নানা ইস্যু সামনে এনে মাঠ গরমের প্রকল্প

- আপডেট সময় : ০৫:১৫:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫ ৩৩ বার পড়া হয়েছে
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচের অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বসাধ্য চেষ্টায়ও কুলাল না। তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় শিশুটির, দু’বার স্থিতিশীল হলেও তৃতীয়বার হৃদস্পন্দন আর ফিরে আসেনি। টানা কয়েক দিন জীবন্মৃত থাকার পর দুপুরে মৃত্যুর কাছে হার মানল মাগুরায় ধর্ষিত আট বছরের শিশু আছিয়া। এ ঘটনায় শোক জানিয়ে আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। সন্তানের শোকে পাথর মায়ের কান্না যেন থামছেই না। যে ক্ষত নিয়ে ঢাকায় আসা, তা নিয়েই ফিরতে হয় তাকে।
মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাশবিকতার শিকার হয় শিশু আছিয়া। তাকে প্রথমে মাগুরা, পরে ফরিদপুর ও ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা দেয়া হয়। সবশেষ তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। শিশু আছিয়া ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা কারাগারে আছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গত ক’দিন ধরে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি।
ধর্ষণের মামলার বিচার সাত দিনের মধ্যে শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। একই সাথে শিশুধর্ষণ ও বলাৎকারের বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করতে আইন সংশোধন করা হবে। ধর্ষণের পর মৃত্যু বা হত্যার ঘটনা আগেও ঘটেছে বলে আছিয়ার মতো আরো ঘটনাও মেনে নিতে হবে বা এ নিয়ে বেশি কথায় না যাওয়ার জ্ঞান জাহির কাম্য নয়। আবার এ নিয়ে শাহবাগ বা কোথাও আবার মজমা বসানো, পুলিশকে উত্ত্যক্ত করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ দেয়ায়ও কাম্য নয়। ক’দিন ধরে সেই শঙ্কা দেখা দেয়ায় সচিবালয় ও শাহবাগসহ রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় সভা-সমাবেশ মিছিল নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি।
এ নিয়ে জারি করা গণবিজ্ঞপ্তিটির লাইনে লাইনে বিশ্লেষণযোগ্য অনেক তথ্য। এতে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ডিএমপি অধ্যাদেশের ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও পাশের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, শাহবাগ মোড়, কাকরাইল মোড় ও মিন্টো রোডে সব ধরনের সভা-সমাবেশ গণজমায়েত, মিছিল ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ থাকবে। কেন এমন নিষেধাজ্ঞার পর্বে যেতে হলো পুলিশকে? ছোট্ট এ প্রশ্নটির জবাব ছোট নয়।
কিছু দিন আগেও বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছিল। রমজানে বাজার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যেতে পারে, এ নিয়ে নানা শঙ্কা ঘুরছিল। অনেকটা ম্যাজিকের মতো সাফল্য পায় সরকার। ভোজ্যতেল আর চাল ছাড়া বাজার চলে আসে অনেকটা আয়ত্তে। বাজার পরিস্থিতি বেশ স্বস্তিদায়ক। একসময় পেঁয়াজের কেজি ২৫০-৩০০ টাকা ছিল, এখন ৪০-৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ মিলছে। সবজির দামও হাতের নাগালে। বাজার এভাবে স্থিতিশীল থাকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্বস্তি পাবে। এ সময়ে অর্থনীতির কিছু সুখবরও আছে। গত ছয় মাসে সরকার দেশী-বিদেশী ৬২ হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ করেছে। দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ লক্ষণীয় বেড়েছে। প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ৯টি দেশের ভিসা প্রসেসিং দিল্লির পরিবর্তে ঢাকায় চালু হয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের অ্যাকাউন্ট থেকেই উদ্ধার করেছে ৬৩৫ কোটি টাকা। দেশের খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।
গত ২২ মাসের তুলনায় সর্বনিম্ন মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে এই ফেব্রুয়ারিতে। অর্থ সেক্টরে এমন একটি স্বস্তির ঢেউয়ের মধ্যে মাগুরায় শিশু আছিয়া ধর্ষণকে ইস্যু করে আবার শাহবাগী মঞ্চ বসানোর আয়োজন। দৃশ্যপটে আবার সেই স্লোগানকন্যা লাকী। পুলিশের সাথে গায়ে পড়ে গণ্ডগোল পাকানো। এর বিপরীতে ইনকিলাব মঞ্চের প্রস্তুতি। তার ওপর বুঝে না বুঝে যোগ হয়েছে অনাকাক্সিক্ষত কথাবার্তা ও কাণ্ডকীর্তি। রোজা না রাখার অপরাধে হিন্দু হোটেল থেকে বের করে এনে একজনকে শাস্তি দেয়া। ওয়াজের নামে কয়েক বক্তার এলোপাতাড়ি বয়ান।
৫ আগস্টের পর থেকে ভারত সরকার আর ভারতীয় মিডিয়া লাগাতার প্রচার করে আসছে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে। দেশ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গি রাষ্ট্র। নারীদের ঘরে বন্দী করা হচ্ছে। তাদের কথা ও কাজ সেই প্রচারণায় ‘ঘি’ ঢালার মতো হয়েছে। ডানে-বামে আরো নানান বিভেদ-যন্ত্রণাও বাড়ছে।
ইসলামপন্থী দলগুলোর কোনো কোনোটির মধ্যে উতলা ভাব। বামেও গোলমাল। সিপিবির মধ্যে গ্যাঞ্জাম যাচ্ছে। তা দলটির অঙ্গ-সহযোগী গণসংগঠনগুলোর মধ্যেও। উদীচীতে ভাগ-বিভাজন যাচ্ছে। বিতর্কিত লাকী আক্তাররা পানি ঘোলার সুযোগ খুঁজছে। এদের ঘিরে একটি গ্রুপ মাঠে নামার প্রস্তুতি শেষ করেছে। খেলাটি বড় বিপজ্জনক। লাকীর জন্য, দেশের জন্যও। ধর্ষণবিরোধী পদযাত্রার নামে সেদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ অশনিসঙ্কেত। পুলিশ বলছে, ধর্ষণবিরোধী পদযাত্রার নামে নারী-পুরুষসহ ৬০-৭০ জনের একটি বিক্ষোভকারী দল প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা অভিমুখে যাত্রার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় ওই পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা নারীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। নিকটবর্তী স্থানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা ও যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরে যেতে অনুরোধ করলে তারা উল্টো পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে উদ্ধত ও মারমুখী আচরণ করে। খামচে আহত করে কয়েক পুলিশকে। এক পর্যায়ে তারা পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ওপর অতর্কিত ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায়।
এ সময় তাদের হামলায় রমনা জোনের সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মামুন আহত হন। এছাড়া হামলাকারীদের আঘাতে রমনা ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার মো: মাসুদ আলম, দুই নারী পুলিশ সদস্য এবং তিনজন পুরুষ কনস্টেবল আহত হন। পরবর্তীতে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গের মাধ্যমে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এই সরকারের বেশ কিছু ব্যর্থতা আছে সত্য। প্রধান ব্যর্থতা হলো কাউকে ম্যানেজ না করে চলা। আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে আগ্রহী ডিপ স্টেট এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের আধিপত্য কায়েমের আকাক্সক্ষাও আছে কারো কারো। কোনোটিকেই এই সরকার এখন অবধি প্রশ্রয় দেয়নি। সরকার টিকে আছে জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতায়। ড. ইউনূসকে গালি দেয়া বেশ সহজ। কিছুতে রাগ করেন না। সব হজম করেন। আবার নিজের গণসংযোগ নিজে করে না সরকার। গত কিছু দিনের বেশির ভাগ ধর্ষণ মামলার আসামি জেলে। সরকার ধরে ফেলেছে। আছিয়ার রেপিস্টদের অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেদিকে আলোকপাত না করে ধর্ষণকে ইস্যু করার আয়োজন চালানো হয়েছে। এমন নোংরা নীতি আর কাজ করবে না।
শুরু থেকেই আনলিমিটেড স্যাবোটাজের শিকার হয়েছে এ সরকার। বান্দরবান টু সাভার-গাজীপুর। ডেমরার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ থেকে পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী-কবি নজরুল কলেজ বা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ। নতুন ঢাকার তিতুমীর কলেজ অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজ। অটোরিকশা থেকে কাভার্ডভ্যান। পাহাড় থেকে সমতল, পাতাল আর হাসপাতাল গোটা দেশে পরতে পরতে বিরতিহীন স্যাবোটাজ। ভাব নমুনায় স্পষ্ট, এ সরকারকে এক দিনও শান্তিতে থাকতে না দেয়ার পাকা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অ্যাজেন্ডা চলমান। বিনা জামানত এবং বিনা সুদে ঋণ দেয়ার প্রলোভনে ফেলে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভাবী মানুষদের ঢাকায় এনে গণ্ডগোল পাকানোর অপচেষ্টা পর্যন্ত বাদ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপে এবারের যাত্রায় তা ভণ্ডুল হয়েছে।
শাহবাগে জড়ো করা হয় বিভিন্ন বয়সী কিছু নারী-পুরুষকে। অহিংস গণ-অভ্যুত্থান নামের ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় বাস-মাইক্রোবাসে আসতে থাকে মানুষ। বিচ্ছিন্নভাবে শাহবাগসহ আশপাশে অবস্থান নেয় তারা। বিনা সুদে এক লাখ টাকা করে ঋণ দেয়ার আশ্বাসে তাদের ঢাকায় আনা হয়। ধরে ধরে ইস্যু তৈরির এ নোংরা পথে যে যেদিক দিয়ে পারছে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। একটি বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র মেরামত অনিবার্য কাজ। নইলে অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হলো কেন? কোনটি মেরামত দরকার তা নাম ধরে ধরে বলার তো কোনো প্রয়োজন নেই! যেখানেই ত্রুটি সেখানেই মেরামত। অথচ সেই পথে পদে পদে বাধা। রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারীদের অপতৎপরতা যেন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। তাই ‘সারা দেশে একটি পরিকল্পিত নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে’। যারা যে দিক দিয়ে পারছেন তাদের মনমতো স্বাধীনতা কায়েম করে ফেলছেন। মন যা চায় করছেন, বলছেন-ঘটাচ্ছেন। যেন নানা আয়োজনেই নানা ইস্যুকে সামনে এনে মাঠ গরমের প্রকল্প। যার সবশেষ আইটেম কি আছিয়া!
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট