সুনামগঞ্জ ০৪:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ২৭ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

জাকাতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য

ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব
  • আপডেট সময় : ০৮:০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫ ৪০ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কারণ আল কুরআনে বলা হয়েছে ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের হক রয়েছে। সুতরাং ধনীদের কাছ থেকে সম্পদ নিয়ে তা তার প্রাপকদের কাছে পৌঁছানো মুসলিম সমাজের কর্তব্য। ইসলামের তৃতীয় মৌলিক স্তম্ভ হচ্ছে জাকাত। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জাকাত পরিশোধ করা ফরজ। মহান আল্লাহর বাণী হচ্ছে এই যে, জাকাত দিলে সম্পদ পবিত্র হয় এবং তা বৃদ্ধি পায়। আজকের নিবন্ধে জাকাতের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হবে।

প্রথমে ধর্মীয় দিকটি দেখা যাক। আল কুরআনে অন্তত ৩০টি স্থানে মহান আল্লাহ সালাত ও জাকাতের কথা এক সঙ্গে বলেছেন। এর দ্বারা জাকাতের গুরুত্ব সহজে অনুমেয়। কোনো কোনো ইসলামী চিন্তাবিদ মনে করেন, কোনো মুসলিম যদি শুধু সালাত আদায় করে, কিন্তু জাকাত না দেয় সে ক্ষেত্রে তার সালাত কবুল হবে না। আল কুরআন ও হাদিসে জাকাত না দেয়ার পরিণামে কী শাস্তি দেয়া হবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, জাকাতের রাজনৈতিক তাৎপর্য আল কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। সূরা হজের ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন ‘তাদের কর্তৃত্ব প্রদান করা হলে তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, ন্যায়ের আদেশ করে ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করে।’ মহান আল্লাহর এ নির্দেশনা একজন ব্যক্তি ও সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত যে পর্যায়ে যিনি ক্ষমতার অধিকারী তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাষ্ট্রক্ষমতার বিষয়টি রাজনৈতিক। সুতরাং রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকারী রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান তথা সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে ওই চারটি দায়িত্ব পালন করা। রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নৈতিকতা তথা শরিয়াহর মানদণ্ড সামনে রেখে বাজারব্যবস্থায় চাহিদা-সরবরাহ এবং আয় ও ব্যয়ের সীমারেখা নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারি দায়িত্বে যারা রয়েছে তারা যদি এ কাজ না করেন তাহলে আখিরাতে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। মহানবী সা: রাসূল হিসেবে মক্কায় ১৩ বছর অবস্থানকালে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন না। তখন জাকাতের বিধান নাজিলও হয়নি। কিন্তু মদিনায় হিজরতের পরে সেখানে একটি রাষ্ট্র কায়েমের পরে আল কুরআনের এ নির্দেশনাগুলো আসে। তিনি সঠিকভাবে তা পরিপালন করে আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সম্পদশালীদের কাছ থেকে জাকাত আদায় করতেন। সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে উল্লিখিত আট শ্রেণীর জাকাত প্রাপকদের মধ্যে তা বিতরণ করতেন।

রাসূল সা: মদিনার বাইরে দূর-দূরান্তে তাঁর প্রতিনিধি পাঠাতেন জাকাত আদায়ে এবং তা সে এলাকাতে বিতরণের নির্দেশ দিতেন। সাহাবি মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:-কে ইয়ামেনে গভর্নর নিয়োগ করে পাঠানোর সময় রাসূল সা: যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা জাকাত ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে আমাদের সামনে হাজির রয়েছে। প্রথম খলিফা আবু বকর রা:-এর সময় কিছু বিভ্রান্ত মুসলিম বায়তুল মালে জাকাত দিতে অস্বীকার করলে তিনি গর্জে ওঠেন। এবং ঘোষণা করেন, যারা জাকাত দিতে অস্বীকার করবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে। তার এ বৈপ্লবিক ঘোষণা মানব ইতিহাসে প্রথম, যেখানে একজন নেতা বঞ্চিত মানুষের অধিকার রক্ষায় যুদ্ধ করার অঙ্গীকার করেছেন। পৃথিবীতে বেশির ভাগ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সাম্রাজ্য ও সম্পদ লাভে। কিন্তু বঞ্চিত মানুষের অধিকার রক্ষায় যুদ্ধের ঘটনা বিরল। জাকাত কমিউনিস্ট ধারণামতের শ্রেণিসঙ্ঘাত পরিহারেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

তৃতীয়ত, জাকাত একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারে। আমরা লক্ষ করি, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বাজারব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি বিশেষত চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে অর্থনীতি পরিচালিত হয়। সেখানে ধনীরা পুঁজি খাটিয়ে সীমাহীন মুনাফা অর্জন করতে পারেন। এর লাগাম টেনে ধরতে রাষ্ট্র প্রগ্রেসিভ ট্যাক্স আরোপ করে থাকে। কিন্তু ট্যাক্সের বিনিময়ে সরকার দেশের ধনী-গরিব সব শ্রেণীর নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দরিদ্র ও বঞ্চিতদের জন্য ধনীদের সম্পদের তুলনায় অতি সামান্য অংশ ব্যয় করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে ধনীদের অতিরিক্ত সম্পদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ জাকাত হিসেবে জাকাত-প্রাপকদের (মুস্তাহিক) কাছে বাধ্যতামূলকভাবে হস্তান্তর করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ধনীদের কাছ থেকে এভাবে সম্পদ সংগ্রহের পদ্ধতি অন্য কোনো অর্থব্যবস্থায় দেখা যায় না। এভাবে সম্পদ মুস্তাহিকদের কাছে হস্তান্তর করা হলে বাজারে মুদ্রার সার্কুলেশন তথা আবর্তন বেড়ে যায় এবং বাজার সক্রিয় থাকে। মুস্তাহিকদের কাছে সম্পদ চলে যাওয়ায় তারা তা দিয়ে তার মৌলিক চাহিদা পূরণে ভোগ্যপণ্য ক্রয় এবং উপার্জনে তা বিনিয়োগ করতে পারে। এরূপ বিনিয়োগে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে যা দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। অন্যদিকে, দরিদ্র জনগোষ্ঠী অর্থের অভাবে সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে জাকাত একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সুদের মতো মহাপাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। ঋণ পরিশোধের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সব সরকার রাজস্ব আহরণে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা জারি রাখে। রাজস্বের নতুন উৎস অনুসন্ধান করতে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশী সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বৈদেশিক সাহায্য সব সময় পাওয়া যায় না। এর কোনো নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করা যায় না। কিন্তু জাকাত হচ্ছে, একটি প্রবহমান ঝরনাধারার মতো। প্রতি বছর তা আসবে। মুসলিম নাগরিকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে জাকাত সংগ্রহের পরিমাণও বাড়তে থাকে। সুতরাং জাকাত হচ্ছে একটি টেকসই রাজস্বের উৎস যা দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।

চতুর্থত, সামাজিক উন্নয়নের দৃষ্টিতে জাকাত হচ্ছে একটি সামাজিক বীমাব্যবস্থা (ইন্স্যুরেন্স)। আধুনিককালে বিভিন্ন দেশে যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করতে দেখা যায়, তার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। কিন্তু ইসলাম মানবেতিহাসের শুরু থেকে জাকাতের মাধ্যমে সামাজিক বীমার প্রচলন করে গেছে যদিও তা ‘বীমা’ নামে ছিল না।

আধুনিককালে যে অন্তর্ভুক্তি নীতির (ইনক্লুসিভনেস) কথা বলা হয়, তাও ইসলাম বহু আগে জাকাত ও অন্যান্য ইসলামিক সোশ্যাল ফাইন্যান্সের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে। ‘কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না’-এটি ইসলামের নীতি। জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) দারিদ্র্য-বিমোচন, ক্ষুধা নিবৃত্তি, নিরাপদ পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা তথা মৌলিক চাহিদাপূরণের উপর যে বিশেষ জোর দিয়েছে তার সাথে জাকাত তথা ইসলামী অর্থব্যবস্থার স্পিরিটের যথেষ্ট মিল রয়েছে। প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদাপূরণের লক্ষ্যে জাকাতব্যবস্থা কার্যকর থাকে; ফলে সমাজে একটি সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবেশ সৃষ্টি হয় যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে পারে।

পঞ্চমত, মানুষ স্বভাবত সম্পদের জন্য লোভী হয়ে থাকে। আবার কিছু লোক সম্পদ সঠিক পথে ব্যয় করার ব্যাপারে কৃপণতা করে থাকে। সম্পদ মানুষকে গর্বিত ও অহঙ্কারীও করে তোলে। জাকাত দিতে গিয়ে একজন ধনী ব্যক্তিকে সম্পদের লোভ ও কৃপণতা পরিহার করতে হয়। তিনি যদি নীরবে মানুষকে জাকাত বা সাদাকা দিতে থাকেন তাহলে তার মধ্যে বিনয় সৃষ্টি হয়। গর্ব ও অহঙ্কার দূর হয়। এভাবে একজন মুসলিম জাকাত দিয়ে নিজেকে আত্মিকভাবে পরিচ্ছন্ন করতে পারেন। সন্দেহ নেই, আত্মিকভাবে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি মহান আল্লাহর কাছে মুক্তি আশা করতে পারেন।

ষষ্ঠত, জাকাতের ব্যবস্থাপনাগত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। আর্থিক ব্যবস্থাপনা একটি জটিল কাজ। যেকোনো উদ্যোগ বা সিস্টেমে ব্যবস্থাপনার বিষয় বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। জাকাত বাস্তবে অর্থ বা সম্পদের একটি ব্যবস্থাপনার কাজ। কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে সম্পদ এনে তা আবার আরেক শ্রেণীর লোকদের কাছে বিতরণ ও হস্তান্তর করতে হয়। তাই জাকাতের সঠিক হিসাব ব্যবস্থাপনা, বিতরণ পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ইত্যাদি কাজগুলো উৎকর্ষতার সাথে সম্পাদন করা এবং সাথে সাথে আবার শরিয়াহর অনুসৃতি নিশ্চিত করা অপরিহার্য শর্ত। এ জন্য প্রয়োজন জাকাতের বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তি।

মহান আল্লাহ আল কুরআনের সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে যে আটটি খাতে জাকাত বিতরণের কথা বলেছেন; তার তৃতীয়টি জাকাত কর্মচারীদের জন্য ব্যয় তথা ব্যাপক অর্থে পরিচালন ব্যয়। তিন নম্বরে এ খাতের কথা বলে মহান আল্লøাহ একদিকে এর গুরুত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং অন্যদিকে, জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা দিয়েছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে স্বল্প পরিমাণের জাকাত নিকট আত্মীয় বা প্রতিবেশীর মধ্যে বিতরণ করা কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু জাকাতের পরিমাণ যদি কোটি কোটি টাকা হয়, হাজার হাজার মানুষ তার সাথে সম্পৃক্ত থাকেন এবং সামষ্টিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত ব্যবস্থাপনা করতে হয়; তাহলে একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, এর জন্য উপযুক্ত জনবল, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ইত্যাদি প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে পরিচালন ব্যয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দেবে। আল্লাহ সে জন্য জাকাত ব্যবস্থাপনার খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। জাকাত বিতরণ খাতের তৃতীয়টি হচ্ছে ‘আমিলিন’ অর্থাৎ জাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারী। (আধুনিককালের ‘আমলা’ শব্দটির সাথে সাযুজ্য দেখা যায়) রাসূল সা:-এর যুগে সাহাবিদের মধ্যে যাদের এ দায়িত দেয়া হতো তারা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ও বিশ্বস্ত বলে পরিচিত ছিলেন। জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের কাজে কর্মচারী নিয়োগের সিদ্ধান্তটি কোনো ব্যক্তি নিতে পারেন না। সব ইসলামী পণ্ডিত এ বিষয়ে একমত, রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ব্যতীত জাকাত কর্মচারী নিয়োগ করা এবং তাদের বেতন-ভাতা জাকাত থেকে দেয়া যাবে না। বস্তুত সরকার কর্তৃক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাকাত ব্যবস্থাপনার কাজটি করা উত্তম এবং সেটি রাসূল সা:-এর সুন্নাহ। তবে যদি কোনো সরকার নিজ উদ্যোগে আইনের আওতায় জাকাত ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলে সে ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে সামষ্টিক উদ্যোগে জাকাত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। অবশ্য সে ক্ষেত্রে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় অনুমোদন নিয়ে সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর সেরূপ সংস্থার অবশ্যই সাংগঠনিক কাঠামো, বিধিবিধান, উপযুক্ত জনবল, শরিয়াহ তত্ত্বাবধান, নিরীক্ষা, মনিটরিং এবং সার্বিকভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্ন আসবে, এরূপ সংস্থা পরিচালনায় যে ব্যয় হবে তা কিভাবে নির্বাহ করা হবে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার ফিকাহ কাউন্সিলের মতে, সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ পরিচালন ব্যয় হিসেবে জাকাত থেকে দেয়া যেতে পারে। স্মরণযোগ্য, জাকাত ব্যবস্থাপনা অধিকতর দক্ষতা ও কার্যকারিতার সাথে সম্পাদনের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করা বেশ যুক্তিসঙ্গত।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার, ইসলামের শিক্ষা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী জাকাত ব্যবস্থাপনার কাজটি মূলত সরকারের। কোনো সরকার যদি তা না করে তাহলে সামষ্টিক উদ্যোগে আইনসিদ্ধ জাকাত সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। এরূপ করা হলে জাকাতের সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা যথাযথভাবে সমাজে প্রতিফলিত হবে। একজন জাকাতদাতা তার জাকাত সরকার বা উপযুক্ত সংস্থার মাধ্যমে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করলে সেটি অধিকতর কার্যকর হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে একটি জাকাত আইন রয়েছে। সরকারিভাবে জাকাত বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সেখানে জাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক নয়; বরং স্বেচ্ছামূলক। তবে সেখানে জাকাত দিলে একজন জাকাতদাতা ১৫ শতাংশ ট্যাক্স রিবেট পেতে পারেন। সরকার সম্প্রতি বেসরকারি জাকাত প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টকেও একই সুবিধা দিয়েছে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে সরকার আইন প্রণয়ন করে জাকাত প্রদানকে বাধ্যতামূলক করবে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি উদ্যোগে জাকাত আদায় করা হয়। আবার কোনো কোনো দেশে সরকার কিছু জাকাত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানকে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে নিবন্ধন দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া এক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। বাংলাদেশে প্রচুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা রয়েছে যারা প্রধানত জাকাত-সাদাকার ওপর নির্ভরশীল। এর মাধ্যমে প্রচুর অসহায় শিশু, নারী-পুরুষ বেঁচে থাকতে সহায়তা পাচ্ছে। কিন্তু এসব জাকাত ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের জাকাত তহবিল ব্যবহারে শরিয়াহর বিধান অনুসরণ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার।

সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকা জাকাত আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাত আদায় সংগ্রহ ও বিতরণ করা হয় না বিধায় বর্তমানে কত সংখ্যক লোক কত টাকা জাকাত দিচ্ছে তার কোনো পরিসংখ্যান কারো জানা নেই। জাকাতের মতো একটি দারুণ সম্ভাবনাময় তহবিলের সুযোগ দেশে থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন এর প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয় না; তা বিস্ময়কর বটে। আমরা আশা করব, সরকার আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে জাকাত আদায় করবে, এ জন্য জাকাত বোর্ডকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবে। সেই সাথে বেসরকারি খাতের জাকাত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজে লাগিয়ে জাকাতকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব

ayubmiah@gmail.com

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

জাকাতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য

আপডেট সময় : ০৮:০৪:২৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫

মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কারণ আল কুরআনে বলা হয়েছে ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের হক রয়েছে। সুতরাং ধনীদের কাছ থেকে সম্পদ নিয়ে তা তার প্রাপকদের কাছে পৌঁছানো মুসলিম সমাজের কর্তব্য। ইসলামের তৃতীয় মৌলিক স্তম্ভ হচ্ছে জাকাত। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জাকাত পরিশোধ করা ফরজ। মহান আল্লাহর বাণী হচ্ছে এই যে, জাকাত দিলে সম্পদ পবিত্র হয় এবং তা বৃদ্ধি পায়। আজকের নিবন্ধে জাকাতের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হবে।

প্রথমে ধর্মীয় দিকটি দেখা যাক। আল কুরআনে অন্তত ৩০টি স্থানে মহান আল্লাহ সালাত ও জাকাতের কথা এক সঙ্গে বলেছেন। এর দ্বারা জাকাতের গুরুত্ব সহজে অনুমেয়। কোনো কোনো ইসলামী চিন্তাবিদ মনে করেন, কোনো মুসলিম যদি শুধু সালাত আদায় করে, কিন্তু জাকাত না দেয় সে ক্ষেত্রে তার সালাত কবুল হবে না। আল কুরআন ও হাদিসে জাকাত না দেয়ার পরিণামে কী শাস্তি দেয়া হবে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, জাকাতের রাজনৈতিক তাৎপর্য আল কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। সূরা হজের ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন ‘তাদের কর্তৃত্ব প্রদান করা হলে তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, ন্যায়ের আদেশ করে ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করে।’ মহান আল্লাহর এ নির্দেশনা একজন ব্যক্তি ও সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত যে পর্যায়ে যিনি ক্ষমতার অধিকারী তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাষ্ট্রক্ষমতার বিষয়টি রাজনৈতিক। সুতরাং রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকারী রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান তথা সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে ওই চারটি দায়িত্ব পালন করা। রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নৈতিকতা তথা শরিয়াহর মানদণ্ড সামনে রেখে বাজারব্যবস্থায় চাহিদা-সরবরাহ এবং আয় ও ব্যয়ের সীমারেখা নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারি দায়িত্বে যারা রয়েছে তারা যদি এ কাজ না করেন তাহলে আখিরাতে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। মহানবী সা: রাসূল হিসেবে মক্কায় ১৩ বছর অবস্থানকালে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন না। তখন জাকাতের বিধান নাজিলও হয়নি। কিন্তু মদিনায় হিজরতের পরে সেখানে একটি রাষ্ট্র কায়েমের পরে আল কুরআনের এ নির্দেশনাগুলো আসে। তিনি সঠিকভাবে তা পরিপালন করে আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সম্পদশালীদের কাছ থেকে জাকাত আদায় করতেন। সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে উল্লিখিত আট শ্রেণীর জাকাত প্রাপকদের মধ্যে তা বিতরণ করতেন।

রাসূল সা: মদিনার বাইরে দূর-দূরান্তে তাঁর প্রতিনিধি পাঠাতেন জাকাত আদায়ে এবং তা সে এলাকাতে বিতরণের নির্দেশ দিতেন। সাহাবি মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:-কে ইয়ামেনে গভর্নর নিয়োগ করে পাঠানোর সময় রাসূল সা: যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা জাকাত ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে আমাদের সামনে হাজির রয়েছে। প্রথম খলিফা আবু বকর রা:-এর সময় কিছু বিভ্রান্ত মুসলিম বায়তুল মালে জাকাত দিতে অস্বীকার করলে তিনি গর্জে ওঠেন। এবং ঘোষণা করেন, যারা জাকাত দিতে অস্বীকার করবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে। তার এ বৈপ্লবিক ঘোষণা মানব ইতিহাসে প্রথম, যেখানে একজন নেতা বঞ্চিত মানুষের অধিকার রক্ষায় যুদ্ধ করার অঙ্গীকার করেছেন। পৃথিবীতে বেশির ভাগ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সাম্রাজ্য ও সম্পদ লাভে। কিন্তু বঞ্চিত মানুষের অধিকার রক্ষায় যুদ্ধের ঘটনা বিরল। জাকাত কমিউনিস্ট ধারণামতের শ্রেণিসঙ্ঘাত পরিহারেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

তৃতীয়ত, জাকাত একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারে। আমরা লক্ষ করি, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বাজারব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি বিশেষত চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে অর্থনীতি পরিচালিত হয়। সেখানে ধনীরা পুঁজি খাটিয়ে সীমাহীন মুনাফা অর্জন করতে পারেন। এর লাগাম টেনে ধরতে রাষ্ট্র প্রগ্রেসিভ ট্যাক্স আরোপ করে থাকে। কিন্তু ট্যাক্সের বিনিময়ে সরকার দেশের ধনী-গরিব সব শ্রেণীর নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দরিদ্র ও বঞ্চিতদের জন্য ধনীদের সম্পদের তুলনায় অতি সামান্য অংশ ব্যয় করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে ধনীদের অতিরিক্ত সম্পদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ জাকাত হিসেবে জাকাত-প্রাপকদের (মুস্তাহিক) কাছে বাধ্যতামূলকভাবে হস্তান্তর করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ধনীদের কাছ থেকে এভাবে সম্পদ সংগ্রহের পদ্ধতি অন্য কোনো অর্থব্যবস্থায় দেখা যায় না। এভাবে সম্পদ মুস্তাহিকদের কাছে হস্তান্তর করা হলে বাজারে মুদ্রার সার্কুলেশন তথা আবর্তন বেড়ে যায় এবং বাজার সক্রিয় থাকে। মুস্তাহিকদের কাছে সম্পদ চলে যাওয়ায় তারা তা দিয়ে তার মৌলিক চাহিদা পূরণে ভোগ্যপণ্য ক্রয় এবং উপার্জনে তা বিনিয়োগ করতে পারে। এরূপ বিনিয়োগে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে যা দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। অন্যদিকে, দরিদ্র জনগোষ্ঠী অর্থের অভাবে সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে জাকাত একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সুদের মতো মহাপাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। ঋণ পরিশোধের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সব সরকার রাজস্ব আহরণে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা জারি রাখে। রাজস্বের নতুন উৎস অনুসন্ধান করতে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশী সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বৈদেশিক সাহায্য সব সময় পাওয়া যায় না। এর কোনো নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করা যায় না। কিন্তু জাকাত হচ্ছে, একটি প্রবহমান ঝরনাধারার মতো। প্রতি বছর তা আসবে। মুসলিম নাগরিকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে জাকাত সংগ্রহের পরিমাণও বাড়তে থাকে। সুতরাং জাকাত হচ্ছে একটি টেকসই রাজস্বের উৎস যা দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।

চতুর্থত, সামাজিক উন্নয়নের দৃষ্টিতে জাকাত হচ্ছে একটি সামাজিক বীমাব্যবস্থা (ইন্স্যুরেন্স)। আধুনিককালে বিভিন্ন দেশে যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করতে দেখা যায়, তার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। কিন্তু ইসলাম মানবেতিহাসের শুরু থেকে জাকাতের মাধ্যমে সামাজিক বীমার প্রচলন করে গেছে যদিও তা ‘বীমা’ নামে ছিল না।

আধুনিককালে যে অন্তর্ভুক্তি নীতির (ইনক্লুসিভনেস) কথা বলা হয়, তাও ইসলাম বহু আগে জাকাত ও অন্যান্য ইসলামিক সোশ্যাল ফাইন্যান্সের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে। ‘কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না’-এটি ইসলামের নীতি। জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) দারিদ্র্য-বিমোচন, ক্ষুধা নিবৃত্তি, নিরাপদ পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা তথা মৌলিক চাহিদাপূরণের উপর যে বিশেষ জোর দিয়েছে তার সাথে জাকাত তথা ইসলামী অর্থব্যবস্থার স্পিরিটের যথেষ্ট মিল রয়েছে। প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদাপূরণের লক্ষ্যে জাকাতব্যবস্থা কার্যকর থাকে; ফলে সমাজে একটি সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবেশ সৃষ্টি হয় যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে পারে।

পঞ্চমত, মানুষ স্বভাবত সম্পদের জন্য লোভী হয়ে থাকে। আবার কিছু লোক সম্পদ সঠিক পথে ব্যয় করার ব্যাপারে কৃপণতা করে থাকে। সম্পদ মানুষকে গর্বিত ও অহঙ্কারীও করে তোলে। জাকাত দিতে গিয়ে একজন ধনী ব্যক্তিকে সম্পদের লোভ ও কৃপণতা পরিহার করতে হয়। তিনি যদি নীরবে মানুষকে জাকাত বা সাদাকা দিতে থাকেন তাহলে তার মধ্যে বিনয় সৃষ্টি হয়। গর্ব ও অহঙ্কার দূর হয়। এভাবে একজন মুসলিম জাকাত দিয়ে নিজেকে আত্মিকভাবে পরিচ্ছন্ন করতে পারেন। সন্দেহ নেই, আত্মিকভাবে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি মহান আল্লাহর কাছে মুক্তি আশা করতে পারেন।

ষষ্ঠত, জাকাতের ব্যবস্থাপনাগত বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। আর্থিক ব্যবস্থাপনা একটি জটিল কাজ। যেকোনো উদ্যোগ বা সিস্টেমে ব্যবস্থাপনার বিষয় বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। জাকাত বাস্তবে অর্থ বা সম্পদের একটি ব্যবস্থাপনার কাজ। কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে সম্পদ এনে তা আবার আরেক শ্রেণীর লোকদের কাছে বিতরণ ও হস্তান্তর করতে হয়। তাই জাকাতের সঠিক হিসাব ব্যবস্থাপনা, বিতরণ পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ইত্যাদি কাজগুলো উৎকর্ষতার সাথে সম্পাদন করা এবং সাথে সাথে আবার শরিয়াহর অনুসৃতি নিশ্চিত করা অপরিহার্য শর্ত। এ জন্য প্রয়োজন জাকাতের বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তি।

মহান আল্লাহ আল কুরআনের সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে যে আটটি খাতে জাকাত বিতরণের কথা বলেছেন; তার তৃতীয়টি জাকাত কর্মচারীদের জন্য ব্যয় তথা ব্যাপক অর্থে পরিচালন ব্যয়। তিন নম্বরে এ খাতের কথা বলে মহান আল্লøাহ একদিকে এর গুরুত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং অন্যদিকে, জাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা দিয়েছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে স্বল্প পরিমাণের জাকাত নিকট আত্মীয় বা প্রতিবেশীর মধ্যে বিতরণ করা কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু জাকাতের পরিমাণ যদি কোটি কোটি টাকা হয়, হাজার হাজার মানুষ তার সাথে সম্পৃক্ত থাকেন এবং সামষ্টিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত ব্যবস্থাপনা করতে হয়; তাহলে একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, এর জন্য উপযুক্ত জনবল, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ইত্যাদি প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে পরিচালন ব্যয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দেবে। আল্লাহ সে জন্য জাকাত ব্যবস্থাপনার খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। জাকাত বিতরণ খাতের তৃতীয়টি হচ্ছে ‘আমিলিন’ অর্থাৎ জাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারী। (আধুনিককালের ‘আমলা’ শব্দটির সাথে সাযুজ্য দেখা যায়) রাসূল সা:-এর যুগে সাহাবিদের মধ্যে যাদের এ দায়িত দেয়া হতো তারা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ও বিশ্বস্ত বলে পরিচিত ছিলেন। জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের কাজে কর্মচারী নিয়োগের সিদ্ধান্তটি কোনো ব্যক্তি নিতে পারেন না। সব ইসলামী পণ্ডিত এ বিষয়ে একমত, রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ব্যতীত জাকাত কর্মচারী নিয়োগ করা এবং তাদের বেতন-ভাতা জাকাত থেকে দেয়া যাবে না। বস্তুত সরকার কর্তৃক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জাকাত ব্যবস্থাপনার কাজটি করা উত্তম এবং সেটি রাসূল সা:-এর সুন্নাহ। তবে যদি কোনো সরকার নিজ উদ্যোগে আইনের আওতায় জাকাত ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলে সে ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে সামষ্টিক উদ্যোগে জাকাত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। অবশ্য সে ক্ষেত্রে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় অনুমোদন নিয়ে সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর সেরূপ সংস্থার অবশ্যই সাংগঠনিক কাঠামো, বিধিবিধান, উপযুক্ত জনবল, শরিয়াহ তত্ত্বাবধান, নিরীক্ষা, মনিটরিং এবং সার্বিকভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্ন আসবে, এরূপ সংস্থা পরিচালনায় যে ব্যয় হবে তা কিভাবে নির্বাহ করা হবে। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার ফিকাহ কাউন্সিলের মতে, সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ পরিচালন ব্যয় হিসেবে জাকাত থেকে দেয়া যেতে পারে। স্মরণযোগ্য, জাকাত ব্যবস্থাপনা অধিকতর দক্ষতা ও কার্যকারিতার সাথে সম্পাদনের জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করা বেশ যুক্তিসঙ্গত।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার, ইসলামের শিক্ষা ও ঐতিহ্য অনুযায়ী জাকাত ব্যবস্থাপনার কাজটি মূলত সরকারের। কোনো সরকার যদি তা না করে তাহলে সামষ্টিক উদ্যোগে আইনসিদ্ধ জাকাত সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। এরূপ করা হলে জাকাতের সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা যথাযথভাবে সমাজে প্রতিফলিত হবে। একজন জাকাতদাতা তার জাকাত সরকার বা উপযুক্ত সংস্থার মাধ্যমে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করলে সেটি অধিকতর কার্যকর হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে একটি জাকাত আইন রয়েছে। সরকারিভাবে জাকাত বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সেখানে জাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক নয়; বরং স্বেচ্ছামূলক। তবে সেখানে জাকাত দিলে একজন জাকাতদাতা ১৫ শতাংশ ট্যাক্স রিবেট পেতে পারেন। সরকার সম্প্রতি বেসরকারি জাকাত প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টকেও একই সুবিধা দিয়েছে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে সরকার আইন প্রণয়ন করে জাকাত প্রদানকে বাধ্যতামূলক করবে। বিভিন্ন মুসলিম দেশে আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি উদ্যোগে জাকাত আদায় করা হয়। আবার কোনো কোনো দেশে সরকার কিছু জাকাত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানকে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে নিবন্ধন দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া এক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। বাংলাদেশে প্রচুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা রয়েছে যারা প্রধানত জাকাত-সাদাকার ওপর নির্ভরশীল। এর মাধ্যমে প্রচুর অসহায় শিশু, নারী-পুরুষ বেঁচে থাকতে সহায়তা পাচ্ছে। কিন্তু এসব জাকাত ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের জাকাত তহবিল ব্যবহারে শরিয়াহর বিধান অনুসরণ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার।

সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকা জাকাত আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাত আদায় সংগ্রহ ও বিতরণ করা হয় না বিধায় বর্তমানে কত সংখ্যক লোক কত টাকা জাকাত দিচ্ছে তার কোনো পরিসংখ্যান কারো জানা নেই। জাকাতের মতো একটি দারুণ সম্ভাবনাময় তহবিলের সুযোগ দেশে থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন এর প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয় না; তা বিস্ময়কর বটে। আমরা আশা করব, সরকার আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে জাকাত আদায় করবে, এ জন্য জাকাত বোর্ডকে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবে। সেই সাথে বেসরকারি খাতের জাকাত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজে লাগিয়ে জাকাতকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব

ayubmiah@gmail.com