সংবাদ শিরোনাম ::
কিংবদন্তি ছাত্রনেতা ছোহেল আহমদ চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম শাহীন
- আপডেট সময় : ০৬:৩৯:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪ ৪৯ বার পড়া হয়েছে
কিংবদন্তি ছাত্রনেতা ছোহেল আহমদ চৌধুরী। ”৯০ দশকের ছাত্ররাজনীতির এক বিরল প্রতিভা আজো অমর-চিরঞ্জীব। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য,সিলেট মহানগরী ও ঢাকা মহগানগরী উত্তরের সভাপতি হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন ছাত্ররাজনীতির এক অনুকরণীয় আইডল হিসেবে।
১৯৯৫ সালের ১৮ নভেম্বার, কালজয়ী কালোত্তীর্ণ অনন্য ব্যক্তিত্ব ছোহেল আহমদ চৌধুরী এ পৃথিবীর মায়া মমতা ত্যাগ করে মহান মা’বুদের ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। প্রায় দু’যুগ পর আজকের এই দিনে ছোহেল আহমদ চৌধুরীর জীবন, কর্ম নিয়ে লিখেছেন তাঁরই সতীর্থ যুক্তরাজ্য প্রবাসী সিরাজুল ইসলাম শাহীন।
‘যে স্মৃতি অশ্রু ঝরায় প্রেরণা যোগায়’- শিরোনামে লেখা —-সিরাজুল ইসলাম শাহীন এর স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি পাঠ করছিলাম তাঁর টাইমলাইনে। সত্যিই অলক্ষে বেয়ে আসে অশ্রু। ঝাপসা হয়ে যায় চোখ। আমার সুনামগঞ্জ ডট কম এর পাঠকদের জ্ঞাতার্থে লেখাটি প্রকাশ করলাম। – সম্পাদক।
যে স্মৃতি অশ্রু ঝরায় প্রেরণা যোগায়
♦সিরাজুল ইসলাম শাহীন♦
ভাইজান, জানতে বড় ইচ্ছে করে , আপনি এখন কেমন আছেন? কিন্তু উপায় নেই অপেক্ষা ছাড়া সেদিনের – যেদিন সকল কিছু জানার সুব্যবস্থা করে রেখেছেন মহান রাব্বুল আলামীন। ১৯৯৫ সালের ১৮ নভেম্বর এর পর থেকে আমাদের জীবনে এমন মুহুর্ত খুবই কম এসেছে যেখানে আপনার উপস্থিতি নেই। প্রকৃতপক্ষে মূহুর্তগুলোর সমষ্টি যে বিষয়বস্তু, ঘটনা, প্রতিবন্ধকতা অথবা সফলতার জন্ম দিয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতে অনুভব করেছি আপনার রেখে যাওয়া স্মৃতির শক্তিশালী প্রভাব। ভাবতে অবাক লাগে ,এত অল্পসময়ে- এত বেশি কেমন করে দিয়ে গেলেন? আর যদি এত কিছু নিয়ে এসেছিলেন, তাহলে এত দ্রুত চলে গেলেন কেন? আসলে যারা দিতে জানে তারা নিতে জানেনা, আপনিও তাই তাড়াহুড়ো করে সব বিলিয়ে দিয়ে আমাদের চিরঋণী করে এ জীবন থেকে বিদায় নিলেন।
প্রথম পরিচয় :
১৯৮৫ সালে অক্টোবরের কোন এক দিন সকাল ১০ টায় শাহী ঈদগাহ মসজিদে দু’তলায় ছিল উপশাখার সাধারণ সভা। মেহমান কি বলেছিলেন এখন আর মনে নেই। তবে মুখের ভাষার সাথে চোখ ও হাত সমান তালে নড়াচড়া করছিল। শ্রুতারা মাঝে মাঝে হাসছেন, আবার কখনও নিরব হয়ে যাচ্ছেন অথবা মাথা ঝাঁকাচ্ছেন আর বক্তার মুখ ক্রমেই লাল হয়ে যাচ্ছিল। আমরা সবাই যেন তাজা হয়ে সভা থেকে বের হলাম। সবার সাথে মেহমান হাত মিলিয়ে বিদায় নিলেন। আমার হাতে নরম হাতের একটা বেশ শক্ত চাপ অনুভব করলাম। ফখরুল (ইউকে প্রবাসী)ভাইয়ের সাথে হোন্ডায় করে মেহমান চলে গেলে শুনলাম বলাবলি হচ্ছে , আর ক’দিন পর-এই ছোহেল ভাই শহর শাখার সেক্রেটারি হয়ে যাবেন। বুঝলাম আমাদের আজকের মেহমান খুবই সম্ভাবনাময় ছাত্রনেতা। যার প্রতিভার স্ফুরণ সম্পর্কে একটি উপশাখার কর্মীরাও সম্যক ধারণা রাখে। আপনার সাথে এটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাৎ । সেই থেকে ১৯৯৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০ বৎসর আপনাকে দেখেছি কাছে থেকে- আপন করে।
ভালবাসা -যেন বৃষ্টির অবিরাম মুষলধারা :
বৃষ্টির মুষলধারা যেমন কঠিন শক্ত মাটিকে করে তোলে উর্বরা, তেমনি শত সহস্র সমস্যাপীড়িত কর্মীকে আপনার নিখাদ ভালবাসা করে তুলতো সদা সতেজ আর ময়দানের জন্য পাগল পারা। এখনও অবাক বিস্ময়ে ভাবি, কেমন করে এতো ভালবাসতে পারতেন। তখন আপনি সিলেট শহর শাখা শিবিরের সভাপতি আর আমি এইচ এসসি পরীক্ষার্থী- সংগঠনের সাথী। সকাল বেলা মনির ভাইর ৫ম তলায় (পায়রা ৭) সেই রুমটিতে হঠাৎ হাজির হলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসলেন ,“শাহীন ,তুমি কি অসুস্থ?” আামি এতই অসুস্থ ছিলাম যে, চেয়ারে বসে লেখা পড়া করতে পারছিলাম না। অত্যধিক পীড়াপীড়িতে বিস্তারিত বলতে বাধ্য হলাম। আর লক্ষ্য করলাম, আপনার দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমাকে বললেন,‘তুমি এতো অসুস্থ ছিলে ,আমি জানলামনা কেন ? আমারতো জানার অধিকার আছে’। নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থেকে সেদিন আপনার হৃদয়ের ভালবাসার গভীরতা অনুভব করছিলাম। অনেকদিন আপনি বলেছেন, ‘আমি যদি বুকটা চিরে দেখাতে পারতাম, তোমাদের কত ভালবাসি’। এমন মায়াভরা আবেগময় উক্তি ক’জন বলেছে আর ক’জন শুনেছে? পায়রা ‘৮৬ তে বসে আলাপের এক পর্যায়ে বলেছিলেন ,রাসুল (সঃ) কোন কোন সাহাবীকে সরাসরি বলেছিলেন তিনি উনাদের ভালবাসেন, ‘আমিও তোমাকে বলছি ভাইয়া, আমি তোমাদের ভালবাসি’। আপনার এমন ভালবাসা ছিল আমাদের কাছে যাদুর পরশ কাটি। ব্যক্তিগত- পারিবারিক সমস্যা সব ভুলে গিয়ে আল্লাহর দ্বীনের পথে ঝাঁপ দেয়ার জন্য এর চেয়ে মহৌষধ আর কি হতে পারে? খালেদ ভাই ছিলেন সম্ভাবনাময় সাথী । প্রায় ৪ বছর মাথার ব্যাথায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। একাধিকবার দাখিল পরীক্ষা দিতে পারেননি। সে নিয়ে আপনার কত টেনশন ছিল। একদিন সাথীদের শব্বেদারীতে শেষ রাতে মেডিকেল কলোনী মসজিদে খালেদ ভাইর সুস্থতার জন্য সকলকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে যে আহাজারী করেছিলেন ,আজও তা আমাদের কানে বাজে। সুস্থ হয়ে খালেদ ভাই সদস্য হয়েছিলেন এবং ডিগ্রী পাশ করে ছাত্র জীবন শেষে ৩ মাসের মধ্যে রুকনিয়াতের শপথও নিয়েছেন। বাড়ী থেকে আসলে বা কোন কারনে কয়েকদিন দেখা না হলে প্রথম সাক্ষাতে আপনি হাসি মুখে দুহাত প্রসারিত করে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে নিতেন। আাপনার ভালবাসা ছিল অফুরন্ত। সেখানে ছিলনা কোন কৃত্রিমতার লেশ। ছিল শুধু আন্তরিকতা আর কল্যাণ কামনা। অকৃত্রিম ভালবাসার কাঙাল জনশক্তির জন্য আপনি গড়ে তুলেছিলেন নির্ভরযোগ্য এক ঠিকানা।
উদারতা -যেন এক মহাসমুদ্র :
আপনার হৃদয়ের উদারতা চলার পথের সকল বাধা প্রতিবন্ধকতাকে করেছিল চরমভাবে পরাজিত। বহুবিধ কষ্টগুলো হজম করেছেন বিস্ময়কর ভাবে। আপনি বলতেন ‘ইসলামী আন্দোলন করতে হলে সমুদ্রের মত উদার হতে হবে’। সমুদ্র যেমন করে পৃথিবীর সকল ময়লা -আবর্জনা গ্রহণ করে অতি স্বাভাবিক ভাবে, আমাদেরকেও তেমনি অভ্যস্থ হতে হবে। কারও বিরুদ্ধে আপনার কোন অভিযোগ ছিলনা। একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়গুলো আমাদের সাথে আলাপ করলেও এ বিষয়ে ছিলেন একেবারে নিরব। দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে নেহায়েৎ অন্যায়ভাবে কষ্ট পাওয়ার ঘটনাগুলোতে আপনার উদারতা লক্ষ্য করে বিস্ময়াবিভূত হয়ে পড়ি। আপনার বি.এ পরীক্ষার ফল নিয়ে অথবা দৈনিক জালালাবাদের জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে তিক্ত অভিজ্ঞতাকালীন আপনার ধৈর্য্য আজও কঠিন সময়ে আমাদের পথ প্রদর্শন করে। মনে পড়ে, সদস্যপ্রার্থী আবেদন পত্র দেয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন ,‘সম্পূর্ন মিথ্যা ,বানোয়াট ও উদ্দেশ্য- প্রনোদিত হয়ে যদি কেউ কোন কথা বলেছেন বলে মনে কর তবুও তা ভুলে যেতে হবে’। মানুষের সংগঠন পরিচালনায় এ ‘ডকটিন’ সংকীর্ণতা ও ভুল ধারণার ছোবল থেকে আত্বরক্ষার্থে যথার্থই অপরিহার্য।
আমল- আল্লাহর ভয়ে কম্পমান পথিকঃ
আপনার ব্যক্তিগত আমল ছিল সবকিছুর উর্ধ্বে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আপনার চোখ লাল। আমরা বুঝতাম আপনি শেষ রাতে ইবাদাত করেছেন। আপনার বালিশের নীচে তাছবিহ্ থাকতো। প্রায়ই রোজা রাখতেন এবং অন্যদের উৎসাহিত করতেন। কোরআন তেলাওয়াত সহিহ করার জন্য বায়তুল আমান মসজিদের ইমাম হযরত মাওলানা মুজাম্মিল হুসাইন সাহেবের ক্লাশ করেছিলেন কত সহজভাবে। মাওলানা সাহেব বিভিন্ন সময় একথা গল্প করেন। আপনি ছিলেন আল্লাহর ভয়ে সর্বদা কম্পমান মুমিন। অবসর সময়ে উঠতে বসতে প্রায়ই বলতে শুনতাম ‘ আল্লাহ মাফ করে দাও’। আলাহ অপনাকে মাফ করে দিয়েছেন কি না ইহজীবনে তা জানার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু শত-সহস্র কণ্ঠ প্রতিনিয়ত আপনার জন্য ক্ষমা ও উত্তম মর্যাদা ভিক্ষা করছেন পরম করুনাময়ের দরবারে, এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ভাইজান, আপনি কতো ভাগ্যবান!
নেতৃত্ব বাছাই – এক অসাধারণ প্রতিভা :
নেতৃত্বের জন্য যোগ্য লোক বাছাই করা ছিল আপনার মহান ব্রত। কর্মীদেরকে অন্তর্ভেদী দৃষ্ঠি দিয়ে অবলোকন করতেন। সবার যোগ্যতা,দূর্বলতা ও স¤ভাবনা সম্পর্কে ছিল সুস্পস্ট ধারনা। সদ্য বিদায়ী সভাপতি হিসাবে সিলেট শহর শাখা শিবিরের পরামর্শ সভার বেঠকে সকল সদস্য ভাইদের সম্পর্কে যে বিবরণ দিচ্ছিলেন তা দেখে বিস্মিত হয়ে কোন কোন ভাই বলছিলেন, ‘এ কি, মনে হচ্ছে যেন ভিডিও রেকর্ড দেখে দেখে বলছেন।’ প্রত্যেকের বিস্তারিত খোঁজ খবর রাখতেন । আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাইয়া, তোমার বাড়ীতে যাওয়ার পর আমি তোমার ব্যাপারে চুড়ান্ত সিদ্বান্ত নিয়েছি’। গরিবালয়ে আপনি কি দেখেছিলেন তা আমি আজও বুঝতে পারিনি। নেতৃত্ব বাছাইয়ে আপনি ছিলেন খুবই সতর্ক। বংশ পরিচয় থেকে শুরু করে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, মেধা,সাংগঠনিক দক্ষতা,আনুগত্য- আমল সহ সকল বিষয়ে আপনি লক্ষ্য রাখতেন। সমস্ত সিলেট বিভাগের সকল শাখায় দায়ীত্বশীলদের চেইন তৈরীতে পেরেশান থাকতেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার ধারাবাহিক ১০তম সভাপতি আমি তৈরী দেখতে চাই’। প্রায়ই এ ব্যাপারে খোঁজ নিতেন। কাউকে ভালো করে চিনতে না পারলে বলতেন,‘ আমার কাছে একবার পাঠিয়ে দিও, একটু দেখতে চাই’। কোন কর্মী সমাবেশে গেলে আপনার চোখ নেতা খুঁজে বেড়াত। কাউকে পছন্দ হলে দায়ীত্বশীলকে ঐ ভাইয়ের ব্যাপারে খেয়াল রাখার জন্য বলে আসতেন। কষ্টিপাথর যেমন করে খাটি সোনা নির্ধারন করে ,আপনিও শত শত জনশক্তির মধ্য থেকে নেতৃত্ব বাছাইয়ে ছিলেন এক বিরল প্রতিভা ।শুধু সিলেটে নয় ,ঢাকা মহানগরীতে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা চালু করা ছিল আপনার একান্ত স্বপ্ন। যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই আপনার এ মিশন কার্যকর ছিল। তাই আজ আপনি না থেকেও হয়ে আছেন অমর-চিরঞ্জীব।
সাহসিকতা- যেন মৃত্যুঞ্জয়ী মহাবীরঃ
আপনার সাহসিকতা ছিল সর্বজনবিদিত। জাগতিক কোন প্রকার ভয়ভীতি আপনাকে স্পর্শ করতে পারেনি।“১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫” দীর্ঘ এ ১০বছরের সাহসী সিদ্বান্ত গুলোতে ছিল আপনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। ময়দানের প্রয়োজনীয়তা অনুভবের সাথে সাথেই নিয়েছেন বলিষ্ট পদক্ষেপ।‘৮৯-তে এরশাদ ভাইকে আহত অবস্থায় ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই থেকে উদ্বারের পর জাসদ ছাত্রলীগের সশস্ত্রবাহিনী আলিয়া মাদ্রাসায় হামলা করেছিল।সন্ত্রাসীদের আগ্নেয়াস্ত্রের আলোর ঝলকানী আর অস্ত্রের ঝনঝন শব্দের মধ্যেও মাত্র কয়েকজন ভাইকে নিয়ে খালি হাতে সেই অন্ধকার রাতে হামলা প্রতিহত করেছিলেন। পুলিশ এসে উল্টো আমাদের ভাইদেরকে ধাওয়া করলে, করেছিলেন প্রতিবাদ।ফলশ্রুতিতে আপনাকে থানা হাজতে একরাত কাটিয়ে কোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল।সেদিন আপনার আংগুল থেকে ঝরে যাওয়া রক্ত জিন্দাবাজারের রাস্তায় আজও মিশে আছে। ঢাকায় কলাবাগান ছাত্রাবাসে ইফতার মহফিলে ঘাদানীকরা হামলা করেছিল। তৎকালীন কেন্দ্রের সদস্য খায়ের ভাই বলেছেন,“হঠাৎ করে দেখলাম, ছোহেল ভাই দৌড় দিয়ে ওদের সামনে চলে গিয়েছেন। ছোহেল ভাইকে রক্ষা করার জন্য আমরাও বেরিয়ে পড়লে ওরা পলিয়ে যায়।” সেদিনের আপনার অসম সাহসী ভূমিকায়- আলাহর একান্ত মেহেরবানীতে রক্ষা পেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সভাপতি সহ নেতৃবৃন্দ আর কেন্দ্রীয় মেছ-কলাবাগান ছাত্রাবাস। ‘৮৭-র ৭ সেপ্টেম্বর এম.সি.কলেজে আপনার দূর্দান্ত সহসিকতা ইতিহাসের গতিধারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল।সেই থেকে সকল ক্যাম্পাস সহ সিলেট মহানগরীতে ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের বলিষ্ট অবস্থানের নব যাত্রা শুরু হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে আপনি ছিলেন “শাহাদাতের” তীব্র আকাংখী। তাই সকল সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করেননি।আপনার দরাজ কন্ঠের সাড়া জাগানো বক্তব্য শ্রোতাদের উদ্বেলিত করত। জনশক্তি কঠিন সময়ে আলাহব রাস্তায় প্রাণ বিসর্জনের দৃপ্ত শপথ নিত নির্দ্বিধায়। কোর্ট পয়েন্ট, আলিয়া মসজিদের মিম্বর ও মিলনায়তন থেকে আজও মনে হয় সেই বজ্রকন্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে।
নেতা লোকমান ভাইর বাসায় গিয়ে মনে হত যে উনি আসলেই আপনাকে স্নেহ করতেন। এধরনের অনেকেই ঈদে অপেক্ষা করতেন। কুরবানীর ঈদে চামড়া তুলে ছাত্রকল্যাণ তহবিল গঠনের গোড়াপত্তন আপনার হাতেই। এজন্য আপনাকে নিরস কথা কম শুনতে হয়নি। কিন্তু আপনি ছিলেন লক্ষ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আজ সারা দেশে ছাত্র আন্দোলনের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়ের উৎস।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর থেকে আপনার পেরেশানী আমরা কাছ থেকে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষ না পারলেও প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের প্রথম থাকার ব্যাবস্থা করেছিলেন মদিনা মার্কেটের দু‘তলা বাড়িটি ভাড়া নিয়ে। পাশ্ববর্তী এলাকা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ক্যাম্পাস-নিকট বর্তী ৫৫শতকের সেই মূল্যবান প্লটটি ক্রয় করতে আপনার টেনশন বুঝা যায় যখন হোন্ডার পেট্রোল কিনতে গিয়ে বলে উঠেছিলেন,“–ডেসিমেল পেট্রোল দিন।”এ জমিটা নিতে ফরিদ ভাইয়ের বিশেষ ভূমিকার কথাটুকও আমাকে আপনি বলেছেন। আপনি থাকলে হয়তো এ প্রজেক্ট এতদিনে অনেক দুর এগিয়ে যেত।
কোন এক কাজে রেলস্টেশনে গিয়েছেন। তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান বদরউদ্দিন কামরান সাহেব দুই হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে নেমে আসলেন ট্রেন থেকে। হঠাৎ করে দেখি আপনি ব্যাগ দুটি ছো-মেরে নিয়ে এসে গাড়ীতে তুলে দিলেন। অসুস্থ রাজনীতির এ জোয়ারের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্বাবোধের এমন নজির বিরল।এজন্যই হয়তো ১৮ নভেম্বর ১৯৯৫ দিনগত রাতে যেন সিলেট নগরীর সকল রাস্তা ফাজিল চিশ্তমূখী হয়ে পড়েছিল।সারা রাত দিন হাজার হাজার মানুষের আপনার বাসামূখী স্রোত দেখে এলাকাবাসী হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।আপনার সময়ের রাজপথ কাপানো ছাত্রনেতা সাবেক জাসদ ছাত্রলীগ সভাপতি জাকির আহমদ ভাই নাকি গভীর রাতে আপনার কফিনের পাশে গিয়ে চোখের পানি ফেলেছিলেন।আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তা, আকর্ষনীয় ব্যাক্তিত্ব ও আখেরাতমূখী জীবন আমাদের সার্বক্ষণিক প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
তবে ইউকে প্রবাসী ‘ফাহিমা ভাবী’কে বিয়ে করতে আপনার রাজি হয়ে যাওয়াটা রহস্যময় মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আপনার স্বভাবজাত দূরদৃষ্টিতে হয়তো কিছু ধরা পড়েছিল বলে কঠিনতম এ সিদ্বান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আলাহ তায়ালার প্রিয় হওয়ায় কোন কালিমা স্পর্শ করার আগেই তিনি আপনাকে উঠিয়ে নিয়েছেন আর আমাদেরকে রেখে আপনাকে ইউকে যেতে হয়নি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, অনন্য কর্ম আর হাতে গড়া অসংখ্য দ্বীনি ভাইয়ের হাত প্রতিনিয়ত আপনার জন্য সদকায়ে জারিয়ার ভান্ডার সমৃদ্ব করছে –ইনশাআল্লাহ। আপনার জন্য প্রকৃতই হিংসা হয়, আমরা দুনিয়া থেকে যাওয়ার আগে কিছুটা হলেও এমন কিছু বন্দোবস্ত কি সম্ভব হবে? আলাহ মালুম।
শেষ বিদায় : ৪ সেপ্টেম্বর, ৯৫-কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট সদস্য হিসেবে আমি ঢাকায় যাই। রেলস্টেশনে বিদায় দিতে আপনি এসেছিলেন–দ্বীনি ভাইদের হোন্ডার বহর আর গিফ্ট সবই আপনার ইশারায় হয়েছিল। এই ক‘দিনে বার বার টেলিফোন আর চিঠি লিখে উৎসাহ দিয়েছেন-গাইড করেছেন। নভেম্বরের ২য় সপ্তাহে সুনামগঞ্জে কর্মী সম্মেলনে যাওয়া-আসার পথে মাক্রোবাসে আমার পাশে বসে অনেক কথা বলেছিলেন। আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন- আপনাকে এই প্রথমবারের মত কিছুটা হতাশ মনে হচ্ছিল।পরে ঢাকায় এসেছিলেন, যাওয়ার দিন নীচে এসে দেখি মহসিন ভাই রেডী কিন্তু আপনি উনাকে রেখে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন কমলাপুর। ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পর জানালায় হাতের উপর মাথা রেখে একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়েছিলেন যতক্ষণ দেখা যায় । আমি কি জানতাম, এটিই আমাদের শেষদেখা – মাত্র৩/৪ দিনের মাথায় চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন?
১৮ নভেম্বার পল্টন মসজিদ থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে মিছিল শেষ করে মাগরিবের নামাজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখনি কেউ এসে জোর গলায় বলছিল ‘‘সিলেটের ছোহেল ভাই মারা গেছেন।’’ আপনি বাদজোহর এম.সি.কলেজে বক্তব্য রেখে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসারত আপনার আম্মার কাছে গিয়ে হার্ট এটাকে আক্রান্ত হয়ে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন)
ভাইজান, মহান মনিবের দরবারে প্রাণভরে এই আকুতি জানাই, তিনি যেন আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চতম আসনে আসীন করেন আর আমাদেরকে শেষ বিচারের দিনে একসাথে হাসর নসীব করেন। আমীন।।
সিরাজুল ইসলাম শাহীন
বৃটেন প্রবাসী সাবেক মেধাবী শিবির নেতা ও
সিলেট মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারী।
sirajulislamshaheen@yahoo.com