ঢাকা ০৪:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আব্দু মিয়া স্যার: আমাদের আলোকিত বাতিঘর

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:৪৬:৫৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / 197
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

অণীশ তালুকদার বাপ্পু

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের জীববিজ্ঞানের প্রাণবন্ত শিক্ষক ছিলেন আব্দু মিয়া স্যার। ক্লাশে এসে বলতেন আমি অধ্যাপক নই, আমি একজন প্রদর্শক শিক্ষক।

স্পষ্ট উচ্চারণে তাঁর পড়ানোর কৌশল ছিল অত্যন্ত চমৎকার। শিক্ষার্থীদের সাথে সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল স্যারের। ব্যবহারিক ক্লাশে স্যার উদ্ভিদের প্রকার বিন্যাস শৈল্পিকতার সাথে বুঝিয়ে দিতেন এবং খুব যত্ন সহকারে ব্যবচ্ছেদ করাতেন।

একসময় স্যার প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগেরও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। স্যার খুব সৌখিন ছিলেন। নানা ধরণের স্লাইড ও নমুনা সংগ্রহ করে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। এতেই তিনি আনন্দ পেতেন। ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে গল্পও করতেন। তাঁর বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ছিল অনেক এবং অনেক উঁচু পর্যায়ের ছিলেন। একটি বিষয় আমাদের বেশ ভাবিত করতো যে স্যার ছিলেন চিরকুমার।

শীতকালে কলেজের শিক্ষার্থীরা উদ্যোগী হয়ে পিকনিকে যেত। সেখানে ৪/৫ জন শিক্ষক থাকতেন। বিজ্ঞান বিভাগের আবশ্যিক সংগী ছিলেন স্যার। তিনি প্রাণ খোলা হয়ে বনজংগলের বিভিন্ন উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতেন। ক্লাশে পরীক্ষা নিতেন এবং পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের ভুল-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করতেন। কলেজের ছাত্রীদের মধ্যে স্যারের জনপ্রিয়তা ছিল কিছুটা বেশী।

অভিভাবকদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে সুনামগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাসায় স্যারের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। চিরকুমার এই স্যারের ব্যস্ততার যেন শেষ ছিল না। দরিদ্র ছাত্রদের প্রতি তাঁর ছিল আলাদা টান।

ছাত্রদের কাছে প্রায়ই কলেজে বিএসসি খোলার গল্প করতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শন টিমকে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়লো স্যারের উপর। আব্দুল মান্নান চৌধুরী তখনকার সময় অধ্যক্ষ ছিলেন। তখন সিলেট – সুনামগঞ্জ সড়ক এত উন্নত ছিল না।

জাউয়া পর্যন্ত এসে টিমের সদস্যরা বিরক্ত হয়ে বললেন, এই রাস্তা দিয়ে আর যাওয়া যাবে না। তখন স্যার বললেন, ছাতক হয়ে লঞ্চ দিয়ে বিকল্প রাস্তা আছে। সবাইকে নিয়ে ছাতক লঞ্চঘাট গেলেন।

সুরমা নদীর বিশাল ঢেউ দেখে পরিদর্শন টিমের সদস্যরা ভয় পেয়ে লঞ্চে উঠতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাঁরা আব্দু মিয়া স্যারের ব্যবহার ও প্রজ্ঞা দেখে বললেন, আপনাদের কলেজে বিএসসি কোর্স চালু করার অনুমতি দেয়া হলো। আপনাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাবেন। আমরা চলে গেলাম।

১৯৭৮ সাল থেকে জেলায় জেলায় বিজ্ঞানমেলা শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা উৎসাহী হয়ে প্রজেক্ট বানিয়ে বিজ্ঞানমেলায় অংশগ্রহণ করতো। আব্দু মিয়া স্যার ছিলেন শিক্ষার্থীদের প্রাণপুরুষ। তিনি প্রজেক্ট বুঝিয়ে দিতেন এবং মেলাকে সুন্দর ও সফল করার পেছনে অবিরত পরিশ্রম করতেন। বিজ্ঞান মেলায় যারা ১ম পুরস্কার পেতো তাদের নিয়ে স্যার ঢাকায় যেতেন কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশ গ্রহণের জন্য।

ক্রিকেট ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও স্যারের ছিল আত্মিক সম্পর্ক। একসময় তিনি প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। এর একটি হলো সন্ধানী ডোনার ক্লাব যার কাজ হলো রক্ত সংগ্রহ করে ব্লাডব্যাংকের মাধ্যমে অসহায় রোগীকে সাহায্য করা। তাছাড়া নিয়মিত বৃক্ষরোপণ ছিল স্যারের অন্যতম শখ।

২০০২ সালের অক্টোবর মাসে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে স্যার অবসর গ্রহণ করেন। বিদায়ী অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী এবং সহকর্মীদের ভালোবাসায় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। এ সময়” আমাদের বাতিঘর” শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়।

শহরের প্রায় প্রতিটি বাসার সুখ-দুঃখের সাথে স্যার নিবিড়ভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। তিনি হয়ে ওঠেন শহরের সকল মানুষের গর্বিত অভিভাবক।

২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি শুক্রবার ভোররাতে সিলেটের রয়্যাল হাসপাতালে স্যার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সুনামগঞ্জ পুরাতন কোর্ট মসজিদ শহরের প্রাঙ্গনে সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে স্যারের বিশাল জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমাদের বাতিঘর। আমরা হলাম অভিভাবকহীণ। প্রার্থনা করি স্যারের আত্মা শান্তিতে থাকুক।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

আব্দু মিয়া স্যার: আমাদের আলোকিত বাতিঘর

আপডেট সময় : ০২:৪৬:৫৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২২

অণীশ তালুকদার বাপ্পু

সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের জীববিজ্ঞানের প্রাণবন্ত শিক্ষক ছিলেন আব্দু মিয়া স্যার। ক্লাশে এসে বলতেন আমি অধ্যাপক নই, আমি একজন প্রদর্শক শিক্ষক।

স্পষ্ট উচ্চারণে তাঁর পড়ানোর কৌশল ছিল অত্যন্ত চমৎকার। শিক্ষার্থীদের সাথে সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল স্যারের। ব্যবহারিক ক্লাশে স্যার উদ্ভিদের প্রকার বিন্যাস শৈল্পিকতার সাথে বুঝিয়ে দিতেন এবং খুব যত্ন সহকারে ব্যবচ্ছেদ করাতেন।

একসময় স্যার প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগেরও দায়িত্ব নিয়েছিলেন। স্যার খুব সৌখিন ছিলেন। নানা ধরণের স্লাইড ও নমুনা সংগ্রহ করে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। এতেই তিনি আনন্দ পেতেন। ক্লাশের ফাঁকে ফাঁকে গল্পও করতেন। তাঁর বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ছিল অনেক এবং অনেক উঁচু পর্যায়ের ছিলেন। একটি বিষয় আমাদের বেশ ভাবিত করতো যে স্যার ছিলেন চিরকুমার।

শীতকালে কলেজের শিক্ষার্থীরা উদ্যোগী হয়ে পিকনিকে যেত। সেখানে ৪/৫ জন শিক্ষক থাকতেন। বিজ্ঞান বিভাগের আবশ্যিক সংগী ছিলেন স্যার। তিনি প্রাণ খোলা হয়ে বনজংগলের বিভিন্ন উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতেন। ক্লাশে পরীক্ষা নিতেন এবং পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের ভুল-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করতেন। কলেজের ছাত্রীদের মধ্যে স্যারের জনপ্রিয়তা ছিল কিছুটা বেশী।

অভিভাবকদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে সুনামগঞ্জের প্রায় প্রতিটি বাসায় স্যারের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। চিরকুমার এই স্যারের ব্যস্ততার যেন শেষ ছিল না। দরিদ্র ছাত্রদের প্রতি তাঁর ছিল আলাদা টান।

ছাত্রদের কাছে প্রায়ই কলেজে বিএসসি খোলার গল্প করতেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শন টিমকে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়লো স্যারের উপর। আব্দুল মান্নান চৌধুরী তখনকার সময় অধ্যক্ষ ছিলেন। তখন সিলেট – সুনামগঞ্জ সড়ক এত উন্নত ছিল না।

জাউয়া পর্যন্ত এসে টিমের সদস্যরা বিরক্ত হয়ে বললেন, এই রাস্তা দিয়ে আর যাওয়া যাবে না। তখন স্যার বললেন, ছাতক হয়ে লঞ্চ দিয়ে বিকল্প রাস্তা আছে। সবাইকে নিয়ে ছাতক লঞ্চঘাট গেলেন।

সুরমা নদীর বিশাল ঢেউ দেখে পরিদর্শন টিমের সদস্যরা ভয় পেয়ে লঞ্চে উঠতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাঁরা আব্দু মিয়া স্যারের ব্যবহার ও প্রজ্ঞা দেখে বললেন, আপনাদের কলেজে বিএসসি কোর্স চালু করার অনুমতি দেয়া হলো। আপনাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাবেন। আমরা চলে গেলাম।

১৯৭৮ সাল থেকে জেলায় জেলায় বিজ্ঞানমেলা শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা উৎসাহী হয়ে প্রজেক্ট বানিয়ে বিজ্ঞানমেলায় অংশগ্রহণ করতো। আব্দু মিয়া স্যার ছিলেন শিক্ষার্থীদের প্রাণপুরুষ। তিনি প্রজেক্ট বুঝিয়ে দিতেন এবং মেলাকে সুন্দর ও সফল করার পেছনে অবিরত পরিশ্রম করতেন। বিজ্ঞান মেলায় যারা ১ম পুরস্কার পেতো তাদের নিয়ে স্যার ঢাকায় যেতেন কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশ গ্রহণের জন্য।

ক্রিকেট ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও স্যারের ছিল আত্মিক সম্পর্ক। একসময় তিনি প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। এর একটি হলো সন্ধানী ডোনার ক্লাব যার কাজ হলো রক্ত সংগ্রহ করে ব্লাডব্যাংকের মাধ্যমে অসহায় রোগীকে সাহায্য করা। তাছাড়া নিয়মিত বৃক্ষরোপণ ছিল স্যারের অন্যতম শখ।

২০০২ সালের অক্টোবর মাসে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে স্যার অবসর গ্রহণ করেন। বিদায়ী অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী এবং সহকর্মীদের ভালোবাসায় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। এ সময়” আমাদের বাতিঘর” শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়।

শহরের প্রায় প্রতিটি বাসার সুখ-দুঃখের সাথে স্যার নিবিড়ভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। তিনি হয়ে ওঠেন শহরের সকল মানুষের গর্বিত অভিভাবক।

২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি শুক্রবার ভোররাতে সিলেটের রয়্যাল হাসপাতালে স্যার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সুনামগঞ্জ পুরাতন কোর্ট মসজিদ শহরের প্রাঙ্গনে সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে স্যারের বিশাল জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমাদের বাতিঘর। আমরা হলাম অভিভাবকহীণ। প্রার্থনা করি স্যারের আত্মা শান্তিতে থাকুক।