সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হবে আসানমারা সেতুর পূর্ব পাশে

- আপডেট সময় : ০১:৩৪:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২৩ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধি
উপাচার্য নিয়োগ হলেও জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ গেল প্রায় দুই বছর ধরে থমকে দাঁড়িয়েছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নানের কার্যালয়ে সুনামগঞ্জের ছয় সংসদ সদস্য বৈঠকে বসেন। বৈঠকে জমির বিষয়ে প্রাথমিক ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন জেলার ছয় সংসদ সদস্য। প্রস্তাবিত জমি হচ্ছে সুনামগঞ্জ সদর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার মধ্যবর্তী আহসান মারা সেতুর পূর্বদিকের উত্তর-দক্ষিণ পাশ নিয়ে। আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে এসে জমি দেখবেন পরিকল্পনামন্ত্রী, সংসদ সদস্যগণসহ দায়িত্বশীলরা। এরপরই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমির প্রস্তাব পাঠাবেন জেলা প্রশাসক। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি নিয়ে সংসদ সদস্যদের এই বৈঠকের খবরকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন সুনামগঞ্জের বিশিষ্টজনেরাও।
২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। এরপর জমি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেওয়ায় দেড় বছর এর কাজে কোন অগ্রগতিই ছিল না। ১৫ জুন, ২০২২’এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিয়োগ পান অধ্যাপক মো. আবু নঈম শেখ। অধ্যাপক মো. আবু নঈম শেখ গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) গণিত বিভাগের প্রধান ছিলেন। নিয়োগের দিন থেকে তাঁর মেয়াদ চার বছর। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জায়গার (স্থান নির্ধারণের) বিষয়টি নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়ায় উপাচার্য সুনামগঞ্জে অফিস নিতে পারছিলেন না, আবার রাজধানীতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অফিস নেই।
২০২০ সালের সাত নভেম্বর সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত বিল সংসদে উপস্থাপন হয় । শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় বিশ্ববিদ্যালয়টি শান্তিগঞ্জে (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) এলাকায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জায়গা নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়। এরপর আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে সুনামগঞ্জের ‘দেখার হাওরের পাড়ে’র কথা উল্লেখ করা হয়। হাওরটি জেলা সদর, শান্তিগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। বিশাল এই হাওরের কোথায় বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে, সেটি নির্ধারণ না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে জট তৈরি হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোন বাজেট এখনো আসেনি। উপাচার্যের অফিস, গাড়ী কিছুই নেই।
এই অবস্থায় মঙ্গলবার বিকালে পরিকল্পনা মন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি, মুহিবুর রহমান মানিক এমপি, ড. জয়া সেন গুপ্তা এমপি, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এমপি, বিরোধীদলীয় হুইপ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ্, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি শামীমা শাহরিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আবু নঈম শেখ, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার শহীদুল আলম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবু নঈম শেখ এই প্রসঙ্গে জানালেন, পরিকল্পনা মন্ত্রীর কার্যালয়ে সুনামগঞ্জের মাননীয় সংসদ সদস্যগণ জমি নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠকে বসেছিলেন। জমির বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন তারা। ১৭ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে দেখে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। পরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব যাবে।
সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ্ বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি নির্বাচন নিয়ে বিল পাসের আগে আমাদের দাবি ছিল সদর উপজেলার কাছাকাছি যেন হয় জমি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরে বিল পাস হয়। এরপর বহুদিন পরে উপাচার্য নিয়োগ ছাড়া কোন কাজ হয় নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসক জমি দেখেছেন, সভায় তিনি সেই প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। এখন আমরা সকলে একসঙ্গে জমি দেখবো। ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ এগিয়ে নেব।
সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বললেন, দেখার হাওর পাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ ইতিবাচকভাবে এগুচ্ছে। আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজসহ সুনামগঞ্জবাসীর কাঙ্খিত উন্নয়ন এগিয়ে নিতে চাই।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দেখার হাওর পাড়ের অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি, সরকারি জমি আছে, দুই উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে জেলা প্রশাসক জমির প্রস্তাব দিয়েছেন। সকলে আমরা মোটামুটিভাবে একমত হয়েছি। ১৭ সেপ্টেম্বর সবাই একসঙ্গে গিয়ে জমি দেখবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপর আমাদের সকলের আস্থা আছে। গেল দুই বছর কার্যত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ এগুয়নি। অতীতকে পেছনে ফেলে আমরা এগুতে চাই। জমি নির্বাচনের প্রাথমিক আলোচনার সময় আমি অসুস্থ্য ছিলাম। এজন্য কিছু ফারাক তৈরি হয়েছিল। আমি আশা করছি এখন সবকিছু ইতিবাচকভাবে এগুবে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু আমাদের প্রতি সহানুভুতিশীল। সকলে মিলে আরও অনেক কিছুই করবো আমরা।
রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি নির্বাচনে ইতিবাচক খবর সুনামগঞ্জে জানাজানি হলে সকলেই ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি লেখক ও গবেষক আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন বলেছেন, আমরা ভীষণভাবে খুশী। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু হোক এই প্রত্যাশা সুনামগঞ্জবাসীর। একই ধরণের মন্তব্য করেছেন, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট হুমায়ুন মঞ্জুর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ পরিমল কান্তি দে, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি রবিউল লেইস রোকেসসহ বিশিষ্টজনেরা।
প্রসঙ্গত. ২০১৬ সালের ৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জবাসীর পক্ষে তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুনামগঞ্জে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি তুলেন। সভায় উপস্থিত ওই সময়ের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এতে সমর্থন জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সম্মতি প্রকাশ করেন। পরে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী একটি বেসরকারি চাহিদাপত্র (ডিও লেটার) দেন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। ডিও লেটারে প্রতিমন্ত্রী উল্লেখ করেন, বর্তমান সরকার দেশের শিক্ষাখাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারা দেশে নতুন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের একটি পশ্চাৎপদ এলাকা। শিক্ষায় তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। পিছিয়ে থাকা সুনামগঞ্জ জেলার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন জরুরি।
পরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আইন প্রস্তুত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ডেপুটি ডিরেক্টর মৌলি আজাদের নেতৃত্বে কমিটি করে দেয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে এই খসড়া আইন প্রস্তুত হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব সৈয়দ আলী রেজা এই খসড়া আইনটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। যেহেতু এটি একটি স্বতন্ত্র আইন। অন্য কোন মন্ত্রণালয়ের বা অন্য কোন আইনের ধারা উপধারা অনুচ্ছেদ বা উপ-অনুচ্ছেদের বক্তব্য বা মতামতের সাংঘর্ষিকতা আছে কী-না, তা যাচাই-বাছাই করার জন্যই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এই খসড়া আইন পাঠানো হয় এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অভিমত নেওয়া হয়। পরে বাংলাদেশ ভাষা কোর্স (বাভাকো)’ থেকে এ আইনের প্রণিত শব্দ চয়নের ব্যাপারে সুপারিশ নেওয়া হয়। সুপারিশের প্রেক্ষিতে আইনটি’র শব্দ’র পরিবর্তন-পরিমার্জন করে ২০১৯ সালের ডিসেম্ব মাসে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগে পাঠালে ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর মন্ত্রী পরিষদের সভায় আইনের খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন লাভ করে।
সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের খসড়া মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদনের আনন্দে ভাসে সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জবাসীর বহুদিনের দাবি বাস্তবায়নের স্বপ্নযাত্রা শুরু হওয়ায় ২০২০ সালের পাঁচ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ স্টেডিয়াম মাঠে বিশাল আনন্দ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। এই আইন পাসের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি নির্ধারণ নিয়ে আপত্তি তুলেন। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ‘দেখার হাওরে’ লিখে আইন পাস হয়। কিন্তু বিশাল দেখার হাওরের কোথায় বিশবিদ্যালয় হবে সেটি উল্লেখ না করায় এই জটিলতা রয়েই যায়।