বইপোকা বলতে যা বোঝায় আমি সে রকম লোক

- আপডেট সময় : ০৩:৫৬:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ৬৫ বার পড়া হয়েছে
বইপোকা বলতে যা বোঝায় আমি সে রকম লোক।বাসায় বই রাখার জায়গা নেই। কিন্তু বই দেখলে মনে হয় কিনে ফেলি।এই বই পড়ার অভ্যাস আমার খুব ছোটবেলা থেকে চলে আসছে।শুরু হয়েছিল দুস্য বনহুর,মাসুদ রানা,তিন গোয়েন্দা,সাইমুম সিরিজ,ক্রসেড সিরিজ। অতঃপর গল্পের জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ এর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ।
গতকাল পড়ে শেষ করলাম ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। প্রিয় বইয়ের তালিকায় নতুন সংযোজন হল। এই বই তে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবারের কথা বলা হয়েছে। যা ইন্দুবালার হাতের স্পর্শে যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। আমার মত ভোজন রসিক মানুষের জিবে জল আনার জন্য যা যথেস্ট।যদিও আমি আমড়া কাঠের ঢেকি তথাপি আমার জীবনসঙ্গী Rehana Sultana আমার সেই চাহিদা পূরণ করছেন শত ব্যস্ততার মধ্যে।তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে তার অবদান কে ছোট করতে চাই না।
বইয়ের আটটি অধ্যায়ের নামকরণও করা হয়েছে আট পদের খাবারের উপর। যেমন প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘কুমড়ো ফুলের বড়া’, দ্বিতীয় অধ্যায় ‘বিউলির ডাল’; এভাবেই একের পর এক অধ্যায় এগিয়ে গেছে। তবে এটা শুধুই নিছকই নামকরণ নয়। প্রতিটি খাবারের নামের সাথে সাথেই এগিয়েছে সেই খাবারের সাথে ইন্দুবালার স্মৃতি তথা তার জীবন কাহিনী।
বাবার বুদ্ধিতে কিংবা নির্বুদ্ধিতে খুলনার কলাপোতা গ্রাম ছেড়ে এক দোজবরে লোকের বউ হয়ে কলকাতায় আসে ইন্দুবালা। কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনের দোতলা বাড়িটাতে শুরু হয় তার যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনার জীবন। এর মাঝে আর ফেরেনি ইন্দুবালা কলকাতায় কিংবা ফিরতে পারেনি, অতঃপর আর ফিরতে চায়ওনি। তবে এই যন্ত্রণাময় জীবন বেশী দিন স্থায়ি হয়নি ইন্দুবালার, অল্পবয়সেই তাকে বিধবার বেশ ধরিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বুজেন স্বামী মাস্টার রতনলাল মল্লিক।
তিন সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় ইন্দুবালার নতুন জীবনের লড়াই। যেই লড়াইয়ে তাকে দাড় করিয়ে দিয়েছিলো তার নতুন সই মাছওয়ালী লছমী। লছমীর হাত ধরেই যাত্রা হয়েছিল ‘ইন্দুবালার ভাতের হোটেল’ এর। এরপর আর চল্লিশ বছরেও কপাট লাগেনি সেই হোটেলের। প্রতিদিন হোটেলের বাইরের কালো মেন্যু বোর্ডের মেন্যুর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় ইন্দুবালার স্মৃতির পাতাও। তার স্মৃতিতে সজীব হয়ে ওঠে – কলাপোতা বাড়ির দাওয়াখানা, বোসদের পুকুরপাড়, মনিরুলের বাড়ির উঠোন কিংবা কপোতাক্ষের ঘাট। ভেসে আসে মনিরুলের বাঁশির সুর, নকশীকাঁথার মাঠ। হ্যাঁ মনিরুল, বাবা, মা কিংবা ভাইয়ের আগেই যে মনিরুল কে হারিয়ে ফেলেছিল ইন্দুবালা। না হারায়নি ঠিক, মনিরুলই নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিল ইন্দুবালার জীবন থেকে নিজের ভালোবাসা মূল্য দিতে।
যে ঠাম্মির কাছ থেকে পাওয়া বিদ্যের জোড়েই এই ভাতের হোটেলের জয়জয়কার, সেই ঠাম্মিও মরার আগে ক’দিন ইন্দু,ইন্দু করে ঢলে পরেছিল মৃত্যু কূপে। ইন্দুকে আর দেখা হলো না তার। মা আর ভাই ও মরেছিল খান সেনাদের অগ্নিতান্ডবে। শুধু ছেনু মিত্তির লেনের পুরোনো বাড়িটার দেওয়াল আঁকড়ে ধরে পড়ে রইলেন ইন্দুবালা, একটুকরো ‘কলাপোতা গ্রাম’ হয়ে। ভালোবাসার মানুষদেরকে হারিয়ে বারে বারে একা হয়ে যাওয়া ইন্দুবালা শেষ পর্যন্ত একাকিত্ব কেই ভালোবেসে ফেললেন।
সন্তানদেরও দূরে ঠেলে দিলেন নিজের কাছ থেকে ছেনু মিত্তির লেনের মায়ায়। যেই লছমীকে দিয়ে এই ভাতের হোটেলের শুরু সেই লছিমীও হারিয়ে যায় নিয়তির ফাঁদে পড়ে। যতটা নিঃশব্দে সে এসেছিল ইন্দুবালার জীবনে,ততটা নিঃশব্দেই সে হারিয়ে যায় ইন্দুবালার জীবন থেকে। লছিমীকে কেও মনে রাখেনি। শুধু ভুলতে পারেনি ইন্দুবালার কোনদিন। তার হোটেলের অংশীদার হিসেবেই আজীবন বাচিঁয়ে রেখেছিল তার মানের মধ্যিখানে।
‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ এক অদ্ভুত মায়াময় উপাখ্যান। যেই উপাখ্যান খোলার শুরু থেকেই চোখের কোণে জমতে থাকা শিশিরকণা একেবারে শেষে এসে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ে ইন্দুবালার দীর্ঘশ্বাস গুলোর মতই।