সুনামগঞ্জ ০৩:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

উদীচী-ছায়ানটে উপেক্ষিত বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি

আমার সুনামগঞ্জ ডেস্ক:
  • আপডেট সময় : ০৯:১৪:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫ ২৫ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

দেশের প্রভাবশালী দুই সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ও উদীচীর অনুষ্ঠানগুলোয় মুসলিম সংস্কৃতি উপেক্ষিত থাকছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোকে তারা দেখছেন বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান হিসেবে। বছরজুড়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন দুটো নানা কর্মসূচি পালন করলেও মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা কর্মসূচি পালন করেন না। পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনসহ বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক সাংস্কৃতিক তৎপরতা থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় উৎসব ঈদ, শবেবরাত বা মহররমের মতো জনসম্পৃক্ত উৎসবগুলোয় কোনো কর্মসূচি থাকে না।

এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ কর্মসূচির নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন দুটো নানাভাবে কলকাতার বাবু সংস্কৃতির বয়ান তৈরি করে থাকে। আওয়ামী শাসনামলে সংগঠন দুটো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছে। এই সাংস্কৃতিক সংগঠন দুটোর শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা আমার দেশকে বলেছেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় দিকগুলো আনা হবে সাম্প্রদায়িকতা। ফলে তারা মুসলিম সংস্কৃতিকে আলাদাভাবে উদ্‌যাপন করতে চান না, যদিও তাদের অনুষ্ঠানগুলোয় বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে বলে মনে করেন অনেক সংস্কৃতি বিশ্লেষক।

ছায়ানটের বছরব্যাপী যত কর্মসূচি

রবীন্দ্রচর্চাকে সামনে রেখে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট। সংগঠনটির জন্মকথায় বলা হয়েছে, তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তানি যুগে কঠোর সামরিক শাসনে পদানত স্বদেশে রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে। অর্থাৎ একমাত্র রবীন্দ্রনাথই ছায়ানটের কাছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক।

ছায়ানটের মূল অনুষ্ঠান রমনার বটমূলে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষে। নাম বাংলা নববর্ষের আবাহন। ঢাকার রমনা উদ্যানের অশ্বত্থ গাছের নিচে ১৯৬৭ সালের মধ্য এপ্রিলে হয়েছিল প্রথম অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানস্থলের নাম করা হয় বটমূল। শ্রোতার আসর নামে ছায়ানটের নিয়মিত একটি অনুষ্ঠান আছে। বছরে ছটি আসরের আয়োজন করে ছায়ানট। বাংলা মাসের চতুর্থ শুক্রবার সন্ধ্যায় ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের রমেশচন্দ্র দত্ত স্মৃতি মিলনকেন্দ্রে হয় এই অনুষ্ঠান।

ছায়ানট নিয়মিতভাবে ভাষাশহীদ দিবস পালন করে থাকে। ছায়ানটের আরেকটি নিয়মিত অনুষ্ঠান হচ্ছে ঋতু উৎসব। ষাটের দশক থেকেই ঋতু উৎসবের আয়োজন করে আসছে ছায়ানট। তবে উৎসবগুলো সীমাবদ্ধ কেবল বর্ষা, শরৎ ও বসন্ত ঋতু ঘিরে।

ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ওয়াহিদুল হকের ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে আয়োজন করা হয় প্রথম লোকসংগীত উৎসবের। পরের বছর থেকে এই আয়োজনের নাম হয় ওয়াহিদুল হক স্মারক দেশঘরের গান। এছাড়া ২০০৭ সাল থেকে শুদ্ধ সংগীত উৎসবের আয়োজন করে ছায়ানট। প্রতি বছরের শীতকালে এর আয়োজন হচ্ছে।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ১১ জ্যৈষ্ঠকে ঘিরে নিয়মিতভাবে দুদিনের নজরুল উৎসবের আয়োজন করে ছায়ানট। ছায়ানটের ভাষ্য, বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্মকে সাধারণের কাছে আরো সহজ করে তোলার লক্ষ্যে ১৪১৬ বঙ্গাব্দ থেকে বার্ষিক রবীন্দ্র-উৎসব করছে ছায়ানট।

১৪১৭ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে ছায়ানটের বছরব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার অংশ হলো রবীন্দ্র-নৃত্যোৎসব। বছর বছর নিয়মিত হচ্ছে এ উৎসব আয়োজন।

এছাড়া ছায়ানট বছরে নিয়মিত আয়োজন করে আসছে ২০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুফিয়া কামাল এবং ২৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ওয়াহিদুল হকের প্রয়াণ দিবসের স্মরণানুষ্ঠান। ছায়ানট নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত বার্ষিক স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও একুশের অনুষ্ঠানমালায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানেও নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকে ছায়ানট।

বছরজুড়ে ছায়ানটের এত কর্মসূচির মধ্যে কেন বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব অনুষ্ঠানগুলোয় ছায়ানট কোনো কর্মসূচি দেয় না— এমন প্রশ্নের জবাবে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক ও ট্রাস্টি লাইসা আহমদ লিসা আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণ কামনা করে পহেলা বৈশাখ করি, যেটা সবার জন্য কমন। ঈদ, পূজা ও ক্রিসমাস জাতিভিত্তিক বা গোষ্ঠীভিত্তিক ব্যাপার। তার মতে, সব মানুষের কল্যাণ কামনা মানে হচ্ছে সবাইকে সম্পৃক্ত করা।

ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সংস্কৃতির অংশ— এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন, এমন প্রশ্নের জবাবে লাইসা লিসা বলেন, ‘আমি তো ঈদের নামাজ হিন্দু জাতিকে নিয়ে করতে পারব না। হিন্দুর পূজায় যেতে পারি, দেখতে পারি, আনন্দ করতে পারি কিন্তু পূজা করতে পারব না। ফলে কমন প্ল্যাটফর্ম কোনটা, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। যেটা সবার জন্য কমন, সবাইকে নিয়ে করা যায়, সেই জিনিসকে আমরা করেছি। কাউকে ছোট করা, খাটো করা, কী ধর্মাচারণ করব, কী পালন করব, তার সঙ্গে আসলে কোনো ব্যাপার নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সবার সমতার কথা ভাবি, কিন্তু বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কথা নয়।’

কারা চালায় ছায়ানট

দীর্ঘদিন থেকে ছায়ানটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সন্জীদা খাতুন। গত ২৫ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন। রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে তাকে চিরবিদায় জানানো নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। তার লাশ কবর দেওয়ার পরিবর্তে দান করা হয়েছে।

এ ছাড়া নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ডা. সারওয়ার আলী। সহ-সভাপতি বাংলাদেশের ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তার সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর থেকে তিনি এখন অনেকটা অন্তরালে রয়েছেন। আরেকজন সহ-সভাপতি খায়রুল আনাম (শাকিল)। ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা। যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন পার্থ তানভীর নভেদ ও জয়ন্ত রায়। কোষাধ্যক্ষ নাসেহুন আমীন। এ ছাড়া ছায়ানটের পরিচালনায় সদস্য হিসেবে আছেন, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মাসুদা নার্গিস আনাম, সাহানা আখতার রহমান পাপড়ি, আমিনুল কাওসার খান দীপু, তানিয়া মান্নান, জুবায়ের ইউসুফ ও গৌতম কুমার সরকার।

ছায়ানট শুরু থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। এজন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছায়ানট সরকারি সমর্থন পেয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ছায়ানটকে সরকারিভাবে ধানমন্ডিতে এক বিঘা জমি প্রদান করা হয়, যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সংস্কৃতি ভবন। ছায়ানট বলছে, এই জমিতে সংস্কৃতি-ভবন নির্মাণ করে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপকতর অবদান রাখার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে ছায়ানট।

উদীচী

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন। এটি মূলত বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটি ছায়া সংগঠন। তবে সংগঠনটির ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির। উদীচীর অধীনে সংগীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, চারুকলা ও সাহিত্য বিভাগ কাজ করছে। ১৯৬৮ সালে কথাশিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তসহ একঝাঁক বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তরুণ উদীচী গঠন করেন। বর্তমানে ৭১টি সাংগঠনিক জেলা সংসদ এবং জেলা সংসদের অধীনে ৩১৫টি শাখা রয়েছে। উদীচীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। দেশের বাইরেও উদীচীর ছয়টি শাখা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায়।

বছরজুড়ে সংগঠনটি জাতীয় বিভিন্ন দিবসসহ অন্তত ৪৫টি দিবস পালন করে থাকে, যার মধ্যে মার্কস, লেনিন ও প্রীতিলতা ওয়েদ্দারের জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। কিন্তু ঈদ, শবেবরাত কিংবা মহররমের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাদের কোনো কর্মসূচি থাকে না। মুসলমান মনীষীদের নিয়েও তাদের তেমন কোনো অনুষ্ঠান নেই।

উদীচীর দুই শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা যে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সাম্প্রদায়িকতা-দুষ্ট বলে মনে করেন। ধর্মের গুরুত্ব অস্বীকার না করলেও তারা এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করেন।

উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে আমার দেশকে বলেন, দেশের সংকট ও সম্ভাবনায় আমাদের কর্মসূচিগুলো থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চার নীতির আলোকে শোষণ-বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার বিষয়টি আমাদের সংগঠনের বেসিক কনসেপ্ট। উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক দিক উপেক্ষিত কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই, সুতরাং বিশেষ ধর্মের অুনষ্ঠানে আমরা সম্পৃক্ত হতে চাই না। যারা যে ধর্ম পালন করে, তারা সে ধর্ম পালন করবে। সংগঠনের কার্যক্রমে আমরা ধর্মকে আনতে চাই না।

উদীচীতে বামপন্থি সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রভাব বেশি থাকলেও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক তৎপরতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের নামে গত দেড় দশকে রাজপথে সংগঠনটি অসংখ্য ইসলামোফোবিক কর্মসূচি পালন করেছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে উদীচীর রয়েছে ঘনিষ্ঠতা। সরকারিভাবে উদীচী নানা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। ২০১৩ সালে হাসিনা সরকার উদীচীকে একুশে পদক প্রদান করে।

ছায়ানট ও উদীচীর বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি উপেক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আমার দেশকে বলেন, কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের আয়োজন বা দর্শন নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আমি বরং আমাদের সরকারের দর্শন বলতে পারি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে আমরা প্রথমবারের মতো শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে চাঁদরাতে ঈদ উৎসবের আয়োজন করেছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মিলে ঈদ মিছিল এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। সামনে এটা দেশজুড়ে হবে। আমরা জানি ইসলামি রেওয়াজ বা ইসলামের গন্ধ আছে, এমন যে কোনো কিছুকে সাংস্কৃতিকভাবে বিয়োগ করার একটা প্রবণতা আমরা দেখে আসছিলাম। আমরা এটা থেকে বেরিয়ে এসেছি। এবারের নববর্ষের আয়োজনেও পরিবর্তন দেখতে পাবেন। আওয়ামী ফ‍্যাসিবাদী কালচারাল লীগের বিভক্তিমূলক আয়োজনের বিপরীতে বাংলাদেশের সব জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণমূলক উৎসব দেখবেন আপনারা। এসব আয়োজনের পেছনে দর্শন হয়ে আছে একটাই শব্দ ‘বাংলাদেশ’। মোট কথা, যা কিছু বাংলাদেশের তার সবই আমরা ধারণ করব। হেজেমনিক কালচারের এক্সক্লুশনের নীতির পরিবর্তে সব ধর্ম ও সব জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ইনক্লুশন হচ্ছে আমাদের মূলমন্ত্র।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি ও দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক আব্দুল হাই শিকদার মনে করেন, পাকিস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ছায়ানট ও উদীচীর জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর বিকাশ ও প্রভাব তৈরি হয়েছে ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ছায়ানট ও উদীচী ভারতীয় ন্যারেটিভ তৈরির দুটো মুখ। তারা বাঙালি মুসলমানের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি ধারণ করে না। সংস্কৃতির নামে সংগঠনগুলো রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত করেছে, যেমনটা শেখ মুজিবকে রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের আইকনে পরিণত করা হয়েছিল।

সমাজবিজ্ঞানী ও নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের (কাতার) সহকারী অধ্যাপক ড. হাসান মাহমুদ মনে করেন, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সমাজবিজ্ঞান কিংবা নৃবিজ্ঞানের যে কোনো প্রারম্ভিক টেক্সট বইয়ে এই বিষয়টা পাওয়া যাবে। সমাজবিজ্ঞান বা নৃবিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান হচ্ছে, ধর্মকে সংস্কৃতি থেকে আলাদা করা যায় না। তিনি বলেন, উদীচী আর ছায়ানটের অনুষ্ঠানে ধর্মের কোনো প্রতিফলন থাকে না— এই দাবি বাংলাদেশের সেক্যুলাররা করে থাকে। আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। এই সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠানে যেসব আচার আর রীতি দেখা যায়, সেগুলো অবশ্যই কোনো না কোনো ধর্ম থেকেই আসে এবং সেই ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর বুকে এমন কোনো সংস্কৃতি নেই, যার মধ্যে ধর্ম নেই। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, প্রার্থনা সংগীত, হাতজোড় করে প্রণাম করা, কপালে লাল টিপ দেওয়া— এগুলো সবকিছুই কোনো না কোনো ধর্ম থেকেই এসেছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

উদীচী-ছায়ানটে উপেক্ষিত বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি

আপডেট সময় : ০৯:১৪:৫৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫

দেশের প্রভাবশালী দুই সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ও উদীচীর অনুষ্ঠানগুলোয় মুসলিম সংস্কৃতি উপেক্ষিত থাকছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোকে তারা দেখছেন বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান হিসেবে। বছরজুড়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন দুটো নানা কর্মসূচি পালন করলেও মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা কর্মসূচি পালন করেন না। পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনসহ বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক সাংস্কৃতিক তৎপরতা থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় উৎসব ঈদ, শবেবরাত বা মহররমের মতো জনসম্পৃক্ত উৎসবগুলোয় কোনো কর্মসূচি থাকে না।

এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ কর্মসূচির নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন দুটো নানাভাবে কলকাতার বাবু সংস্কৃতির বয়ান তৈরি করে থাকে। আওয়ামী শাসনামলে সংগঠন দুটো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছে। এই সাংস্কৃতিক সংগঠন দুটোর শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা আমার দেশকে বলেছেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় দিকগুলো আনা হবে সাম্প্রদায়িকতা। ফলে তারা মুসলিম সংস্কৃতিকে আলাদাভাবে উদ্‌যাপন করতে চান না, যদিও তাদের অনুষ্ঠানগুলোয় বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে বলে মনে করেন অনেক সংস্কৃতি বিশ্লেষক।

ছায়ানটের বছরব্যাপী যত কর্মসূচি

রবীন্দ্রচর্চাকে সামনে রেখে ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট। সংগঠনটির জন্মকথায় বলা হয়েছে, তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তানি যুগে কঠোর সামরিক শাসনে পদানত স্বদেশে রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে। অর্থাৎ একমাত্র রবীন্দ্রনাথই ছায়ানটের কাছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক।

ছায়ানটের মূল অনুষ্ঠান রমনার বটমূলে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষে। নাম বাংলা নববর্ষের আবাহন। ঢাকার রমনা উদ্যানের অশ্বত্থ গাছের নিচে ১৯৬৭ সালের মধ্য এপ্রিলে হয়েছিল প্রথম অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানস্থলের নাম করা হয় বটমূল। শ্রোতার আসর নামে ছায়ানটের নিয়মিত একটি অনুষ্ঠান আছে। বছরে ছটি আসরের আয়োজন করে ছায়ানট। বাংলা মাসের চতুর্থ শুক্রবার সন্ধ্যায় ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের রমেশচন্দ্র দত্ত স্মৃতি মিলনকেন্দ্রে হয় এই অনুষ্ঠান।

ছায়ানট নিয়মিতভাবে ভাষাশহীদ দিবস পালন করে থাকে। ছায়ানটের আরেকটি নিয়মিত অনুষ্ঠান হচ্ছে ঋতু উৎসব। ষাটের দশক থেকেই ঋতু উৎসবের আয়োজন করে আসছে ছায়ানট। তবে উৎসবগুলো সীমাবদ্ধ কেবল বর্ষা, শরৎ ও বসন্ত ঋতু ঘিরে।

ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ওয়াহিদুল হকের ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে আয়োজন করা হয় প্রথম লোকসংগীত উৎসবের। পরের বছর থেকে এই আয়োজনের নাম হয় ওয়াহিদুল হক স্মারক দেশঘরের গান। এছাড়া ২০০৭ সাল থেকে শুদ্ধ সংগীত উৎসবের আয়োজন করে ছায়ানট। প্রতি বছরের শীতকালে এর আয়োজন হচ্ছে।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ১১ জ্যৈষ্ঠকে ঘিরে নিয়মিতভাবে দুদিনের নজরুল উৎসবের আয়োজন করে ছায়ানট। ছায়ানটের ভাষ্য, বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্মকে সাধারণের কাছে আরো সহজ করে তোলার লক্ষ্যে ১৪১৬ বঙ্গাব্দ থেকে বার্ষিক রবীন্দ্র-উৎসব করছে ছায়ানট।

১৪১৭ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে ছায়ানটের বছরব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার অংশ হলো রবীন্দ্র-নৃত্যোৎসব। বছর বছর নিয়মিত হচ্ছে এ উৎসব আয়োজন।

এছাড়া ছায়ানট বছরে নিয়মিত আয়োজন করে আসছে ২০ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুফিয়া কামাল এবং ২৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ওয়াহিদুল হকের প্রয়াণ দিবসের স্মরণানুষ্ঠান। ছায়ানট নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত বার্ষিক স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও একুশের অনুষ্ঠানমালায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানেও নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকে ছায়ানট।

বছরজুড়ে ছায়ানটের এত কর্মসূচির মধ্যে কেন বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব অনুষ্ঠানগুলোয় ছায়ানট কোনো কর্মসূচি দেয় না— এমন প্রশ্নের জবাবে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক ও ট্রাস্টি লাইসা আহমদ লিসা আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণ কামনা করে পহেলা বৈশাখ করি, যেটা সবার জন্য কমন। ঈদ, পূজা ও ক্রিসমাস জাতিভিত্তিক বা গোষ্ঠীভিত্তিক ব্যাপার। তার মতে, সব মানুষের কল্যাণ কামনা মানে হচ্ছে সবাইকে সম্পৃক্ত করা।

ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সংস্কৃতির অংশ— এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন, এমন প্রশ্নের জবাবে লাইসা লিসা বলেন, ‘আমি তো ঈদের নামাজ হিন্দু জাতিকে নিয়ে করতে পারব না। হিন্দুর পূজায় যেতে পারি, দেখতে পারি, আনন্দ করতে পারি কিন্তু পূজা করতে পারব না। ফলে কমন প্ল্যাটফর্ম কোনটা, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। যেটা সবার জন্য কমন, সবাইকে নিয়ে করা যায়, সেই জিনিসকে আমরা করেছি। কাউকে ছোট করা, খাটো করা, কী ধর্মাচারণ করব, কী পালন করব, তার সঙ্গে আসলে কোনো ব্যাপার নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সবার সমতার কথা ভাবি, কিন্তু বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর কথা নয়।’

কারা চালায় ছায়ানট

দীর্ঘদিন থেকে ছায়ানটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সন্জীদা খাতুন। গত ২৫ মার্চ তিনি ইন্তেকাল করেন। রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে তাকে চিরবিদায় জানানো নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। তার লাশ কবর দেওয়ার পরিবর্তে দান করা হয়েছে।

এ ছাড়া নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন ডা. সারওয়ার আলী। সহ-সভাপতি বাংলাদেশের ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তার সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর থেকে তিনি এখন অনেকটা অন্তরালে রয়েছেন। আরেকজন সহ-সভাপতি খায়রুল আনাম (শাকিল)। ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা। যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন পার্থ তানভীর নভেদ ও জয়ন্ত রায়। কোষাধ্যক্ষ নাসেহুন আমীন। এ ছাড়া ছায়ানটের পরিচালনায় সদস্য হিসেবে আছেন, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মাসুদা নার্গিস আনাম, সাহানা আখতার রহমান পাপড়ি, আমিনুল কাওসার খান দীপু, তানিয়া মান্নান, জুবায়ের ইউসুফ ও গৌতম কুমার সরকার।

ছায়ানট শুরু থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। এজন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছায়ানট সরকারি সমর্থন পেয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ছায়ানটকে সরকারিভাবে ধানমন্ডিতে এক বিঘা জমি প্রদান করা হয়, যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সংস্কৃতি ভবন। ছায়ানট বলছে, এই জমিতে সংস্কৃতি-ভবন নির্মাণ করে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপকতর অবদান রাখার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে ছায়ানট।

উদীচী

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন। এটি মূলত বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সাংস্কৃতিক কর্মীদের একটি ছায়া সংগঠন। তবে সংগঠনটির ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির। উদীচীর অধীনে সংগীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, চারুকলা ও সাহিত্য বিভাগ কাজ করছে। ১৯৬৮ সালে কথাশিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তসহ একঝাঁক বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তরুণ উদীচী গঠন করেন। বর্তমানে ৭১টি সাংগঠনিক জেলা সংসদ এবং জেলা সংসদের অধীনে ৩১৫টি শাখা রয়েছে। উদীচীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। দেশের বাইরেও উদীচীর ছয়টি শাখা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায়।

বছরজুড়ে সংগঠনটি জাতীয় বিভিন্ন দিবসসহ অন্তত ৪৫টি দিবস পালন করে থাকে, যার মধ্যে মার্কস, লেনিন ও প্রীতিলতা ওয়েদ্দারের জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। কিন্তু ঈদ, শবেবরাত কিংবা মহররমের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাদের কোনো কর্মসূচি থাকে না। মুসলমান মনীষীদের নিয়েও তাদের তেমন কোনো অনুষ্ঠান নেই।

উদীচীর দুই শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা যে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সাম্প্রদায়িকতা-দুষ্ট বলে মনে করেন। ধর্মের গুরুত্ব অস্বীকার না করলেও তারা এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করেন।

উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে আমার দেশকে বলেন, দেশের সংকট ও সম্ভাবনায় আমাদের কর্মসূচিগুলো থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চার নীতির আলোকে শোষণ-বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার বিষয়টি আমাদের সংগঠনের বেসিক কনসেপ্ট। উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক দিক উপেক্ষিত কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই, সুতরাং বিশেষ ধর্মের অুনষ্ঠানে আমরা সম্পৃক্ত হতে চাই না। যারা যে ধর্ম পালন করে, তারা সে ধর্ম পালন করবে। সংগঠনের কার্যক্রমে আমরা ধর্মকে আনতে চাই না।

উদীচীতে বামপন্থি সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রভাব বেশি থাকলেও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক তৎপরতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের নামে গত দেড় দশকে রাজপথে সংগঠনটি অসংখ্য ইসলামোফোবিক কর্মসূচি পালন করেছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে উদীচীর রয়েছে ঘনিষ্ঠতা। সরকারিভাবে উদীচী নানা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। ২০১৩ সালে হাসিনা সরকার উদীচীকে একুশে পদক প্রদান করে।

ছায়ানট ও উদীচীর বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতি উপেক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আমার দেশকে বলেন, কোনো নির্দিষ্ট সংগঠনের আয়োজন বা দর্শন নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আমি বরং আমাদের সরকারের দর্শন বলতে পারি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে আমরা প্রথমবারের মতো শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে চাঁদরাতে ঈদ উৎসবের আয়োজন করেছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মিলে ঈদ মিছিল এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। সামনে এটা দেশজুড়ে হবে। আমরা জানি ইসলামি রেওয়াজ বা ইসলামের গন্ধ আছে, এমন যে কোনো কিছুকে সাংস্কৃতিকভাবে বিয়োগ করার একটা প্রবণতা আমরা দেখে আসছিলাম। আমরা এটা থেকে বেরিয়ে এসেছি। এবারের নববর্ষের আয়োজনেও পরিবর্তন দেখতে পাবেন। আওয়ামী ফ‍্যাসিবাদী কালচারাল লীগের বিভক্তিমূলক আয়োজনের বিপরীতে বাংলাদেশের সব জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণমূলক উৎসব দেখবেন আপনারা। এসব আয়োজনের পেছনে দর্শন হয়ে আছে একটাই শব্দ ‘বাংলাদেশ’। মোট কথা, যা কিছু বাংলাদেশের তার সবই আমরা ধারণ করব। হেজেমনিক কালচারের এক্সক্লুশনের নীতির পরিবর্তে সব ধর্ম ও সব জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ইনক্লুশন হচ্ছে আমাদের মূলমন্ত্র।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি ও দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক আব্দুল হাই শিকদার মনে করেন, পাকিস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ছায়ানট ও উদীচীর জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর বিকাশ ও প্রভাব তৈরি হয়েছে ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ছায়ানট ও উদীচী ভারতীয় ন্যারেটিভ তৈরির দুটো মুখ। তারা বাঙালি মুসলমানের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি ধারণ করে না। সংস্কৃতির নামে সংগঠনগুলো রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত করেছে, যেমনটা শেখ মুজিবকে রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের আইকনে পরিণত করা হয়েছিল।

সমাজবিজ্ঞানী ও নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের (কাতার) সহকারী অধ্যাপক ড. হাসান মাহমুদ মনে করেন, ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সমাজবিজ্ঞান কিংবা নৃবিজ্ঞানের যে কোনো প্রারম্ভিক টেক্সট বইয়ে এই বিষয়টা পাওয়া যাবে। সমাজবিজ্ঞান বা নৃবিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান হচ্ছে, ধর্মকে সংস্কৃতি থেকে আলাদা করা যায় না। তিনি বলেন, উদীচী আর ছায়ানটের অনুষ্ঠানে ধর্মের কোনো প্রতিফলন থাকে না— এই দাবি বাংলাদেশের সেক্যুলাররা করে থাকে। আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। এই সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠানে যেসব আচার আর রীতি দেখা যায়, সেগুলো অবশ্যই কোনো না কোনো ধর্ম থেকেই আসে এবং সেই ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর বুকে এমন কোনো সংস্কৃতি নেই, যার মধ্যে ধর্ম নেই। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, প্রার্থনা সংগীত, হাতজোড় করে প্রণাম করা, কপালে লাল টিপ দেওয়া— এগুলো সবকিছুই কোনো না কোনো ধর্ম থেকেই এসেছে।