জামায়াত ও কওমী প্রসঙ্গ

- আপডেট সময় : ০৪:৩০:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১২ অগাস্ট ২০২২ ২৮৯ বার পড়া হয়েছে
ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক
কওমী বা দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের সাথে ভারতীয় উপমহাদেশে জামায়াতের যে মনস্তাত্ত্বিক ও চিন্তাগত পার্থক্য ও দূরত্ব বিরাজমান তা শত বছর ধরে চলমান। এই দূরত্বকে যদিও অনেকেই আক্বিদাগত মত পার্থক্য বলে থাকেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এটি একটি অভিমানী মতপার্থক্য।
এই মত পার্থক্য নিয়ে আমি বেশ কয়েক বছর থেকে কিছু কিছু গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেছিলাম। আমি অনেকের সাথে অনেক গভীর ভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। একাধিক টাইটেল পড়ুয়া কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের সিলেবাস সহ বসে কথা বলেছি।
বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অঙ্গনের কওমী আলেম ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে দেখলাম কওমী মাদ্রাসার শুরু থেকেই জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী রহ. সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারনা দিয়ে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা হয়। এমনকি টাইটেল ক্লাসে মওদুদীর মতবাদ বিষয়ে একটি বই গুরুত্ব সহকারে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত।
এর একমাত্র কারন আক্বিদা নয়। এর পেছনে অভিমানটাই হলো মূল কারন। ভারতীয় উপ মহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম ইসলামি সংগঠন হলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। মাওলানা মওদুদী এক সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম করতেন এবং তিনি জমিয়তের মূখপাত্র আল জমিয়ত পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
উপ মহাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও স্বাধীকার আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রধান নেয়ামক শক্তি ছিলেন এই উপ মহাদেশের উলামায়ে কেরাম।
ইতিহাস থেকে জানা যায় করাচি শহরের এমন কোন গাছ নেই যে গাছে আলেমদের ঝুলিয়ে রাখেনি ব্রিটিশরা।
কিন্তু মাওলানা মওদুদী যখন জমিয়ত থেকে বের হয়ে তার চিন্তা চেতনা আদর্শ আর ইক্বামতে দ্বীনের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে প্রাথমিকভাবে লেখালেখি সেমিনার সিম্পোজিয়ামে বক্তব্য দিতে শুরু করলেন, তার সম্পাদনায় পত্রিকা বের হলো, ১৯৪১ সালে ৭৫ জন জন শক্তি নিয়ে তিনি সংগঠন গড়ে তুললেন তখনই তার বিরুদ্ধে অপবাদ অপপ্রচার হিংসা অভিমান যে শব্দেই বলা হোক তাই শুরু করা হয়।
উদাহরণ স্বরুপ সম্প্রতি বাংলাদেশেও কেউ দল থেকে বেরিয়ে গেলে সেই একই কায়দায় কেউ কেউ জাহান্নামি, আদর্শ বিচ্যুত, দ্বীনের পথ থেকে দূরে চলে গেছে ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করতে দেখা যায়। তবে এটা নতুন কিছু নয়। এটি এই উপ মহাদেশে ইসলামি রাজনীতির একটি ট্রেডিশন।
কেন তিনি জমিয়ত ছেড়ে আসলেন এটি হলো প্রথম অভিমান। বাংলাদেশের কওমি আলেমদের দ্বিতীয় অভিমান হলো- জামায়াত সব সময় কওমী আলেমদের সাথে বড় ভাই সুলভ আচরণ করে। মনে হয় যেন জামায়াত ই একমাত্র হক পন্থী ইসলামি সংগঠন। অনেকেই বলেন জামায়াতের কারো সাথে কথা বললে তা বুঝা যায়। একে অপরের কেউ কখনো কারো কাছাকাছি যায় না বা যেতে চায়না।
এই বিষয়ে আমি একদিন জামায়াত ঘরনার একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলেছিলাম। তিনি অনায়াসে বলেছেন কওমী আলেমদের সাথে দূরত্ব না কমানো পর্যন্ত জামায়াত কখনও ইসলামি বিপ্লবের চিন্তা ও করতে পারবেনা। এটি খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে আপনি যে জনপদে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে চান সেই জনপদের মেইন স্ট্রিম আলেম উলামার সাথে আপনার স্পষ্ট দূরত্ব, তারা আপনাকে মেনে নিতেই পারছেনা যে জনপদের আশি ভাগ মসজিদ মাদ্রাসার ইমাম মুহতামিম আপনার আদর্শকে মেনে নিতে পারেনা সেই জনপদে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা কঠিন।
আমাদের আলোচনার ইতি টানি এভাবেই যে- জামায়াতের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো উলামায়ে কেরামের সাথে দূরত্ব কমাতে না পারা। যদি ধরেও নেই মাওলানা মওদুদীর সাহিত্য কর্মে বাক্যগত বা শব্দগত কোন মৌলিক মতপার্থক্য থেকেই থাকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় গ্রহণযোগ্য উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করে তা যাচাই বাছাই করা যেতে পারে। এবং সমাধানের পথ উন্মুক্ত রাখতে হবে।
এখন আসি চরমোনাইয়ের অভিমানের কারন কি?
শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. সৈয়দ ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. ও আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের নেতৃত্বে যখন ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন গঠন করা হয়েছিল তখন থেকেই। যেদিন মহা সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়ে ছিল সেই সমাবেশের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল আল্লামা সাঈদীর। কিন্তু তৎকালীন জামায়াত আমীর প্রফেসর গোলাম আজমের প্রবল আপত্তির মুখে সমাবেশে সভাপতিত্ব না করে ঐদিন উমরাহ পালনে সৌদিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আল্লামা সাঈদীকে। এক পর্যায় সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন আল্লামা সাঈদী।
সেই অভিমান এখনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে চরমোনাই হুজুরদের। কারন এর আগে কখনোই চরমোনাই বলেননি জামায়াত কোন ইসলামি দল নয়।
এবং এর পরবর্তীতে গঠিত ইত্তেহাদুল উম্মাহ থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য করা হয় আল্লামা সাঈদীকে।
সমালোচকরা বলে থাকেন ইত্তেহাদুল উম্মাহ যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল যদি তা কার্যকর থাকতো শায়খুল হাদিস ও চরমোনাইয়ের পর আল্লামা সাঈদীই হতেন বাংলাদেশের ইমাম খোমেনি।
এখন আসি মূল কথায়।
সেই শত বছরের অভিমান দূরত্ব কমিয়ে আনার এক অসাধারন অনুপম কাজ শুরু করেছেন জামায়াতের বর্তমান আমীর ডাক্তার শফিকুর রহমান। আমার বিশ্বাস জামায়াত এবং কওমী উলামায়ে কেরামের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত ভুল বুঝাবুঝি রয়েছে এই উদ্যোগ এই ভাতৃত্বের মেলোবন্ধন সব কিছু পদদলিত করে একটি আলোকিত সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
জামায়াতের অধস্তন দায়িত্বশীল, কর্মী ও অনলাইন মুজাহিদদের উচিত আমীরে জামায়াতের কর্মকৌশল বিনয় ভদ্রতা ইমোশন সম্মান ভালবাসার দিকগুলো ফলো করা।
কওমী মাদ্রাসা না থাকলে বাংলাদেশ মানুষ রুপি পশুদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়ে যেতো। দেশের মসজিদ গুলো শূন্যতা দেখা দিতো। দ্বীনি মারকাজ, ইলমে দ্বীন এবং তাবলিগের যে মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন তা ইক্বামতে দ্বীনের আন্দোলনের প্রধান নেয়ামক শক্তি।
ছোটখাটো ভুল বুঝাবুঝি মতপার্থক্য ভুলে হাতে হাত কাধ কাধ রেখে জামায়াত ও কওমী উলামায়ে কেরাম এক মঞ্চে দাড়িয়ে গেলে বাংলাদেশের কাঙ্খিত স্বপ্নের ইসলামি বিপ্লবের পথেই হাটতে পারে বাংলাদেশ।
সাংবাদিক, বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য