সুনামগঞ্জ ০৪:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ২৭ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

শিবিরের রক্ত যে অপবিত্র, আমি আজকের আগে জানতাম না

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৮:১৩:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫ ৫২ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

১.
শিবিরের রক্ত যে অপবিত্র, আমি আজকের আগে জানতাম না।

জানতাম না, ২০১৩ তে এসেও কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে। নতুন মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে না। ঠিকমতো শিবির পেটালেই চলবে।

জানলাম, যখন মারের এক পর্যায়ে আমার বাম পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসলো। রক্তে ভেসে গেল বিপ্লবের রুমের ফ্লোর।

বিপ্লব হায় হায় করে উঠলো। আহারে, শিবিরের রক্তে আমার রুমটা অপবিত্র হয়ে গেল।

আমার শরীর আর নিতে পারলো না। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাবার ক্যান্সার, মায়ের মুখ, এরপর নিকষ কালো অন্ধকার। আমি জ্ঞান হারালাম।

কিন্তু এই অন্ধকারের চেয়েও গহিন এক অন্ধকারে তখন ছেয়ে গেছে সারাদেশ। সেই অন্ধকারের নাম শাহবাগ।

২.
বড় ফ্যামিলিতে জন্ম। ১১ ভাই বোনের মধ্যে ১০ম হওয়ার জন্যই বোধহয় পড়াশোনা করে অনেককিছু করে ফেলতে হবে, এমন প্রেশার আমার উপর কখনোই ছিলো না।

আদরের ভাগ বেশি। প্রেশারের ভাগ কম। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ার এই এক আরাম।

মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল বাবা আর হাউজওয়াইফ মায়ের ইচ্ছা ছিলো আলেম হবো। আমারও তাই মনে হতো। তা’মিরুল মিল্লাত থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার সময়েও আমার জেনারেল লাইনে পড়ার ইচ্ছা ছিলো না।

তবে আমার বন্ধু বান্ধবদের অনেকেরই ছিলো।

ওরা পরীক্ষার পরেই ইউনিভার্সিটি কোচিং এ ভর্তি হয়ে গেল। সামাজিক চাপ একটা বিশাল ব্যাপার। বিশেষ করে বন্ধুরা কোচিং করে আর আমি ঘরে বসে থাকবো, এই লজ্জা কোথায় রাখি?

তাই আমিও ওদের সাথে ফোকাসে ভর্তি হই। ওদের লক্ষ্য? লেখাপড়া। আর আমার? টাইমপাস করা।

তখনও জানতাম না, এই টাইম পাসের সিদ্ধান্ত ঘুরিয়ে দিতে চলেছে আমার জীবনের মোড়!!

৩.
কোচিং মাত্রই বিরক্তিকর। কোচিং এর বক্তৃতা আরো বেশি বিরক্তিকর। অনিচ্ছা নিয়েই শুনতে শুরু করেছিলাম।

বক্তার নাম মির্জা গালিব। বর্তমানে হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। এর বাইরে ভদ্রলোকের আরো একটা পরিচয় আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি। ঐ হিসেবে উনি আমাদের কাছে গালিব ভাই।

গালিব ভাইয়ের বক্তৃতা শুরু হওয়ার পর আমি হারিয়ে গেলাম। একটা মানুষের কথাও এতো শক্তিশালী হয়? চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে পারে? চুম্বক তো লোহার দিক পরিবর্তন করে দেয়। মির্জা গালিব ভাই বক্তব্য দিলেন। পৃথিবীর কোন এক কোণে পাখা ঝাপটালো একটা প্রজাপতি। সেই প্রজাপতির ডানা এসে পাল্টে দিলো আমার জীবনের গন্তব্য। আরামে টাইম পাস করা কোচিং তখন আমার কাছে পরিণত হলো এক যুদ্ধক্ষেত্রে।

দেড় মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম আর আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে সেই যুদ্ধে আমি জিতে গেলাম। ঢাকা ইউনিভার্সিটির খ ইউনিট। ৪র্থ স্থান।

আমার স্বপ্নের জীবন শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে।

৪.
দেশের সেরা ইউনিভার্সিটির টপ ১০ এ চান্স পাওয়া ছেলেমেয়ের জীবন বাকিদের চেয়ে কিছুটা আলাদা হয়।

সেই আলাদা জীবন আমি পুরোপুরি উপভোগ করতে শুরু করলাম। সবার তো স্বপ্ন থাকে আগে থেকেই। আর আমি বাস্তবতাকেই স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর করে পেয়ে গেলাম । আজ এখানে সংবর্ধনা, কাল ওখানে। মনে হচ্ছিলো সেই গান, আমার মতো এতো সুখী, নয়তো কারো জীবন, কী আদর স্নেহ ভালোবাসায়, জড়ানো মায়ার ভুবন…..

মায়ার সৃষ্টি আছে। ধ্বংসও আছে, জানতাম। তবে সেই ধ্বংস এতোটা ভীষণ হবে, কল্পনাও করিনি। ২০০৮ এর শুকতারা ২০১৩ তে এসে পরিণত হলো ধ্বংস তারাতে!!

৫.
২০১৩ সালের ৫ ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগে স্লোগান উঠলো, একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর।

আপনারা মিডলক্লাস খুব সম্ভবত এখনও মনে করেন, স্লোগানগুলো কেবলই স্লোগান ছিলো। এতো ভয় পাওয়ার কী আছে?

কিন্তু আমরা যারা আসলেই শিবির করি, আমরা জানতাম, ২০১৩ র ৫ ই ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমরা আমাদের বাঁচার অধিকার হারিয়েছি। ঐ দিন থেকে এই দেশে আমরা আর মানুষ ছিলাম না, ছিলাম শিবির নামের এক প্রাণী। যাকে একটা একটা ধরে জবাই করা যায়, পুলিশ, প্রশাসন বা মানুষ কিছু বলে না।

২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ঐদিন আমার মানে ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস টেস্ট ছিলো। টেস্ট শেষ করে হলে আসার সময় মুহসীন হল মাঠ পার হচ্ছি। হঠাৎই দেওয়ান তুষারের ফোন। জানতে চাইলো আমি কোথায় আছি? বললাম। এরপর সে বললো হল গেটে দাঁড়া। তোর সাথে কথা আছে।

আমি হল গেটের দিকে আগাতে থাকি।

তুষার দেওয়ান আমার ইয়ারমেট। এক এলাকার। বেশ ভালো সম্পর্কই ছিলো বলতে হবে। (বর্তমানে সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক)।

কিন্তু হল গেটের কাছে এসে বুঝলাম তুষার একা না। বরং ওর সাথে মাহী গ্রুপের রিপন, মেহেদিসহ বেশ কয়েকজন গেটের দিকে আসছে। গতি অস্বাভাবিক বেশি। আমার মনে তখন সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আমার আর পেছানোর পথ নাই।

সুযোগও ছিলো না। কিছু ভাবার আগেই রিপন কাধে শক্ত করে হাত দিয়ে বললো, চল। আমি যন্ত্রচালিত রোবটের মতো চলতে শুরু করলাম। কোথায়, জানি না। প্রতিবাদ করিনি। করে লাভও হতো না।

রিপন তখনও আমার কাঁধ ধরে আছে। নড়াচড়ার কোন সুযোগ নাই। মাহি গ্রুপের দ্বিতীয় প্রভাবশালী নেতা ছিলো রিপন, ওর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন সুযোগ আমার সামনে ছিলো না। দলে আরো ছিলো দুইজন তুষার। একজন সিনিয়র। আর ছিলো বিপ্লব এবং মেহেদি। এই গ্রুপটা এমনিই কুখ্যাত ছিলো, তবে ওদের মধ্যেও সবচেয়ে কুখ্যাত ছাত্রলীগার ছিলো মেহেদি।

ছাত্রলীগ নাম হলেও ছাত্র বা লেখাপড়ার সাথে মেহেদির সম্পর্ক কমই ছিলো। সে মূলত করতো ইয়াবা আর গাজর ব্যবসা। করতো বলছি কেন, এখনও করে। এর নামে মামলার সংখ্যা অসংখ্য।

এই মেহেদীই প্রথমে আমাদের শিবিরের এক ছোটভাই নকিকে শনাক্ত করে। ওর উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হল শাখা সভাপতি রাকিব ভাই আর সেক্রেটারি আমার নাম বের করে।

সেখান থেকেই আমাকে গেটে আসতে বলা এবং “আটক” করা। শিবির ধরা তখন পাখি শিকারের মতোই পৈশাচিক আনন্দের বিষয় কি না!!

৬.
হল গেট থেকে আমাকে নেওয়া হলো বিপ্লবের রুম, ৪৬২ নাম্বার রুমে।

আমি ততক্ষণে দোয়া পড়ে নিজেকে নিজের পরিণতির ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। কিন্তু রুমে ঢুকেই রাকিব ভাই আর নকির বিধ্বস্ত চেহারা আমার বুকে গিয়ে আঘাত করে। না জানি কত নির্যাতন করলে মানুষের অবস্থা এতোটা বিধ্বস্ত হয়! আমার আগেই ওদের দুজনকে ধরে এনে নির্যাতন করা হচ্ছে এ রুমে যা আমি জানতাম না।

রুমে ঢুকার সাথে সাথে আমার ফোন কেড়ে নিয়ে চেক করা শুরু হয়। ফোনে কিছু না পেয়ে তুষার বলে, এরা শেয়ানা মাল। ফোনে কিছু রাখে নাই।

তুষার বলেছে, এরা।

বুঝলাম, রাকিব ভাইয়ের ফোনেও কিছু পায় নাই। একটু সাহস আসলো।

কিন্তু এরপর জিজ্ঞাসাবাদের সাথে সাথে শুরু হলো এলোপাথাড়ি চড়,থাপ্পড় আর লাত্থি। অসহায় হয়ে পড়লাম। সিনিয়র তুষার, বিপ্লব আর রিপন আমার উপর চড়াও হলো সবচেয়ে বেশি। মেহেদী, তুষার আর জাহিদও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। গায়ে হাত তুলেছে, সাথে গালিগালাজ তো আছেই।

তবে ভয় হাতের ছিলো না। ভয়ের ব্যাপার ছিলো, ওদের সবার কাছেই রামদা, চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ছিলো। আমার মনে তখন একটাই প্রশ্ন, হাত দিয়েই চ্যাপ্টার শেষ হবে নাকি অস্ত্রও ব্যবহার করবে?

আমার প্রশ্নের একসাথে উত্তর দিলো তিনজন।

বিপ্লব হাতে তুলে নিলো মোটা রড। তুষারের হাতে চিকন রড।

দুইজনই আমার পায়ে আঘাত করতে শুরু করলো।

এদের সাথে যোগ হলো রিপন। বাট রিপন মারার সাথে সাথে ছোট ছোট পোচ দিচ্ছিলো। যাতে আমরা আমাদের শিবির সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করি। আর হল কমিটিতর পোলাপাইনের নাম বলে দিই।

তবে তাদের এই আশা পূরণ হয়নি। আমার মুখ থেকে ওরা একটা কথাও বের করতে পারেনি।

এই বের করতে না পেরে ওরা আরো পাগল হয়ে গেল। এলোপাথাড়ি বাড়ি দিতে শুরু করলো। রিপন চিৎকার করে হুমকি দিলো, এদের নিয়ে শাহবাগে ছাইড়া দে। সবাই কুকুরের মতো খাবলাইয়া খাইবো। আর আমরা হবো নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।

বুঝলাম, শাহবাগে শিবির খাবলাইয়া খাওয়া হয়। বুঝলাম, শিবির খাইতে পারলেই তাকে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা বলে।

কখনও আমি, কখনও বা রাকিব ভাই। নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকি, আমিও যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়তে থাকি। আমার চোখে ভেসে উঠে, ক্যান্সার আক্রান্ত বাবা, আমি ডাকি বাবা, বাবা। বাবার মুখ হাওয়াতে মিলিয়ে যায়, হ্যালুসিনেশান নাকি?

বাবা মিলিয়ে যাওয়ার পর দেখি রক্ত। আমার বাম পা দিয় রক্ত পড়তে শুরু করেছে।

বিপ্লব হায় হায় করে উঠে, শিবিরের রক্তে আমার ঘরটা অপবিত্র হয়ে গেল।

আমার চোখ বুজে আসে। অন্ধকার হয়ে উঠে চারপাশ। শাহবাগে কি এখনও স্লোগান হচ্ছে? একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর…..

আমি জ্ঞান হারাই।

এবং হয়তো এইকারণে প্রাণেও বেঁচে যাই। কারণ, আমার জ্ঞান হারানোর পরেই রাকিব ভাইকে চার তলা থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। নকিকে নিয়ে যাওয়া হয় আরেক রুমে। আরো নির্যাতন করার জন্য।

মুহসীন হল ছাত্রলীগ তখন নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার নেশায় উন্মত্ত।

৭.
একবার মনে হলো, আমি উড়ছি।

তাইলে কি আমি মারা গেছি? জীবিত মানুষ আবার শূন্যে উড়ে কী করে?

মুনকার নাকির এসেও কি জিজ্ঞেস করবে তুমি শিবির করো কি না? আমার ভয় ভয় লাগে।

জ্ঞান ফিরলে বুঝি, ফেরেশতারা না, আমাকে পাজাকোলা করে নিয়ে যাচ্ছে চারজন মানুষ। শরীরের নিচে অংশ অসার। আদৌ আছে কি না, জানি না। নিচে বেশ চেচামেচি শুনলাম, বুঝলাম প্রশাসন এসেছে। আমাকে ফেলে রাখা হলো প্রভোস্ট অফিসের সামনে।

জ্ঞান ফিরে এসেছে পুরোপুরি। কিন্তু ভান করে আছি অজ্ঞানের। সাইমুম সিরিজে আহমদ মুসাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে বহুবার দেখেছি। কিন্তু নিজেই সেই আহমদ মুসা হয়ে যাবো, ভাবিনি।

আমার এই “শান্তিতে” অজ্ঞান হয়ে থাকা খুব সম্ভবত হলের আরেক ছাত্রলীগ ক্যাডার রাহাতের পছন্দ হলো না। সে আমার বুকের উপর জোরে লাত্থি দিয়ে বললো, “এই শুয়োরের বাচ্চা ভান ধরে আছে।”

মনে হলো ছাতি ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। তবুও টু শব্দ করিনি। ছাতির চেয়ে প্রাণ বাঁচানো গুরুত্বপূর্ণ। পাশে থাকা পুলিশ বা হল প্রশাসনের হয়তো কিছুটা মায়া হলো। বললো, এরে আর মাইরো না, এ মনে হয় আর বাঁচবে না।

কথাটুকু ঐ সময় বড় ভালো মনে হলো। অন্তত উনি তো আর একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর স্লোগান তো দেয়নি!!

আমি, নকি আর রাকিব ভাই, আমাদের তিনজনকে প্রিজন ভ্যানে তুলে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আমাকে আর নকিকে চিকিৎসা শেষে থানায় আসতে পারলেও রাকিব ভাই আসতে পারেননি। কারণ, চার তলা থেকে ফেলে দেওয়ার পর মানুষ আর সুস্থ হতে পারে না।

থানায় আমার নামে মামলা দেওয়ার চেষ্টা হলেও শেষপর্যন্ত মামলার হয়রানি থেকে আমি বাঁচতে পেরেছিলাম। সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থাকার দরুণ আমার নামে আর মামলা দিতে পারেনি।

কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার, হয়েই গেছে।

খুন হয়ে গেছে আমার স্বপ্ন, দাফন হয়ে গেছে আমার ইউনিভার্সিটির জীবনের রঙিন স্মৃতিরা। আজকাল ঘুমের মধ্যেও আমি চিৎকার করে উঠি, স্বপ্নে দেখি কে যেন আমাকে মারতে আসছে।

রাকিব ভাই আজও ঠিক করে হাঁটতে পারেন না। এই ঘটনার পরেই হল ছেড়ে দিয়েছি। টঙ্গী থেকে এসে ক্লাস করতাম। শাহবাগ আন্দোলন চলার সময় আমি এদিকে আসতে পারিনি। কে কখন জবাই করে দেয়,কে জানে?

এখনও শাহবাগ মোড় দেখলেই আমার ভয় লাগে, কানে বাজে একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর।

এই দুঃস্বপ্ন আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। কবে এর থেকে মুক্তি পাবো জানি না।

এই ঘটনার কয়েকমাস পরেই বাবা মারা যান। ক্যারিয়ার, স্বপ্ন, পরিবার কুরবানি হলো সবই। অথচ আমাকে নির্যাতন করা তুষার দেওয়ান এখন জগন্নাথ ইউনিভার্সিটির সহযোগি অধ্যাপক, এবি সিদ্দিক রাহাত এনএসআই এর উপ-পরিচালক, আবু জাহিদ রিপন বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা।

চোখ বন্ধ করলে আজও ভেসে উঠে সেই নরক, আজও শুনি সেই আগুনের ফুলকি। শাহবাগের সেই জল্লাদের মঞ্চ।

এই মঞ্চ থেকে আমার মতো কতজনের জীবন ধ্বংস হয়েছে জানি না, শুধু জানি, এই অপরাধের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন থেকে আমাদের মুক্তি নাই। স্বাধীন দেশে অনেকেই অনেককিছু থেকেই তো মুক্তি পাচ্ছে।

আমরা কি এই দুঃসহ স্মৃতির কারাগার থেকে মুক্তি পাবো?

সানাউল্লাহ পাটোয়ারী
সেশান- ২০০৮-০৯, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক কেন্দ্রীয় সহকারি মানবাধিকার সম্পাদক, ছাত্রশিবির।
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

যারা আমাকে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত ছিলো তাদের তালিকাঃ
১. মেহেদি হাসান
পিতাঃ মোঃ শমসের ওরফে সোম, গ্রামঃ হলিধানী, ঝিনাইদহ সদর, ঝিনাইদহ।
সেশনঃ ২০০৮-০৯, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সেক্রেটারি, মহসীন হল শাখা ছাত্রলীগ, ও সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি।

২. গোলাম রসুল বিপ্লব
পিতাঃ আবু তালেব শানা, গ্রামঃ টেকা রামচন্দ্রপুর, ডাকঘরঃ কাঁদাকাটি, থানাঃ আশাশুনি, জেলাঃ সাতক্ষীরা
সেশানঃ ২০০৬-০৭, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

৩. আবু জাহিদ রিপন
পিতাঃ মোঃ আব্দুল ওহাব, গ্রামঃ বাদেনা ভারন, ডাকঘরঃ জাদোবপুর, থানাঃ ঝিকরগাছা, জেলাঃ যশোর।
সেশানঃ ২০০৬-০৭, ফিন্যান্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান কর্মস্থলঃ সাউথইস্ট ব্যাংক কর্মকর্তা, দিলকুশা মতিঝিল ব্রাঞ্চ।

৪. জাহিদুল ইসলাম
পিতাঃ শহিদুল ইসলাম, গ্রামঃ রাড়ীপাড়া, ইউনিয়নঃ মালিয়াট, থানাঃ কালীগঞ্জ, জেলাঃ ঝিনাইদহ
সেশানঃ ২০০৮-০৯, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাবেক সহ-সভাপতি, মহসীন হল শাখা ছাত্রলীগ।
বর্তমান কর্মস্থলঃ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক, যশোর।

৫. দেওয়ান তুষার
জেলাঃ ফেনী
সেশান: ২০০৮-০৯, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান কর্মস্থলঃ সহকারি অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

৬. এবি সিদ্দিক রাহাত
ঠিকানাঃ কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।
সেশানঃ ২০০৭-০৮, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান কর্মস্থলঃ উপ-পরিচালক, এনএসআই

৭. আহসান হাবিব রানা
পিতাঃ কাজী বজলুর রহমান, গ্রামঃ গোপীনাথপুর, থানাঃ ঝিনাইদহ সদর, হেলাঃ ঝিনাইদহ।
সেশানঃ ২০০৭-০৮, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
বর্তমান কর্মস্থলঃ প্রাইভেট ল ফার্ম।

৮. হেলাল উদ্দিন সুমন
সেশানঃ ২০০৯-১০, পালি ও বুদ্দিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

৯. ফরহাদুজ্জামান তুষার
সেশান: সেশান ২০০৬-০৭, ল্যাংগুইস্টিক্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১০. জহিরুল ইসলাম ওরফে সরকার জহির রায়হান
পিতাঃ আব্দুস সোবহান, গ্রামঃ সরাইলকান্দি, ডাকঘরঃ আলিয়ারা বাজার, থানাঃ কচুয়া, জেলাঃ চাঁদপুর।
সেশানঃ ২০০৯-১০, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সভাপতি, মহসীন হল শাখা ছাত্রলীগ।

১১. আলী আক্কাস
প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ও সাবেক প্রভোস্ট, হাজী মুহাম্মদ মহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১২. ড. আমজাদ হোসাইন
সাবেক প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ফুটনোট: সানাউল্লাহর উপরে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা ও নির্যাতনের সময়ে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা ‘সোচ্চার’ এর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়েছে এবং তখন কিছু মিডিয়াতেও প্রকাশিত হয়েছিলো। তবে নির্যাতনে তাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা সানাউল্লাহর জবানবন্দী ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে যাচাই করা হয় নি এবং অভিযুক্তদের মন্তব্য নেওয়ার জন্য সোচ্চারের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।

সম্ভাব্য শাস্তি: বাংলাদেশ দন্ডবিধি ৩০৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধ প্রমানিত হলে নির্যাতনে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ৩২৫ ধারা অনুযায়ী সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদন্ড ও জরিমানা হতে পারে। কর্তব্যে অবহেলা এবং নির্যাতনে সহায়তার কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১১৫, ১১৬ এবং ১১৯ ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

শিবিরের রক্ত যে অপবিত্র, আমি আজকের আগে জানতাম না

আপডেট সময় : ০৮:১৩:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫

১.
শিবিরের রক্ত যে অপবিত্র, আমি আজকের আগে জানতাম না।

জানতাম না, ২০১৩ তে এসেও কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে। নতুন মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে না। ঠিকমতো শিবির পেটালেই চলবে।

জানলাম, যখন মারের এক পর্যায়ে আমার বাম পা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসলো। রক্তে ভেসে গেল বিপ্লবের রুমের ফ্লোর।

বিপ্লব হায় হায় করে উঠলো। আহারে, শিবিরের রক্তে আমার রুমটা অপবিত্র হয়ে গেল।

আমার শরীর আর নিতে পারলো না। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাবার ক্যান্সার, মায়ের মুখ, এরপর নিকষ কালো অন্ধকার। আমি জ্ঞান হারালাম।

কিন্তু এই অন্ধকারের চেয়েও গহিন এক অন্ধকারে তখন ছেয়ে গেছে সারাদেশ। সেই অন্ধকারের নাম শাহবাগ।

২.
বড় ফ্যামিলিতে জন্ম। ১১ ভাই বোনের মধ্যে ১০ম হওয়ার জন্যই বোধহয় পড়াশোনা করে অনেককিছু করে ফেলতে হবে, এমন প্রেশার আমার উপর কখনোই ছিলো না।

আদরের ভাগ বেশি। প্রেশারের ভাগ কম। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ার এই এক আরাম।

মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল বাবা আর হাউজওয়াইফ মায়ের ইচ্ছা ছিলো আলেম হবো। আমারও তাই মনে হতো। তা’মিরুল মিল্লাত থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার সময়েও আমার জেনারেল লাইনে পড়ার ইচ্ছা ছিলো না।

তবে আমার বন্ধু বান্ধবদের অনেকেরই ছিলো।

ওরা পরীক্ষার পরেই ইউনিভার্সিটি কোচিং এ ভর্তি হয়ে গেল। সামাজিক চাপ একটা বিশাল ব্যাপার। বিশেষ করে বন্ধুরা কোচিং করে আর আমি ঘরে বসে থাকবো, এই লজ্জা কোথায় রাখি?

তাই আমিও ওদের সাথে ফোকাসে ভর্তি হই। ওদের লক্ষ্য? লেখাপড়া। আর আমার? টাইমপাস করা।

তখনও জানতাম না, এই টাইম পাসের সিদ্ধান্ত ঘুরিয়ে দিতে চলেছে আমার জীবনের মোড়!!

৩.
কোচিং মাত্রই বিরক্তিকর। কোচিং এর বক্তৃতা আরো বেশি বিরক্তিকর। অনিচ্ছা নিয়েই শুনতে শুরু করেছিলাম।

বক্তার নাম মির্জা গালিব। বর্তমানে হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। এর বাইরে ভদ্রলোকের আরো একটা পরিচয় আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি। ঐ হিসেবে উনি আমাদের কাছে গালিব ভাই।

গালিব ভাইয়ের বক্তৃতা শুরু হওয়ার পর আমি হারিয়ে গেলাম। একটা মানুষের কথাও এতো শক্তিশালী হয়? চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে পারে? চুম্বক তো লোহার দিক পরিবর্তন করে দেয়। মির্জা গালিব ভাই বক্তব্য দিলেন। পৃথিবীর কোন এক কোণে পাখা ঝাপটালো একটা প্রজাপতি। সেই প্রজাপতির ডানা এসে পাল্টে দিলো আমার জীবনের গন্তব্য। আরামে টাইম পাস করা কোচিং তখন আমার কাছে পরিণত হলো এক যুদ্ধক্ষেত্রে।

দেড় মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম আর আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে সেই যুদ্ধে আমি জিতে গেলাম। ঢাকা ইউনিভার্সিটির খ ইউনিট। ৪র্থ স্থান।

আমার স্বপ্নের জীবন শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে।

৪.
দেশের সেরা ইউনিভার্সিটির টপ ১০ এ চান্স পাওয়া ছেলেমেয়ের জীবন বাকিদের চেয়ে কিছুটা আলাদা হয়।

সেই আলাদা জীবন আমি পুরোপুরি উপভোগ করতে শুরু করলাম। সবার তো স্বপ্ন থাকে আগে থেকেই। আর আমি বাস্তবতাকেই স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর করে পেয়ে গেলাম । আজ এখানে সংবর্ধনা, কাল ওখানে। মনে হচ্ছিলো সেই গান, আমার মতো এতো সুখী, নয়তো কারো জীবন, কী আদর স্নেহ ভালোবাসায়, জড়ানো মায়ার ভুবন…..

মায়ার সৃষ্টি আছে। ধ্বংসও আছে, জানতাম। তবে সেই ধ্বংস এতোটা ভীষণ হবে, কল্পনাও করিনি। ২০০৮ এর শুকতারা ২০১৩ তে এসে পরিণত হলো ধ্বংস তারাতে!!

৫.
২০১৩ সালের ৫ ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগে স্লোগান উঠলো, একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর।

আপনারা মিডলক্লাস খুব সম্ভবত এখনও মনে করেন, স্লোগানগুলো কেবলই স্লোগান ছিলো। এতো ভয় পাওয়ার কী আছে?

কিন্তু আমরা যারা আসলেই শিবির করি, আমরা জানতাম, ২০১৩ র ৫ ই ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমরা আমাদের বাঁচার অধিকার হারিয়েছি। ঐ দিন থেকে এই দেশে আমরা আর মানুষ ছিলাম না, ছিলাম শিবির নামের এক প্রাণী। যাকে একটা একটা ধরে জবাই করা যায়, পুলিশ, প্রশাসন বা মানুষ কিছু বলে না।

২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ঐদিন আমার মানে ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস টেস্ট ছিলো। টেস্ট শেষ করে হলে আসার সময় মুহসীন হল মাঠ পার হচ্ছি। হঠাৎই দেওয়ান তুষারের ফোন। জানতে চাইলো আমি কোথায় আছি? বললাম। এরপর সে বললো হল গেটে দাঁড়া। তোর সাথে কথা আছে।

আমি হল গেটের দিকে আগাতে থাকি।

তুষার দেওয়ান আমার ইয়ারমেট। এক এলাকার। বেশ ভালো সম্পর্কই ছিলো বলতে হবে। (বর্তমানে সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক)।

কিন্তু হল গেটের কাছে এসে বুঝলাম তুষার একা না। বরং ওর সাথে মাহী গ্রুপের রিপন, মেহেদিসহ বেশ কয়েকজন গেটের দিকে আসছে। গতি অস্বাভাবিক বেশি। আমার মনে তখন সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আমার আর পেছানোর পথ নাই।

সুযোগও ছিলো না। কিছু ভাবার আগেই রিপন কাধে শক্ত করে হাত দিয়ে বললো, চল। আমি যন্ত্রচালিত রোবটের মতো চলতে শুরু করলাম। কোথায়, জানি না। প্রতিবাদ করিনি। করে লাভও হতো না।

রিপন তখনও আমার কাঁধ ধরে আছে। নড়াচড়ার কোন সুযোগ নাই। মাহি গ্রুপের দ্বিতীয় প্রভাবশালী নেতা ছিলো রিপন, ওর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন সুযোগ আমার সামনে ছিলো না। দলে আরো ছিলো দুইজন তুষার। একজন সিনিয়র। আর ছিলো বিপ্লব এবং মেহেদি। এই গ্রুপটা এমনিই কুখ্যাত ছিলো, তবে ওদের মধ্যেও সবচেয়ে কুখ্যাত ছাত্রলীগার ছিলো মেহেদি।

ছাত্রলীগ নাম হলেও ছাত্র বা লেখাপড়ার সাথে মেহেদির সম্পর্ক কমই ছিলো। সে মূলত করতো ইয়াবা আর গাজর ব্যবসা। করতো বলছি কেন, এখনও করে। এর নামে মামলার সংখ্যা অসংখ্য।

এই মেহেদীই প্রথমে আমাদের শিবিরের এক ছোটভাই নকিকে শনাক্ত করে। ওর উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হল শাখা সভাপতি রাকিব ভাই আর সেক্রেটারি আমার নাম বের করে।

সেখান থেকেই আমাকে গেটে আসতে বলা এবং “আটক” করা। শিবির ধরা তখন পাখি শিকারের মতোই পৈশাচিক আনন্দের বিষয় কি না!!

৬.
হল গেট থেকে আমাকে নেওয়া হলো বিপ্লবের রুম, ৪৬২ নাম্বার রুমে।

আমি ততক্ষণে দোয়া পড়ে নিজেকে নিজের পরিণতির ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। কিন্তু রুমে ঢুকেই রাকিব ভাই আর নকির বিধ্বস্ত চেহারা আমার বুকে গিয়ে আঘাত করে। না জানি কত নির্যাতন করলে মানুষের অবস্থা এতোটা বিধ্বস্ত হয়! আমার আগেই ওদের দুজনকে ধরে এনে নির্যাতন করা হচ্ছে এ রুমে যা আমি জানতাম না।

রুমে ঢুকার সাথে সাথে আমার ফোন কেড়ে নিয়ে চেক করা শুরু হয়। ফোনে কিছু না পেয়ে তুষার বলে, এরা শেয়ানা মাল। ফোনে কিছু রাখে নাই।

তুষার বলেছে, এরা।

বুঝলাম, রাকিব ভাইয়ের ফোনেও কিছু পায় নাই। একটু সাহস আসলো।

কিন্তু এরপর জিজ্ঞাসাবাদের সাথে সাথে শুরু হলো এলোপাথাড়ি চড়,থাপ্পড় আর লাত্থি। অসহায় হয়ে পড়লাম। সিনিয়র তুষার, বিপ্লব আর রিপন আমার উপর চড়াও হলো সবচেয়ে বেশি। মেহেদী, তুষার আর জাহিদও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। গায়ে হাত তুলেছে, সাথে গালিগালাজ তো আছেই।

তবে ভয় হাতের ছিলো না। ভয়ের ব্যাপার ছিলো, ওদের সবার কাছেই রামদা, চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ছিলো। আমার মনে তখন একটাই প্রশ্ন, হাত দিয়েই চ্যাপ্টার শেষ হবে নাকি অস্ত্রও ব্যবহার করবে?

আমার প্রশ্নের একসাথে উত্তর দিলো তিনজন।

বিপ্লব হাতে তুলে নিলো মোটা রড। তুষারের হাতে চিকন রড।

দুইজনই আমার পায়ে আঘাত করতে শুরু করলো।

এদের সাথে যোগ হলো রিপন। বাট রিপন মারার সাথে সাথে ছোট ছোট পোচ দিচ্ছিলো। যাতে আমরা আমাদের শিবির সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করি। আর হল কমিটিতর পোলাপাইনের নাম বলে দিই।

তবে তাদের এই আশা পূরণ হয়নি। আমার মুখ থেকে ওরা একটা কথাও বের করতে পারেনি।

এই বের করতে না পেরে ওরা আরো পাগল হয়ে গেল। এলোপাথাড়ি বাড়ি দিতে শুরু করলো। রিপন চিৎকার করে হুমকি দিলো, এদের নিয়ে শাহবাগে ছাইড়া দে। সবাই কুকুরের মতো খাবলাইয়া খাইবো। আর আমরা হবো নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা।

বুঝলাম, শাহবাগে শিবির খাবলাইয়া খাওয়া হয়। বুঝলাম, শিবির খাইতে পারলেই তাকে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা বলে।

কখনও আমি, কখনও বা রাকিব ভাই। নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকি, আমিও যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়তে থাকি। আমার চোখে ভেসে উঠে, ক্যান্সার আক্রান্ত বাবা, আমি ডাকি বাবা, বাবা। বাবার মুখ হাওয়াতে মিলিয়ে যায়, হ্যালুসিনেশান নাকি?

বাবা মিলিয়ে যাওয়ার পর দেখি রক্ত। আমার বাম পা দিয় রক্ত পড়তে শুরু করেছে।

বিপ্লব হায় হায় করে উঠে, শিবিরের রক্তে আমার ঘরটা অপবিত্র হয়ে গেল।

আমার চোখ বুজে আসে। অন্ধকার হয়ে উঠে চারপাশ। শাহবাগে কি এখনও স্লোগান হচ্ছে? একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর…..

আমি জ্ঞান হারাই।

এবং হয়তো এইকারণে প্রাণেও বেঁচে যাই। কারণ, আমার জ্ঞান হারানোর পরেই রাকিব ভাইকে চার তলা থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। নকিকে নিয়ে যাওয়া হয় আরেক রুমে। আরো নির্যাতন করার জন্য।

মুহসীন হল ছাত্রলীগ তখন নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার নেশায় উন্মত্ত।

৭.
একবার মনে হলো, আমি উড়ছি।

তাইলে কি আমি মারা গেছি? জীবিত মানুষ আবার শূন্যে উড়ে কী করে?

মুনকার নাকির এসেও কি জিজ্ঞেস করবে তুমি শিবির করো কি না? আমার ভয় ভয় লাগে।

জ্ঞান ফিরলে বুঝি, ফেরেশতারা না, আমাকে পাজাকোলা করে নিয়ে যাচ্ছে চারজন মানুষ। শরীরের নিচে অংশ অসার। আদৌ আছে কি না, জানি না। নিচে বেশ চেচামেচি শুনলাম, বুঝলাম প্রশাসন এসেছে। আমাকে ফেলে রাখা হলো প্রভোস্ট অফিসের সামনে।

জ্ঞান ফিরে এসেছে পুরোপুরি। কিন্তু ভান করে আছি অজ্ঞানের। সাইমুম সিরিজে আহমদ মুসাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে বহুবার দেখেছি। কিন্তু নিজেই সেই আহমদ মুসা হয়ে যাবো, ভাবিনি।

আমার এই “শান্তিতে” অজ্ঞান হয়ে থাকা খুব সম্ভবত হলের আরেক ছাত্রলীগ ক্যাডার রাহাতের পছন্দ হলো না। সে আমার বুকের উপর জোরে লাত্থি দিয়ে বললো, “এই শুয়োরের বাচ্চা ভান ধরে আছে।”

মনে হলো ছাতি ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। তবুও টু শব্দ করিনি। ছাতির চেয়ে প্রাণ বাঁচানো গুরুত্বপূর্ণ। পাশে থাকা পুলিশ বা হল প্রশাসনের হয়তো কিছুটা মায়া হলো। বললো, এরে আর মাইরো না, এ মনে হয় আর বাঁচবে না।

কথাটুকু ঐ সময় বড় ভালো মনে হলো। অন্তত উনি তো আর একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর স্লোগান তো দেয়নি!!

আমি, নকি আর রাকিব ভাই, আমাদের তিনজনকে প্রিজন ভ্যানে তুলে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আমাকে আর নকিকে চিকিৎসা শেষে থানায় আসতে পারলেও রাকিব ভাই আসতে পারেননি। কারণ, চার তলা থেকে ফেলে দেওয়ার পর মানুষ আর সুস্থ হতে পারে না।

থানায় আমার নামে মামলা দেওয়ার চেষ্টা হলেও শেষপর্যন্ত মামলার হয়রানি থেকে আমি বাঁচতে পেরেছিলাম। সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থাকার দরুণ আমার নামে আর মামলা দিতে পারেনি।

কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার, হয়েই গেছে।

খুন হয়ে গেছে আমার স্বপ্ন, দাফন হয়ে গেছে আমার ইউনিভার্সিটির জীবনের রঙিন স্মৃতিরা। আজকাল ঘুমের মধ্যেও আমি চিৎকার করে উঠি, স্বপ্নে দেখি কে যেন আমাকে মারতে আসছে।

রাকিব ভাই আজও ঠিক করে হাঁটতে পারেন না। এই ঘটনার পরেই হল ছেড়ে দিয়েছি। টঙ্গী থেকে এসে ক্লাস করতাম। শাহবাগ আন্দোলন চলার সময় আমি এদিকে আসতে পারিনি। কে কখন জবাই করে দেয়,কে জানে?

এখনও শাহবাগ মোড় দেখলেই আমার ভয় লাগে, কানে বাজে একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর।

এই দুঃস্বপ্ন আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। কবে এর থেকে মুক্তি পাবো জানি না।

এই ঘটনার কয়েকমাস পরেই বাবা মারা যান। ক্যারিয়ার, স্বপ্ন, পরিবার কুরবানি হলো সবই। অথচ আমাকে নির্যাতন করা তুষার দেওয়ান এখন জগন্নাথ ইউনিভার্সিটির সহযোগি অধ্যাপক, এবি সিদ্দিক রাহাত এনএসআই এর উপ-পরিচালক, আবু জাহিদ রিপন বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা।

চোখ বন্ধ করলে আজও ভেসে উঠে সেই নরক, আজও শুনি সেই আগুনের ফুলকি। শাহবাগের সেই জল্লাদের মঞ্চ।

এই মঞ্চ থেকে আমার মতো কতজনের জীবন ধ্বংস হয়েছে জানি না, শুধু জানি, এই অপরাধের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন থেকে আমাদের মুক্তি নাই। স্বাধীন দেশে অনেকেই অনেককিছু থেকেই তো মুক্তি পাচ্ছে।

আমরা কি এই দুঃসহ স্মৃতির কারাগার থেকে মুক্তি পাবো?

সানাউল্লাহ পাটোয়ারী
সেশান- ২০০৮-০৯, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক কেন্দ্রীয় সহকারি মানবাধিকার সম্পাদক, ছাত্রশিবির।
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

যারা আমাকে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত ছিলো তাদের তালিকাঃ
১. মেহেদি হাসান
পিতাঃ মোঃ শমসের ওরফে সোম, গ্রামঃ হলিধানী, ঝিনাইদহ সদর, ঝিনাইদহ।
সেশনঃ ২০০৮-০৯, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সেক্রেটারি, মহসীন হল শাখা ছাত্রলীগ, ও সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি।

২. গোলাম রসুল বিপ্লব
পিতাঃ আবু তালেব শানা, গ্রামঃ টেকা রামচন্দ্রপুর, ডাকঘরঃ কাঁদাকাটি, থানাঃ আশাশুনি, জেলাঃ সাতক্ষীরা
সেশানঃ ২০০৬-০৭, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

৩. আবু জাহিদ রিপন
পিতাঃ মোঃ আব্দুল ওহাব, গ্রামঃ বাদেনা ভারন, ডাকঘরঃ জাদোবপুর, থানাঃ ঝিকরগাছা, জেলাঃ যশোর।
সেশানঃ ২০০৬-০৭, ফিন্যান্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান কর্মস্থলঃ সাউথইস্ট ব্যাংক কর্মকর্তা, দিলকুশা মতিঝিল ব্রাঞ্চ।

৪. জাহিদুল ইসলাম
পিতাঃ শহিদুল ইসলাম, গ্রামঃ রাড়ীপাড়া, ইউনিয়নঃ মালিয়াট, থানাঃ কালীগঞ্জ, জেলাঃ ঝিনাইদহ
সেশানঃ ২০০৮-০৯, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাবেক সহ-সভাপতি, মহসীন হল শাখা ছাত্রলীগ।
বর্তমান কর্মস্থলঃ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক, যশোর।

৫. দেওয়ান তুষার
জেলাঃ ফেনী
সেশান: ২০০৮-০৯, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান কর্মস্থলঃ সহকারি অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

৬. এবি সিদ্দিক রাহাত
ঠিকানাঃ কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।
সেশানঃ ২০০৭-০৮, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান কর্মস্থলঃ উপ-পরিচালক, এনএসআই

৭. আহসান হাবিব রানা
পিতাঃ কাজী বজলুর রহমান, গ্রামঃ গোপীনাথপুর, থানাঃ ঝিনাইদহ সদর, হেলাঃ ঝিনাইদহ।
সেশানঃ ২০০৭-০৮, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
বর্তমান কর্মস্থলঃ প্রাইভেট ল ফার্ম।

৮. হেলাল উদ্দিন সুমন
সেশানঃ ২০০৯-১০, পালি ও বুদ্দিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

৯. ফরহাদুজ্জামান তুষার
সেশান: সেশান ২০০৬-০৭, ল্যাংগুইস্টিক্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১০. জহিরুল ইসলাম ওরফে সরকার জহির রায়হান
পিতাঃ আব্দুস সোবহান, গ্রামঃ সরাইলকান্দি, ডাকঘরঃ আলিয়ারা বাজার, থানাঃ কচুয়া, জেলাঃ চাঁদপুর।
সেশানঃ ২০০৯-১০, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সভাপতি, মহসীন হল শাখা ছাত্রলীগ।

১১. আলী আক্কাস
প্রফেসর, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ও সাবেক প্রভোস্ট, হাজী মুহাম্মদ মহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

১২. ড. আমজাদ হোসাইন
সাবেক প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ফুটনোট: সানাউল্লাহর উপরে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা ও নির্যাতনের সময়ে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা ‘সোচ্চার’ এর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়েছে এবং তখন কিছু মিডিয়াতেও প্রকাশিত হয়েছিলো। তবে নির্যাতনে তাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা সানাউল্লাহর জবানবন্দী ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে যাচাই করা হয় নি এবং অভিযুক্তদের মন্তব্য নেওয়ার জন্য সোচ্চারের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।

সম্ভাব্য শাস্তি: বাংলাদেশ দন্ডবিধি ৩০৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধ প্রমানিত হলে নির্যাতনে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ৩২৫ ধারা অনুযায়ী সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদন্ড ও জরিমানা হতে পারে। কর্তব্যে অবহেলা এবং নির্যাতনে সহায়তার কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১১৫, ১১৬ এবং ১১৯ ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।