সুনামগঞ্জ ০৩:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ২৭ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক তাৎপর্যপূর্ণ সফর

ড. সিরাজুল আই. ভূঁইয়া
  • আপডেট সময় : ০৯:১৯:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫ ৭২ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা অনুমান করার সেরা উপায় হলো সেটি গঠন করা।’ – পিটার ড্রাকার

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর শুধু একটি কূটনৈতিক সফর ছিল না, এটি ছিল এমন একটি মুহূর্ত যা বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। এই সফর এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন বাংলাদেশ একাধিক ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, যার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট, পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, জলবায়ু ঝুঁকি ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা। এই সফর জাতিসংঘের উন্নয়ন ও মানবিক প্রচেষ্টাকে আবার নিশ্চিত করেছে এবং বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

একটি উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ এই সফরকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করেছে তার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ তুলে ধরার জন্য। এর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা লাভ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অবদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন। এই সফর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক শাসনকাঠামোর সঙ্গে আরো সংযুক্ত হতে এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করেছে।

বাংলাদেশের কৌশলগত অর্জন ও কূটনৈতিক সাফল্য

১. রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষন

জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল রোহিঙ্গা সংকট, যা ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাগত চাপে ফেলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বহন করছে, যার স্থায়ী সমাধান অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় গুতেরেস আবার নিশ্চিত করেন যে, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য কাজ করে যাবে। সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে এই সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়, বিশেষত চীন, ভারত ও আসিয়ানের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কঠোর আন্তর্জাতিক জবাবদিহির দাবি জানায় এবং শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক অর্থায়নের আহ্বান জানায়। বিশ্ব যখন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ধীরে ধীরে উদাসীন হয়ে পড়ছে, তখন জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বিষয়টিকে আবার আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

২. বাংলাদেশ-জাতিসংঘ সম্পর্ক জোরদার এবং উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বিশেষত শান্তিরক্ষা, টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়। গুতেরেসের এই সফর এই সম্পর্ককে আরো গভীর করার সুযোগ এনে দেয় এবং বাংলাদেশকে বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

জাতিসংঘ মহাসচিব তার সফরে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন, লিঙ্গসমতা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনের প্রশংসা করেন। তবে কোভিড-১৯ মহামারি ও বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছে, বিশেষত ঋণ পুনর্গঠন, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাজার প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ তার জলবায়ু কর্মপরিকল্পনার প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নে আরো সহায়তার জন্য কাজ করছে। সফরটি জলবায়ু সহনশীলতা প্রকল্প, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্যোগ এবং কার্বন নির্গমন হ্রাসের মতো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বৈশ্বিক অর্থায়নের পথ সুগম করেছে।

মিয়ানমার ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর প্রভাব

১. রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনায় আনতে নতুন কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। জাতিসংঘ প্রধানের এই সফর মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে, বৈশ্বিক সম্প্রদায় এই সংকটের অবসান ঘটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও মর্যাদাপূর্ণভাবে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের অনীহাই এখন পর্যন্ত প্রধান বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। তবে গুতেরেসের এই সফর বাংলাদেশকে জাতিসংঘ, আসিয়ান ও অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের নতুন সুযোগ করে দিয়েছে, যাতে দেশটি তার পূর্ববর্তী প্রত্যাবাসন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে। এই সফরের ফলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করতে আরো মানবিক সহায়তার পথও সুগম হতে পারে, যা তাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অপরিহার্য।

২. আরাকান আর্মি সংকট ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যভিত্তিক জাতিগত বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির উত্থান এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘর্ষ শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই ব্যাহত করছে না, বরং এটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সামগ্রিক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গুতেরেস তার সফরে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এই সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ চায়, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা যেন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে না পড়ে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা হলে তা শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর প্রভাব : ভারতের কূটনৈতিক উদ্বেগ

ভারত বিগত দিনগুলোয় ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্র হিসেবে দেখে এলেও এই উচ্চপর্যায়ের সফরের প্রভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোয় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা ঢাকার আরো আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়, যা সবসময় নয়াদিল্লির কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।

ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকতে পারে:

১. রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক কূটনীতি

  • ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে বরাবরই সতর্ক কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে, যেখানে তারা মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এবং একইসঙ্গে উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে বিরত থেকেছে।
  • জাতিসংঘ যদি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরো শক্তিশালী আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়, তবে ভারতকেও এই সংকট নিরসনে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হতে পারে, বিশেষ করে যখন মিয়ানমারে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ জড়িত রয়েছে।

২. ভূরাজনৈতিক প্রভাব ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক স্বায়ত্তশাসন

  • ঐতিহাসিকভাবে ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আঞ্চলিক অংশীদার ছিল, তবে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে বহুমুখী করে তুলেছে। বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘ ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করছে, যা ভারতের জন্য একটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
  • এই সফর প্রমাণ করে, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম এবং এটি কেবল ভারতের ওপর নির্ভর না করে বৈশ্বিক অংশীদারত্ব বাড়ানোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

৩. জলবায়ু কার্যক্রম ও বাণিজ্য সহযোগিতা

  • বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, তবে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সফল জলবায়ু সহযোগিতা ভারতকে অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে বা যৌথ উদ্যোগ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
  • তদুপরি, বাংলাদেশ যদি জাতিসংঘের কাঠামোর অধীনে আরো বিস্তৃত বাণিজ্য অংশীদারত্ব অনুসন্ধান করে, তবে এটি এমন নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে, যা ভারতের বিদ্যমান বাণিজ্য সম্পর্কের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে বা তা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত সম্ভবত এই সফরকে বাংলাদেশের বহুপক্ষীয় কূটনীতির প্রতি অধিক ঝোঁকের একটি সংকেত হিসেবে দেখবে, যা দেশটিকে একক কোনো আঞ্চলিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল না থাকার বার্তা দেয়। যদিও এটি মাঝে মাঝে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কিছু উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, তবে এটি ভারতের জন্যও একটি সুযোগ, যেখানে ভারত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে পুনর্গঠন করতে পারে, যাতে উভয় দেশের স্বার্থ দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষিত থাকে।

সর্বোপরি, ভারত এই সফরকে এমন একটি সংকেত হিসেবে নিতে পারে যে, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে আরো ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে এবং যেকোনো একক আঞ্চলিক শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা হ্রাস করছে। এটি কিছু কূটনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টি করতে পারে, তবে একইসঙ্গে এটি ভারতের জন্য সুযোগ এনে দেবে, যাতে তারা তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি নতুন ও টেকসই ভিত্তির ওপর গড়ে তুলতে পারে।

ড. ইউনূস ফ্যাক্টর

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরকে আরো তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নোবেলবিজয়ী ও ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে ড. ইউনূস বিশ্বজুড়ে উচ্চপ্রশংসিত এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তার বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, সামাজিক ব্যবসায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং স্বচ্ছ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

ড. ইউনূসের উপস্থিতি বাংলাদেশকে এমন এক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরছে, যা স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির নীতিতে বিশ্বাসী। এটি কেবল বহুপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করবে না, বরং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও উন্নয়ন সহায়তা লাভের সম্ভাবনাও বাড়াবে।

এ ছাড়া ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো যখন বাংলাদেশ-জাতিসংঘ সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে সন্দিহান, তখন ড. ইউনূসের কূটনৈতিক দক্ষতা বাংলাদেশকে মধ্যপথ অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। তার উপস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করবে যে, বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক ও স্থিতিশীল পথে অগ্রসর হচ্ছে।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কৌশলগত ভবিষ্যতের নতুন দিগন্ত

‘শক্তিমানরা যা পারে, তা-ই করে, আর দুর্বলরা যা সহ্য করতে হয়, তা-ই করে।’ – থুসিডাইডস

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর দেশের কূটনৈতিক বিজয়ের এক অনন্য উদাহরণ। এই সফর রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির একজন সক্রিয় ও প্রভাবশালী খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এই সফরের গতি ধরে রাখা—মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি, লাভজনক বাণিজ্য চুক্তি সুরক্ষিত করা এবং উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে বৈশ্বিক অংশীদারত্বের সর্বোত্তম ব্যবহার করা। কৌশলগত ও বিচক্ষণ কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন আর শুধু আঞ্চলিক রাজনীতির অনুসারী নয়, বরং বৈশ্বিক পরিসরে একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

লেখক: প্রফেসর ও সাবেক চেয়ার, ডিপার্টমেন্ট অব জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনসাভানাহ স্টেট ইউনিভার্সিটি, জর্জিয়া, ইউএসএ

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক তাৎপর্যপূর্ণ সফর

আপডেট সময় : ০৯:১৯:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫

ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা অনুমান করার সেরা উপায় হলো সেটি গঠন করা।’ – পিটার ড্রাকার

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর শুধু একটি কূটনৈতিক সফর ছিল না, এটি ছিল এমন একটি মুহূর্ত যা বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। এই সফর এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন বাংলাদেশ একাধিক ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, যার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট, পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, জলবায়ু ঝুঁকি ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা। এই সফর জাতিসংঘের উন্নয়ন ও মানবিক প্রচেষ্টাকে আবার নিশ্চিত করেছে এবং বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

একটি উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ এই সফরকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করেছে তার গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ তুলে ধরার জন্য। এর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা লাভ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অবদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন। এই সফর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক শাসনকাঠামোর সঙ্গে আরো সংযুক্ত হতে এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করেছে।

বাংলাদেশের কৌশলগত অর্জন ও কূটনৈতিক সাফল্য

১. রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষন

জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল রোহিঙ্গা সংকট, যা ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশকে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাগত চাপে ফেলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বহন করছে, যার স্থায়ী সমাধান অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় গুতেরেস আবার নিশ্চিত করেন যে, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য কাজ করে যাবে। সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে এই সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়, বিশেষত চীন, ভারত ও আসিয়ানের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কঠোর আন্তর্জাতিক জবাবদিহির দাবি জানায় এবং শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক অর্থায়নের আহ্বান জানায়। বিশ্ব যখন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ধীরে ধীরে উদাসীন হয়ে পড়ছে, তখন জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর বিষয়টিকে আবার আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে।

২. বাংলাদেশ-জাতিসংঘ সম্পর্ক জোরদার এবং উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বিশেষত শান্তিরক্ষা, টেকসই উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়। গুতেরেসের এই সফর এই সম্পর্ককে আরো গভীর করার সুযোগ এনে দেয় এবং বাংলাদেশকে বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

জাতিসংঘ মহাসচিব তার সফরে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন, লিঙ্গসমতা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনের প্রশংসা করেন। তবে কোভিড-১৯ মহামারি ও বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছে, বিশেষত ঋণ পুনর্গঠন, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বাজার প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ তার জলবায়ু কর্মপরিকল্পনার প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নে আরো সহায়তার জন্য কাজ করছে। সফরটি জলবায়ু সহনশীলতা প্রকল্প, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্যোগ এবং কার্বন নির্গমন হ্রাসের মতো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বৈশ্বিক অর্থায়নের পথ সুগম করেছে।

মিয়ানমার ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর প্রভাব

১. রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনায় আনতে নতুন কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। জাতিসংঘ প্রধানের এই সফর মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে, বৈশ্বিক সম্প্রদায় এই সংকটের অবসান ঘটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও মর্যাদাপূর্ণভাবে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের অনীহাই এখন পর্যন্ত প্রধান বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। তবে গুতেরেসের এই সফর বাংলাদেশকে জাতিসংঘ, আসিয়ান ও অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের নতুন সুযোগ করে দিয়েছে, যাতে দেশটি তার পূর্ববর্তী প্রত্যাবাসন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে। এই সফরের ফলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করতে আরো মানবিক সহায়তার পথও সুগম হতে পারে, যা তাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অপরিহার্য।

২. আরাকান আর্মি সংকট ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যভিত্তিক জাতিগত বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির উত্থান এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘর্ষ শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেই ব্যাহত করছে না, বরং এটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সামগ্রিক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গুতেরেস তার সফরে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এই সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ চায়, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা যেন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ছড়িয়ে না পড়ে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা হলে তা শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে ত্বরান্বিত করবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর প্রভাব : ভারতের কূটনৈতিক উদ্বেগ

ভারত বিগত দিনগুলোয় ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্র হিসেবে দেখে এলেও এই উচ্চপর্যায়ের সফরের প্রভাব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোয় বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা ঢাকার আরো আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়, যা সবসময় নয়াদিল্লির কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।

ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকতে পারে:

১. রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক কূটনীতি

  • ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে বরাবরই সতর্ক কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে, যেখানে তারা মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এবং একইসঙ্গে উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে বিরত থেকেছে।
  • জাতিসংঘ যদি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরো শক্তিশালী আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়, তবে ভারতকেও এই সংকট নিরসনে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হতে পারে, বিশেষ করে যখন মিয়ানমারে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ জড়িত রয়েছে।

২. ভূরাজনৈতিক প্রভাব ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক স্বায়ত্তশাসন

  • ঐতিহাসিকভাবে ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আঞ্চলিক অংশীদার ছিল, তবে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে বহুমুখী করে তুলেছে। বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘ ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করছে, যা ভারতের জন্য একটি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
  • এই সফর প্রমাণ করে, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতি স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম এবং এটি কেবল ভারতের ওপর নির্ভর না করে বৈশ্বিক অংশীদারত্ব বাড়ানোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

৩. জলবায়ু কার্যক্রম ও বাণিজ্য সহযোগিতা

  • বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, তবে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সফল জলবায়ু সহযোগিতা ভারতকে অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে বা যৌথ উদ্যোগ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
  • তদুপরি, বাংলাদেশ যদি জাতিসংঘের কাঠামোর অধীনে আরো বিস্তৃত বাণিজ্য অংশীদারত্ব অনুসন্ধান করে, তবে এটি এমন নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে, যা ভারতের বিদ্যমান বাণিজ্য সম্পর্কের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে বা তা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারত সম্ভবত এই সফরকে বাংলাদেশের বহুপক্ষীয় কূটনীতির প্রতি অধিক ঝোঁকের একটি সংকেত হিসেবে দেখবে, যা দেশটিকে একক কোনো আঞ্চলিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল না থাকার বার্তা দেয়। যদিও এটি মাঝে মাঝে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কিছু উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, তবে এটি ভারতের জন্যও একটি সুযোগ, যেখানে ভারত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে পুনর্গঠন করতে পারে, যাতে উভয় দেশের স্বার্থ দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষিত থাকে।

সর্বোপরি, ভারত এই সফরকে এমন একটি সংকেত হিসেবে নিতে পারে যে, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে আরো ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে এবং যেকোনো একক আঞ্চলিক শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা হ্রাস করছে। এটি কিছু কূটনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টি করতে পারে, তবে একইসঙ্গে এটি ভারতের জন্য সুযোগ এনে দেবে, যাতে তারা তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি নতুন ও টেকসই ভিত্তির ওপর গড়ে তুলতে পারে।

ড. ইউনূস ফ্যাক্টর

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরকে আরো তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নোবেলবিজয়ী ও ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে ড. ইউনূস বিশ্বজুড়ে উচ্চপ্রশংসিত এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তার বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, সামাজিক ব্যবসায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং স্বচ্ছ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

ড. ইউনূসের উপস্থিতি বাংলাদেশকে এমন এক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরছে, যা স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির নীতিতে বিশ্বাসী। এটি কেবল বহুপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করবে না, বরং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও উন্নয়ন সহায়তা লাভের সম্ভাবনাও বাড়াবে।

এ ছাড়া ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো যখন বাংলাদেশ-জাতিসংঘ সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে সন্দিহান, তখন ড. ইউনূসের কূটনৈতিক দক্ষতা বাংলাদেশকে মধ্যপথ অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। তার উপস্থিতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করবে যে, বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক ও স্থিতিশীল পথে অগ্রসর হচ্ছে।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কৌশলগত ভবিষ্যতের নতুন দিগন্ত

‘শক্তিমানরা যা পারে, তা-ই করে, আর দুর্বলরা যা সহ্য করতে হয়, তা-ই করে।’ – থুসিডাইডস

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর দেশের কূটনৈতিক বিজয়ের এক অনন্য উদাহরণ। এই সফর রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির একজন সক্রিয় ও প্রভাবশালী খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এই সফরের গতি ধরে রাখা—মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি, লাভজনক বাণিজ্য চুক্তি সুরক্ষিত করা এবং উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে বৈশ্বিক অংশীদারত্বের সর্বোত্তম ব্যবহার করা। কৌশলগত ও বিচক্ষণ কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন আর শুধু আঞ্চলিক রাজনীতির অনুসারী নয়, বরং বৈশ্বিক পরিসরে একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

লেখক: প্রফেসর ও সাবেক চেয়ার, ডিপার্টমেন্ট অব জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনসাভানাহ স্টেট ইউনিভার্সিটি, জর্জিয়া, ইউএসএ