাঠ তৈরির কাজে এবং পুকুরপাড়ের অর্জুন গাছটির বিক্রির টাকা দিয়ে মেঠানো হবে নতুন ঘরের অন্যান্য সামগ্রী কেনার কিছু খরচপাতি।

পারিবারিক সভায় রমিজ উদ্দিন অর্জুন গাছটি না কাটার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করেছেন। কিন্তু তার অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি। কারন বৃহত অর্জুন গাছটির বাজারমূল্য অনেক এবং কাঠক্রেতাদের কাছে অর্জুন কাঠের কদর বেশি।

কুতুবপুরের অক্সিজেন তৈরির বড় গাছ হিসাবে এক বৃদ্ধের গর্বেভরা বুক, অপ্রকাশিত আবেগ, হাজারো সুখ দুঃখের স্মৃতির চেয়ে নগদ অর্থের কদর যে অনেক বেশি মূল্যবান, পারিবারিক সভায় রমিজ উদ্দিন হারে হারে টের পেলেন। সেদিন থেকেই তিনি খুব ভোরে ধর্ম-কর্ম শেষে গাছটির নিচে গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। অন্তর ও বাহিরের চোখ দিয়ে গাছটির ডাল,পালা, পাতা, পাখিদের বাসা, পাতার উপরের আকাশ, আকাশের উপরে গাছটিকে কেন্দ্র করে নানান রকম স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে থাকেন।

গাছ দেখার জন্য বিভিন্ন কাঠক্রেতারা রমিজ উদ্দিনের বাড়িতে আসতে শুরু করলো। বিভিন্ন রকম দরদাম হচ্ছে অর্জুন গাছটির। গাছের দরদামের সময় তিনি পারতপক্ষে কাছাকাছি না থাকার চেষ্টা করেন। একদিন বড় ছেলে মতিউর অনেক দর কষাকষি শেষে রমিজ উদ্দিনের পঞ্চাশ বছরের পুরানো অর্জুন গাছটি পঞ্চান্ন হাজার টাকায় বিক্রি করে দিলেন!

গুলেছার নেছার প্রশ্নে স্ত্রীর দিকে বড় চোখ করে তাকালেন রমিজ উদ্দিন। কাঁপা হাতে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে বললেন-‘ আসুক, গাছ কাটার লোক! আমার কি? আমারে জিগাও কেনো?’ ফোপাতে ফোপাতে তিনি বেতের লাঠিটায় ধরে ধপাশ করে ঘরের চৌকিটায় মাথা নিচু করে বসে পড়লেন। স্ত্রী বললো-‘আপনার কি শইল খারাপ করছে? ‘
-‘না, আমার শইল খারাপ না! তুমি তোমার কাজে যাও।’ রাগত মেজাজে রমিজ উদ্দিন স্ত্রীকে শোবার ঘর থেকে বিদায় দিলেন। তার শরীর সত্যি খারাপ লাগতেছে। তিনি চৌখির উপর শুয়ে পড়লেন।

সকাল প্রায় দশটার দিকে গাছক্রেতা তার কাছকাটার দলবল নিয়ে রমিজ উদ্দিনের বাড়িতে হাজির হলো। ইলেকট্রিকের করাত, কুঠার, বড় বড় রশি, কতো কি?

কুতুবপুরের সবচেয়ে বড় গাছটি কাটার দৃশ্য দেখার জন্য বাড়িতে আশেপাশের অনেক লোকজন হাজির হলো। কাটুক তারা গাছ! রমিজ উদ্দিন আজ ঘর থেকে বের হবেন না বলে মনোস্থির করলেন।

গাছ কাটার তোড়জোড় প্রায় শেষ। এক্ষুণি ইলেকট্রিকের করাত চালু করা হবে। সবাই গাছের মালিক রমিজ উদ্দিনকে খোঁজ করছে। গুলেছার নেছা স্বামীকে ডাকতে গেলেন। অনেক অনুনয়-বিনয় করে স্বামীকে গাছ কাটার অনুমতির জন্য সেখানে নেওয়া হলো।

কাঁপা কাঁপা শরীরে অর্জুন গাছটির অদূরেই দাঁড়ালেন রমিজ উদ্দিন। তিনি অনুমতি দিলেন বটে! করাত চলতে শুরু করছে। করাতের শব্দে গাছের পাখ-পাখালিরা চিৎকার চেঁচামেচি করে উড়ে যাচ্ছে। দুটি বুলবুলি পাখি অর্জুন গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে ডানা ঝাঁপটিয়ে অদ্ভূত এক শব্দে জানান দিচ্ছে, তাদের বাসায় সদ্যফোটা বাবুদের নিয়ে যাওয়ার কোন জায়গা নেই! রমিজ উদ্দিন তার প্রথম সন্তানটি পৃথিবীতে আসার রাতে ফিরে গেলেন! তিনি আর কিছুই সহ্য করতে পারছেন না!

রমিজ উদ্দিনের হাতের লাঠি ঠকঠক করে কেঁপে উঠছে।

গাছতো সবেমাত্র কাটা শুরু হয়েছে। তার এতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কেনো? এর আগেতো তার শ্বাসকষ্টের কোন রোগ ছিলো না! তবে কি অর্জুন গাছটি কুতুবপুরে অক্সিজেন তৈরি বন্ধ করে দিয়েছে!

লাঠিটি হাতছাড়া হলো রমিজ উদ্দিনের! ধপাশ করে মাটিতে পড়ে গেলেন! গুলেছার নেছার গগনবিদারী চিৎকারে সবাই রমিজ উদ্দিনের কাছে ছুটে চললো। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। একজন ছুটলো ভ্যানগাড়ি জাতীয় কিছু একটা আনার জন্য। প্রায় অবচেতন রমিজ উদ্দিনকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ভ্যানে তোলা হলো।

গাছ কাটতে আসা লোকজন হতবম্ব। কিছুক্ষণের জন্য তারা কাজ বন্ধ রেখেছে। তারা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। গুলেছার নেছা কাঁদতে কাঁদতে ভ্যানে উঠার সময় গাছক্রেতাকে বললো-‘মতির বাপ সুস্থ্য অইয়া বাইত না আওয়ার গাছ থিক্কা একটা পাতাও ছিড়ুইন্না আফনেরা।’

হাসপাতালে শুয়ে আছেন রমিজ উদ্দিন। তাকে অক্সিজেন লাগানো হয়েছে। পালস, ব্লাড প্রেসার, ফুসফুস, হার্ট সব ঠিক আছে। আবাসিক চিকিৎসক ডা. আনিসুল হকের তত্বাবধায়নে তার চিকিৎসা চলছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার রোগ ধরা হলো ‘সিনকোপাল এ্যাটাক’। বড় কোন সমস্যা না। রেস্ট নিলে দ্রুতই সেরে উঠবেন রমিজ উদ্দিন।

একদিন পরেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলো রমিজ উদ্দিনের স্বাস্থ্য। ডা. আনিসুল হক তার বড় ছেলে ও স্ত্রীর কাছ থেকে সবিস্তারে সব জানলেন। রমিজ উদ্দিনের সাথেও তাঁর একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হলো রমিজ উদ্দিনকে।

সুরমার কূলঘেঁষে শহরতলীর অদূরেই অসাধারন একটি গ্রাম কুতুবপুর। অক্সিজেন তৈরির একটি গাছ কিনেছেন ডা. আনিসুল হক, মূল্য পঞ্চান্ন হাজার টাকা। গাছের মালিক রমিজ উদ্দিন, বিক্রেতা রমিজ উদ্দিনের বড় ছেলে মতিউর রহমান!

বাড়িটি খুঁজে পেতে মোটেও সমস্যা হয়নি ডা. আনিসুলের। কুতুবপুরের সবচেয়ে বড় বৃক্ষের বাড়িতেই এক সকালে ঢুকে পড়লেন তিনি। পুরো বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখলেন তিনি। পুরাতন একটি ঘরের পাশেই নতুন একটি ঘর বানানো হচ্ছে।

অর্জুন গাছটির ঠিক নিচেই দাঁড়ালেন ডাক্তার সাহেব। গাছের গুড়িতে অল্প একটু সদ্য কাটার দাগ! গুলেছার নেছা বড় গোমটা পড়ে ছুটে এসে বললেন-‘ডাক্তর সাব না? আফনি এইহানে?’ তার যেনো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তড়িগড়ি করে তিনি ছুটলেন মতির বাপের খুঁজে।

প্রকান্ড এক অর্জুন গাছের নিচে আনিসুল হক রমিজ উদ্দিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। বাড়ির বউ-ঝিয়েরা অদূরেই দাঁড়িয়ে আছেন উৎসুক চোখ নিয়ে।

রমিজ উদ্দিন কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ডাক্তার সাহেবকে ঘরে নিয়ে বসানোর জন্য তিনি তোড়জোড় শুরু করলেন।

-‘এখানেই ভালো লাগছে চাচা। আপনার শরীরের কি অবস্থা এখন?’
-‘খুব ভালা আছি, স্যার। আর কোনু সমস্যা হয় নাই। বয়স অইছেতো, স্যার। স্যার ঘরে গিয়া বন।’
-‘না চাচা, ঘরে যাবো না।’
অনেকটা ইতস্তত করে রমিজ উদ্দিন বলেন-
-‘ছেলে কইলো আফনি নাকি টাকা দিয়া গাছ কিনা নিছেন? যার কাছে গাছটা বেচ্ছিলাম, হেরে গতোকাইল সহালে টাকা ফিরত দিয়া আইছে মতিউর। ‘
-”হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। একটা গাছের দরকার ছিলো আমার।’
-‘ভালা করছেন, স্যার। এই গাছের কাঠ খুবই ভালা অইবো। কি বানাইবেন’ স্যার।’
-‘কিছু একটা করবো, দেখি।’
-‘ গাছ কবে কাটবেন?’

বৃদ্ধের প্রশ্নে কিছুক্ষণ নিরব থাকে আনিসুল হক। এই সসময় অর্জুন গাছটির উঁচু ডালে একটি ঈগল পাখি ডানা ঝাঁপটিয়ে বসে পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আনিসুল হক বলেন-
‘আপাতত গাছটি কাটার দরকার নাই আমার। কিনে রাখলাম, পাঁচ-দশ বছর থাকুক আপনার তত্বাবধায়নে। ভবিষ্যতে গাছ কাটার প্রয়োজন হলে আমি জানাবো, চাচা। এর আগ পর্যন্ত গাছের মালিক আপনিই। আপনিই গাছটিকে দেখেশুণে রাখবেন।’

ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে ছানাবড়া হয়ে উঠলো রমিজ উদ্দিনের চোখ। নিজের কানকে তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন। তার মানে? তিনি প্রকান্ড অর্জুন গাছটির উপরের দিকে তাকালেন। গাছের ডালে ডালে পাখিরা বসে আছে আছে, বসন্তের আগমনে সদ্য জন্ম নেওয়া সবুজ কচিপাতাদের ফাঁকে ফাঁকে অপূর্ব নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। রমিজ উদ্দিন মনে মনে কোরান মাজিদের আর রহমানের একটি আয়াত মনে করার চেষ্টা করছেন।

“ফাবিআইয়্যি আ-লা-য়ি রব্বিকুমা-তুকায্যিবা-ন্।”
-“অতএব, হে মানুষ ও জীনজাতি রবের কোন নিআমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে ?”

-‘দেইক্কা রাকমু স্যার, অবশ্যই দেইক্কা রাকমু। মরনের আগ পর্যন্ত দেইক্কা রাকমু।’

সুরমার শীতল বাতাস কুতুবপুরের গ্রামকে প্রশান্ত করে ডা. আনিসুল হকের গায় স্পর্শ করে যাচ্ছে ক্রমাগত। অর্জুন গাছের উঁচু ডালে বসা ঈগল পাখিটি হঠাৎ গাছটির ডাল-পালা কাঁপিয়ে শূণ্যে উড়াল দিয়েছে। কুতুবপুরবাসীর মতো বুকভরে অক্সিজেন বুকে টেনে নিজ গন্তব্যে ফিরে চলেছেন আনিসুল হক।

আনিসুল হকের পায়ের গতির কারনে ঝাঁপসা থেকে ঝাঁপসাতর হচ্ছে কুতুবপুর গ্রাম। এক বাড়িতে অস্পষ্ট একটি বড় বৃক্ষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।