সুনামগঞ্জের হাটবাজার ইজারা
২১ মাসে বাদাঘাটে দেড় কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত সরকার

- আপডেট সময় : ০৫:৩৮:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫ ২২৩ বার পড়া হয়েছে
সুনামগঞ্জের বৃহৎ বাজার বাদাঘাটকে ঘিরে বড় লুটপাটের সিণ্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। ওই বাজার দরপত্র আহ্বান করে ইজারা না দিয়ে খাস কালেকশনের নামে সরকারকে নামেমাত্র ইজারামূল্য দিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে তখনকার সরকারদলীয় কিছু লোক।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরেকপক্ষ সরকারি এই হাঁটের রাজস্ব লুটপাটে নেমেছে। লুটপাট ঠেকাতে জেলা প্রশাসক খাস কালেকশনের জন্য প্রকাশ্য দর আহ্বান করেছেন।
তাতে এক লাখ টাকার স্থলে রোববার (১২ জানুয়ারি) সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। সেই হিসেবে গেল একুশ মাসে এই বাজার থেকে সরকার প্রায় দেড় কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে।
জেলার ১৯২টি বাজারের ৬৯ টি গেল মৌসুমে ইজারা দিতে পারে নি কতৃর্পক্ষ। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য তাহিরপুরের বৃহৎ বাদাঘাটবাজার ও মধ্যনগর বাজার। জেলা প্রশাসক সরেজমিনে তাহিরপুর গিয়ে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে প্রকাশ্য নিলামে বাদাঘাট বাজার ‘খাস কালেকশনের’ ব্যবস্থা করেন। তাতে মাসে এক লাখ টাকা খাস কালেকশনের স্থলে ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা খাস কালেকশন আদায় করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, সুনামগঞ্জের বৃহৎ বাদাঘাট বাজার সর্বশেষ ১৪২৯ বাংলায় ৫০ লাখ টাকায় ইজারা হয়। উৎসকর ও ভ্যাটসহ ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন ইজারাদার। সেই অনুযায়ী প্রতি মাসের ইজারা মূল্য পাঁচ লাখ টাকারও বেশি হয়।
১৪৩০ বাংলা সনে এসে বাজারটি ইজারা হয় নি। তৎকালীন সংসদ সদস্য অ্যাড. রনজিত সরকারের চাওয়া পূরণ করতে তার ঘনিষ্টজন বাদাঘাটের বাসিন্দা সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আপ্তাব উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তারা মিয়া ও আলমগীর খোকনসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে বাজারের খাস কালেকশন আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রকাশ্যে তহশিলদার খাস কালেকশন আদায় করছে বলা হলেও বাজারের রাজস্ব লুটের সিণ্ডিকেট গড়ে ওঠে সাবেক এমপি রনজিত ও তখনকার ইউএনও সালমা পারভিনের নেতৃত্বে। কোন দরপত্র আহ্বান ছাড়াই কিছু আওয়ামী লীগ নেতাকে লুটপাটের ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া হয়।
তাহিরপুর এসি ল্যান্ড অফিসের একজন কর্মচারী জানান, তারা পুরো একবছরে ১২ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব জমা দেয় নি। রাজস্ব কত জমা দেওয়া হচ্ছে, এটা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীসহ কাউকেই জানানো হতো না।
সাংবাদিকরা জানার চেষ্টা করলে নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা করা হতো বলে জানিয়েছেন স্থানীয় এক গণমাধ্যম কর্মী।
৫ আগষ্টের পর এ নিয়ে সসমালোচনা শুরু হলে গত ১৯ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া তাহিরপুর উপজেলা পরিদর্শনে যান।
এ সময় অ—ইজারাকৃত বাদাঘাট বাজারের খাস আদায়ের অনিয়মের বিষয়ে ব্যাখ্যা চান তিনি। সংশ্লিষ্টদের জবাবে সন্তোষ্ট হতে পারেন নি তিনি। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি তন্তের জন্য সুনামগঞ্জের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ—পরিচালককে নির্দেশ দেন।
তাহিরপুর এসি ল্যাণ্ড অফিসের একটি সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক এমপি রনজিতের সমর্থকরা এলাকা ছাড়ে।
তাহিরপুর এসি ল্যাণ্ড অফিসের একজন কর্মচারী ও জেলা প্রশাসকের রাজস্ব শাখার একাধিক কর্মচারী জানান, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাদাঘাট বাজারের খাস কালেকশনের দায়িত্ব নেয় তাহিরপুর উপজেলা বিএনপি’র নেতা (উপজেলা সভাপতি হতে আগ্রহী) জুনাব আলী’র কয়েকজন সমর্থক।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মৌখিকভাবে এক বছরের জন্য ২৪ লাখ টাকায় খাস কালেকশনের ইজারা নেয় এই সিণ্ডিকেট। তারা বাদাঘাটের আজিজুল ইসলামসহ কয়েকজনকে ৫৬ লাখ টাকায় সাব ইজারা দিয়ে টোল আদায় শুরু করে। ১৪৩১ বাংলা সনের অগ্রহায়ণ (নভেম্বর মাস পর্যন্ত) মাস পর্যন্ত। এরাই টোল আদায় করে। তাতে প্রায় একুশ মাস খাস কালেকশনের নামে হরিলুট হয়। এই একুশ মাসের কোন মাসেই এক লাখ টাকার বেশি রাজস্ব জমা হয় নি বলে জানিয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা এসি ল্যান্ড অফিসের একজন কর্মচারী।
এসব লুটপাটের তথ্য জেলা প্রশাসকের নজরে এলে গেল ৩০ ডিসেম্বর উপজেলা মিলনায়তনে উন্মুক্ত প্রতিযোগীতায় বাদাঘাট বাজারকে এক মাসের জন্য ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকায় আজিজুল ইসলাম নামের বাদাঘাটের একজনকে খাস কালেকশন আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয়।
হাওরাঞ্চলে এখন বছরের একমাত্র বোর ফসল ধান রোপনের কাজ চলছে। এজন্য বাজারে এখন ‘অফসিজন’ চলছে উল্লেখ করে বাদাঘাটের একজন বড় ব্যবসায়ী জানালেন, বর্ষা, ঈদসহ ‘পিকসিজনে’ বাজারের রাজস্ব আয় আরো কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।
খাস কালেকশন আদায়কারী আজিজুল ইসলাম বললেন, গেল একমাসে অনেক লোকসান হয়েছে আমারে। তবুও জেলা প্রশাসকের কঠোর নিদের্শ থাকায় আজ (রোববার) রাজস্ব জমা দিতে এসেছি। এ রিপোর্ট লেখার সময় ছয়টা ৪৫ মিনিটে আজিজুল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে রাজস্বের টাকা নিয়ে গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
এই এক মাসের আগেও তারাই আদায় করেছিলেন, তখন কেন এমন হলো জানতে চাইলে, আজিজুল বললেন, ওইসময় তহশিলদার আদায় করেছেন, আমরা তাকে সাহায্য করেছি।
বিএনপি নেতা জুনাব আলী বললেন, বাদাঘাট বাজার আমার লোকজন বা আমি ২৪ লাখ টাকায় খাস কালেকশনের জন্য নিয়েছি। পরে ৫৬ লাখ টাকায় আরেকপক্ষকে দিয়েছি। এধরণের তথ্য সত্য নয়। যারা এসব বলেছে, তারা আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। আমি বাদাঘাট বাজারের ইজারা’র সঙ্গে জড়িত নয়। যারা ইজারা নিয়েছে তারা আমার কেউ নয়। আমি রাজনীতি করি, দলের শত শত কর্মী আছে। যে কেউ অন্যায় করলে, আমার উপর দায় বর্তানোর কথা নয়।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বললেন, আমি চেষ্টা করছি। সবকিছু পারছি এমনটা নয়। বাদাঘাট বাজারের বিষয়টি আমি তাহিরপুরে সরেজমিনে গিয়ে তথ্য নিয়ে প্রকাশ্য ডাকের মাধ্যমে ইজারা আহ্বায়নের ব্যবস্থা করেছি। আগে মাসে এক লাখ টাকা পাওয়া যেত। এখন সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা হবার কথা। একমাস হয়ে গেছে। টাকা জমা না দিলে প্রথম ও দ্বিতীয় (ইজারা নিতে আগ্রহী) দুইজনের জামানত বাতিল হবে। তাতেও দুই লাখ টাকা আসবে। আগের চেয়ে অন্তত বেশি ওঠবে। টাকা দিলে ধন্যবাদ জানাবো। টাকা না দিলে জামানত বাতিল করে আবার রপত্র আহ্বান করবো। দরপত্রে অংশ না নেবার জন্য সিণ্ডিকেট করার চেষ্টা করলে, জনগণকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। সরকারকে টাকা না দিয়ে, কোন একজন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে এমন সুযোগ দেওয়া হবে না।
খাস কালেকশন কী ও কেন?—
মামলাসহ নানা কারণে যে সকল হাট, ঘাট ও বিল ইজারা দেওয়া যায় না সেগুলো থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য খাস কালেকশনের মাধ্যমে টাকা আদায় করা হয়। প্রকাশ্যে ডাকে বা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক দিয়ে এই কাজ করার নিয়ম আছে।
কিন্তু খুব গোপনে প্রশাসন আর ক্ষমতাশীল নেতারা ভাগাভাগি করে এসকল উৎসগুলো লুটপাট করেন। দৈনিক বা প্রতি সপ্তাহে খাস কালেকশনের টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তিন মাস বা চার মাস পর পর ইচ্ছেমতো নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে দায় সারেন প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা—কর্মচারী। গোপনে শুধু কাগজে নিয়ম রক্ষা হয় বলে এই খাস কালেকশনের খবর কেউ জানে না।
তাহিরপুরের একজন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী বললেন, বাদাঘাট বাজার উন্মুক্ত ডাকের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক যে নজির স্থাপন করলেন, তা ধরে রাখলে বাড়বে রাজম্ব আয়, কমবে দূবৃর্ত্তায়।