সুনামগঞ্জ ০২:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নুরুল ইসলামঃ এক মর্দে মুজাহিদের অন্তিম বিদায়

ডাঃ. সায়েফ আহমদ
  • আপডেট সময় : ০৬:৪০:৪৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ৮৯ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

নুরুল ইসলামঃ এক মর্দে মুজাহিদের অন্তিম বিদায়
ডাঃ. সায়েফ আহমদ

আশির দশকে শাহজালালের পুন্যভুমি সিলেটের দুর্দান্ত এক সাহসী মর্দে মুজাহিদ নুরুল ইসলাম। আজ শুক্রবার ইংল্যান্ডের সেফিল্ড শহরে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। বয়সে আমার অনেক ছোট। ১৯৮৭-৮৮ সালে যখন আমি সিলেট শহরের সভাপতি সে তখন শিবিরের সাথী। পিতা জনাব মদরিছ আলী চাচা। ৬০ এর দশক থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দেশেই পড়াশোনা করিয়েছেন। দেশে পড়াশোনা করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর চাচী সহ ৯০ এর দশকের শুরুতে তাদেরকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। ১৯৮৭ সালে সিলেট শহর শাখার একমাত্র ৫০সিসি মোটরসাইকেলটি দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে ফেলে। চাচা দেশে গেলে আবাসিক এলাকায় অবস্থিত বাসায় তার সাথে সাক্ষাৎ করি এবং আমাদেরকে একটি মোটরসাইকেল প্রদানের আবেদন করি। তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে দামি H100S হোন্ডা মোটরসাইকেলটি সেই সময়ে আশি হাজার টাকা দিয়ে চাচা আমাদেরকে কিনে দেন। শুনতে অবাক লাগবে সেই মোটরসাইকেলে চারজন পর্যন্ত আরোহন করা যেত। চাচা এতই দানশীল ছিলেন যে, প্রতি মাসের বেতন থেকে একটা অংশ শিবিরের জন্য রেখে দিতেন। বছর শেষে সেই টাকা শিবিরের কাছে পৌঁছে দিতেন।

২০০১ সালে পশ্চিম পীর মহল্লায় একটি পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিলে সমস্ত ফার্নিচার এবং বই পুস্তক চাচা দান করেন। গত বছর ইংল্যান্ড সফরে চাচার বাসায় গিয়েছিলাম হাসপাতালের কালেকশনের জন্য। চাচা আমাকে একটি টাকার থলি দিয়ে বললেন, এই থলিতে তোমার হাসপাতালের জন্য টাকা জমিয়ে রেখেছি। যতবার ইংল্যান্ডে গিয়েছি চাচার আতিথিয়তা ছিল আকাশ সম। এখনো চাচা প্রতিমাসে পেনশনের টাকা থেকে সংগঠনের জন্য একটি অংশ রেখে দেন। আজকের লিখনী সেই চাচার ছেলে নুরুল ইসলামের জন্যে।

২০১৫ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে এই দীর্ঘ সময়ে শারীরিক অনেক অক্ষমতা নিয়েও আল্লাহর দ্বীনের পথে নিরলস কাজ করে গেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে আমার কোরআনিক গ্রামার ক্লাসের ষষ্ঠ ব্যাচের শেষের আধা ঘন্টা কোরআনের তাজউইদ শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছে। দীর্ঘদিন অনলাইনে শিক্ষক হিসাবে আমাকে তাজউইদ শিক্ষা দিয়েছে। সে ছিল আন্তর্জাতিক মানের একজন কোরআনের শিক্ষক।

আশির দশকের ইসলামী আন্দোলনের বীর মুজাহিদদের সাথে সিলেটের আনাচে-কানাচে নুরুল ইসলামের পদচারনায় শাহজালালের পুন্য ভূমির মাটি হয়েছে উর্বর। ১৯৮৮ সালে ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের কালা পাহাড়ের পাদদেশের সংঘর্ষের পর পরবর্তী ছয় মাস সিলেট শহরের রক্ত ঝরার স্মৃতি যাদের হৃদয়ে অনুরনিত হয়, নুরুল ইসলামের স্মৃতি তাদের স্মরণে থাকার কথা। মাথায় হেলমেট পরিহিত অবস্থায় শহরের আনাচে-কানাচে যখন যেখানে, যে প্রয়োজন পড়তো নুরুল ইসলাম ছিল সদা প্রস্তুত।

তৎকালীন সময়ে হাতেগোনা দুই একজন কর্মী, সাথীর ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল ছিল, সংগঠনের কাজের জন্য চাচা তাকে মোটরসাইকেল কিনে দিয়ে ছিলেন। সেই মোটরসাইকেল নিয়ে ২৪ ঘন্টা প্রস্তুত থাকতো, ডাক আসলেই জীবনের তোয়াক্কা না করে ছুটে যেত গন্তব্যে। জাসদের ছাত্র ব্রিগেডের সন্ত্রাসে যেখানে প্রতিটি জনপথ ছিল রক্তাক্ত। শহরের প্রায় এলাকা ভাইদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে নুরুল ইসলাম ছিল নির্ভীক, নির্ভয়। পিতার অনুপ্রেরণা আর সাংগঠনিক আনুগত্যে আরো শত কর্মীর মত নুরুল ইসলাম ছিল পরীক্ষিত। এমসি কলেজের প্রথম বর্ষের ছোট্ট অবয়বের নুরুল ইসলামকে বাতিলেরা তেমন চিনতে পারত না। তাই দ্বিধাহীন চিত্তে কঠিন সেই সময়ও নুরুল ইসলাম ছিল অনেকটা অন্ধের যষ্টির মত। মরহুম সোহেল ভাই তাকে ভীষণভাবে স্নেহ করতেন।

উত্তম চরিত্রের এক বাস্তব নমুনা ছিল নুরুল ইসলাম। সব সময় হাসিখুশি থাকতো। কারো সাথে রাগ করে কোনদিন কথা বলেনি। মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসা নজিরবিহীন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের তরে তার জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছে। নিজ শহর সেফিল্ডে সংগঠনের যাত্রা শুরু তার হাতেই। নিজ দেশের জন্য তার জীবনটা সব সময় ছটফট করতো। আমার সাথে তার সুগভীর সম্পর্ক ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ২০১৫ সালে যখন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়, তখন থেকেই মাঝে মাঝে টেলিফোনে তার অবস্থা জানাত। মহান আল্লাহর প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। সবরের পরম পরাকাষ্ঠার মাধ্যমে জীবনের নয়টি বছর ক্যান্সারকে সাথে নিয়ে কুরআনের শিক্ষক হিসাবে দেশে বিদেশে আল্লাহর দ্বীনের কাজ করে গেছে।

গত বছর সেফিল্ডের বাসায় তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সন্ধা রাতে বহু সময় স্মৃতি রোমন্থন করে মহান আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করে জীবনের শেষ আলিঙ্গন করলাম। ১৫-২০ দিন আগে হাসপাতালের বেডে থেকে টেলিফোনে তার কষ্টের কথা জানালো। ভিডিও কলে তাকে দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না। হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। অনেক ছোট হয়েও সে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল। তার মতো আশির দশকের বীর সেনানিদের মধ্যে সোহেল আহমদ চৌধুরী, ফারুক আহমদ, ডাঃ আনোয়ার, মিসবাহুর রহমান চৌধুরী ইতিমধ্যে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। এভাবে আমাদেরকে একদিন চলে যেতে হবে। এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আখেরাতের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এখন। বিদেশে যারা অবস্থান করেন, দেশের জন্য তাদের হৃদয় যে কাঁদে নুরুল ইসলাম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমার কাছে এই অসুস্থ অবস্থায় দেশের মানুষের জন্য কিছু করার পরামর্শ নিতো। নিজের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে দেশে গিয়ে জনসেবা করবে এই অভিব্যক্তি আমাকে বিমোহিত করেছিল।

নুরুল ইসলামের শশুর আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন সিলেটের শ্রেষ্ঠ আলেম, কুদরত উল্লাহ মসজিদের সাবেক ইমাম ও খতিব, বিখ্যাত গ্রন্থ “সত্যের আলো” বইয়ের লেখক জনাব মওলানা বশিরুজ্জামান। সিলেটের ইসলামী আন্দোলনের এক প্রাণ পুরুষ। ব্রিটেনের সুয়ানসি শহরে গত বছর তার বাসায় মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। স্থানীয় জামে মসজিদে তার সভাপতিত্বে হাসপাতালের জন্য ডোনেশন কালেকশন করি। সেই আশির দশকের শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে বশিরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে। সেই স্মৃতি উল্লেখ করে এই লিখার পরিধি বাড়াতে চাই না।

নুরুল ইসলামের ছোট ভাই সিরাজ, সুয়ানসি শহরের একজন দায়িত্বশীল। চাচা সেখানেই থাকেন। কয়েক বছর আগে চাচী মারা গেছেন। ছোট বোন সালমার স্বামী আমাদের সকলের প্রিয় এফ কে এম শাহজাহান, আরেক বোন আসমার স্বামী রেদোয়ান আমার আত্মীয়। নুরুল ইসলামের বিদায়ে সবাই আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত। মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন সকলকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করেন।

৮০এর দশক থেকে শুরু করে আজ অবধি নুরুল ইসলামের সাথে যারা সম্পর্কিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ব্যবসায়ী পার্টনার সকলের কাছে আমার আকুল আবেদন, সকলে যেন তাকে মাফ করে দেন। ইসলামী আন্দোলনে তার অবদান, প্রায় ২০ বছরে কুরআনের খেদমতে তার যে সময় এবং শ্রম, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন কবুল করেন এবং তাকে মাফ করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন, স্ত্রী ও সন্তানাদির জিম্মাদারী গ্রহণ করেন।
মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, আমিন

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

নুরুল ইসলামঃ এক মর্দে মুজাহিদের অন্তিম বিদায়

আপডেট সময় : ০৬:৪০:৪৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

নুরুল ইসলামঃ এক মর্দে মুজাহিদের অন্তিম বিদায়
ডাঃ. সায়েফ আহমদ

আশির দশকে শাহজালালের পুন্যভুমি সিলেটের দুর্দান্ত এক সাহসী মর্দে মুজাহিদ নুরুল ইসলাম। আজ শুক্রবার ইংল্যান্ডের সেফিল্ড শহরে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। বয়সে আমার অনেক ছোট। ১৯৮৭-৮৮ সালে যখন আমি সিলেট শহরের সভাপতি সে তখন শিবিরের সাথী। পিতা জনাব মদরিছ আলী চাচা। ৬০ এর দশক থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দেশেই পড়াশোনা করিয়েছেন। দেশে পড়াশোনা করে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর চাচী সহ ৯০ এর দশকের শুরুতে তাদেরকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। ১৯৮৭ সালে সিলেট শহর শাখার একমাত্র ৫০সিসি মোটরসাইকেলটি দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে ফেলে। চাচা দেশে গেলে আবাসিক এলাকায় অবস্থিত বাসায় তার সাথে সাক্ষাৎ করি এবং আমাদেরকে একটি মোটরসাইকেল প্রদানের আবেদন করি। তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে দামি H100S হোন্ডা মোটরসাইকেলটি সেই সময়ে আশি হাজার টাকা দিয়ে চাচা আমাদেরকে কিনে দেন। শুনতে অবাক লাগবে সেই মোটরসাইকেলে চারজন পর্যন্ত আরোহন করা যেত। চাচা এতই দানশীল ছিলেন যে, প্রতি মাসের বেতন থেকে একটা অংশ শিবিরের জন্য রেখে দিতেন। বছর শেষে সেই টাকা শিবিরের কাছে পৌঁছে দিতেন।

২০০১ সালে পশ্চিম পীর মহল্লায় একটি পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিলে সমস্ত ফার্নিচার এবং বই পুস্তক চাচা দান করেন। গত বছর ইংল্যান্ড সফরে চাচার বাসায় গিয়েছিলাম হাসপাতালের কালেকশনের জন্য। চাচা আমাকে একটি টাকার থলি দিয়ে বললেন, এই থলিতে তোমার হাসপাতালের জন্য টাকা জমিয়ে রেখেছি। যতবার ইংল্যান্ডে গিয়েছি চাচার আতিথিয়তা ছিল আকাশ সম। এখনো চাচা প্রতিমাসে পেনশনের টাকা থেকে সংগঠনের জন্য একটি অংশ রেখে দেন। আজকের লিখনী সেই চাচার ছেলে নুরুল ইসলামের জন্যে।

২০১৫ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে এই দীর্ঘ সময়ে শারীরিক অনেক অক্ষমতা নিয়েও আল্লাহর দ্বীনের পথে নিরলস কাজ করে গেছে। করোনা পরবর্তী সময়ে আমার কোরআনিক গ্রামার ক্লাসের ষষ্ঠ ব্যাচের শেষের আধা ঘন্টা কোরআনের তাজউইদ শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছে। দীর্ঘদিন অনলাইনে শিক্ষক হিসাবে আমাকে তাজউইদ শিক্ষা দিয়েছে। সে ছিল আন্তর্জাতিক মানের একজন কোরআনের শিক্ষক।

আশির দশকের ইসলামী আন্দোলনের বীর মুজাহিদদের সাথে সিলেটের আনাচে-কানাচে নুরুল ইসলামের পদচারনায় শাহজালালের পুন্য ভূমির মাটি হয়েছে উর্বর। ১৯৮৮ সালে ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের কালা পাহাড়ের পাদদেশের সংঘর্ষের পর পরবর্তী ছয় মাস সিলেট শহরের রক্ত ঝরার স্মৃতি যাদের হৃদয়ে অনুরনিত হয়, নুরুল ইসলামের স্মৃতি তাদের স্মরণে থাকার কথা। মাথায় হেলমেট পরিহিত অবস্থায় শহরের আনাচে-কানাচে যখন যেখানে, যে প্রয়োজন পড়তো নুরুল ইসলাম ছিল সদা প্রস্তুত।

তৎকালীন সময়ে হাতেগোনা দুই একজন কর্মী, সাথীর ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল ছিল, সংগঠনের কাজের জন্য চাচা তাকে মোটরসাইকেল কিনে দিয়ে ছিলেন। সেই মোটরসাইকেল নিয়ে ২৪ ঘন্টা প্রস্তুত থাকতো, ডাক আসলেই জীবনের তোয়াক্কা না করে ছুটে যেত গন্তব্যে। জাসদের ছাত্র ব্রিগেডের সন্ত্রাসে যেখানে প্রতিটি জনপথ ছিল রক্তাক্ত। শহরের প্রায় এলাকা ভাইদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে নুরুল ইসলাম ছিল নির্ভীক, নির্ভয়। পিতার অনুপ্রেরণা আর সাংগঠনিক আনুগত্যে আরো শত কর্মীর মত নুরুল ইসলাম ছিল পরীক্ষিত। এমসি কলেজের প্রথম বর্ষের ছোট্ট অবয়বের নুরুল ইসলামকে বাতিলেরা তেমন চিনতে পারত না। তাই দ্বিধাহীন চিত্তে কঠিন সেই সময়ও নুরুল ইসলাম ছিল অনেকটা অন্ধের যষ্টির মত। মরহুম সোহেল ভাই তাকে ভীষণভাবে স্নেহ করতেন।

উত্তম চরিত্রের এক বাস্তব নমুনা ছিল নুরুল ইসলাম। সব সময় হাসিখুশি থাকতো। কারো সাথে রাগ করে কোনদিন কথা বলেনি। মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালবাসা নজিরবিহীন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের তরে তার জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছে। নিজ শহর সেফিল্ডে সংগঠনের যাত্রা শুরু তার হাতেই। নিজ দেশের জন্য তার জীবনটা সব সময় ছটফট করতো। আমার সাথে তার সুগভীর সম্পর্ক ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ২০১৫ সালে যখন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়, তখন থেকেই মাঝে মাঝে টেলিফোনে তার অবস্থা জানাত। মহান আল্লাহর প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। সবরের পরম পরাকাষ্ঠার মাধ্যমে জীবনের নয়টি বছর ক্যান্সারকে সাথে নিয়ে কুরআনের শিক্ষক হিসাবে দেশে বিদেশে আল্লাহর দ্বীনের কাজ করে গেছে।

গত বছর সেফিল্ডের বাসায় তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সন্ধা রাতে বহু সময় স্মৃতি রোমন্থন করে মহান আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করে জীবনের শেষ আলিঙ্গন করলাম। ১৫-২০ দিন আগে হাসপাতালের বেডে থেকে টেলিফোনে তার কষ্টের কথা জানালো। ভিডিও কলে তাকে দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না। হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। অনেক ছোট হয়েও সে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল। তার মতো আশির দশকের বীর সেনানিদের মধ্যে সোহেল আহমদ চৌধুরী, ফারুক আহমদ, ডাঃ আনোয়ার, মিসবাহুর রহমান চৌধুরী ইতিমধ্যে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। এভাবে আমাদেরকে একদিন চলে যেতে হবে। এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আখেরাতের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এখন। বিদেশে যারা অবস্থান করেন, দেশের জন্য তাদের হৃদয় যে কাঁদে নুরুল ইসলাম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমার কাছে এই অসুস্থ অবস্থায় দেশের মানুষের জন্য কিছু করার পরামর্শ নিতো। নিজের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা না করে দেশে গিয়ে জনসেবা করবে এই অভিব্যক্তি আমাকে বিমোহিত করেছিল।

নুরুল ইসলামের শশুর আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন সিলেটের শ্রেষ্ঠ আলেম, কুদরত উল্লাহ মসজিদের সাবেক ইমাম ও খতিব, বিখ্যাত গ্রন্থ “সত্যের আলো” বইয়ের লেখক জনাব মওলানা বশিরুজ্জামান। সিলেটের ইসলামী আন্দোলনের এক প্রাণ পুরুষ। ব্রিটেনের সুয়ানসি শহরে গত বছর তার বাসায় মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। স্থানীয় জামে মসজিদে তার সভাপতিত্বে হাসপাতালের জন্য ডোনেশন কালেকশন করি। সেই আশির দশকের শত স্মৃতি জড়িয়ে আছে বশিরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে। সেই স্মৃতি উল্লেখ করে এই লিখার পরিধি বাড়াতে চাই না।

নুরুল ইসলামের ছোট ভাই সিরাজ, সুয়ানসি শহরের একজন দায়িত্বশীল। চাচা সেখানেই থাকেন। কয়েক বছর আগে চাচী মারা গেছেন। ছোট বোন সালমার স্বামী আমাদের সকলের প্রিয় এফ কে এম শাহজাহান, আরেক বোন আসমার স্বামী রেদোয়ান আমার আত্মীয়। নুরুল ইসলামের বিদায়ে সবাই আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত। মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন সকলকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করেন।

৮০এর দশক থেকে শুরু করে আজ অবধি নুরুল ইসলামের সাথে যারা সম্পর্কিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ব্যবসায়ী পার্টনার সকলের কাছে আমার আকুল আবেদন, সকলে যেন তাকে মাফ করে দেন। ইসলামী আন্দোলনে তার অবদান, প্রায় ২০ বছরে কুরআনের খেদমতে তার যে সময় এবং শ্রম, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন কবুল করেন এবং তাকে মাফ করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন, স্ত্রী ও সন্তানাদির জিম্মাদারী গ্রহণ করেন।
মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, আমিন