সুনামগঞ্জ ০১:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রথম বঙ্গবন্ধু মুন্সী মেহেরুল্লাহ

আহসান কবীর, যশোর
  • আপডেট সময় : ০৭:০৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫ ৪ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

‘বঙ্গবন্ধু’ বললেই দেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে বোঝেন। শেখ মুজিবের এই উপাধি বা খেতাব রাষ্ট্রীয় নয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় ছাত্রলীগের তখনকার নেতা তোফায়েল আহমেদ এই খেতাব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবকে।

তবে এরও প্রায় ৭৮ বছর আগে এই বাংলারই একজন সমাজ সংস্কারক ও ধর্ম প্রচারক মুন্সী মেহেরুল্লাহকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি বা খেতাব দেওয়া হয়েছিল। তাকে এই উপাধি দিয়েছিলেন লেখক ও সংগঠক মির্জা ইউসুফ আলী।

মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহই যে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিপ্রাপ্ত, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক ড. মো. জহুরুল ইসলাম। সাতক্ষীরার শ্যামনগর সরকারি মহসীন কলেজের এই শিক্ষক ‘মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ : হিজ লাইফ অ্যান্ড কন্ট্রিবিউশন’ শীর্ষক পিএইচডি অভিসন্দর্ভে এই তথ্য উদ্ধৃত করেছেন।

তিনি ২০০১ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে ড. মুহাম্মদ ইয়াহিয়া রহমানের তত্ত্বাবধানে এই অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

মেহেরুল্লাহর কর্মজীবনের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে ড. জহুরুল লেখেন, “…মুন্সী সাহেবের এরূপ জনপ্রিয়তা ও বাংলার অধিবাসীদের প্রতি সমান মমত্ববোধ ও দয়া থাকার কারণে তৎকালীন সভ্যসমাজ কর্তৃক প্রদেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি যথার্থই হয়েছে। প্রখ্যাত লেখক ও সমাজ সংস্কারক রাজশাহীর অধিবাসী মির্জা ইউসুফ আলী মুন্সী সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মির্জা ইউসুফ ১৮৯১ সালে রচিত তার প্রসিদ্ধ ও প্রথম মৌলিক গ্রন্থ ‘দুগ্ধ-সরোবর’- এর ভূমিকাতেই মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে আখ্যায়িত করেন।”

ড. জহুরুল বলছেন, “মির্জা ইউসুফের উক্ত গ্রন্থে সমকালীন মুসলিম বাংলার উন্নয়নমূলক যে মহাপরিকল্পনা উত্থাপিত হয়, তার পুরোগামী হিসেবে সমকালীন ‘বঙ্গবন্ধু’ মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।”

আমার দেশ-এর এক প্রশ্নে ড. জহুরুল বলেন, “থিসিস পেপারের ওপর আয়োজিত সেমিনারে পিএইচডি কমিটির সভাপতি তখনকার উপাচার্য ড. মোস্তাফিজুর রহমান আমাকে প্রশ্ন করেন, মুন্সী মেহেরুল্লাহ ‘বঙ্গবন্ধু’ হলেন কীভাবে? আমি রেফারেন্সসহ উত্তর দিয়ে ড. মোস্তাফিজুরসহ সেখানে উপস্থিত শতাধিক স্কলার ও মাস্টার্স লেভেলের শ’তিনেক শিক্ষার্থীকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হই। যথাযথ উত্তর না দিতে পারলে আমাকে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হতো না।”

মুন্সী মেহেরুল্লাহই যে বাংলার প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’, এ কথা লিখেছেন মতিউর রহমান মল্লিকও। ঢাকাভিত্তিক ‘প্রেক্ষণ সাহিত্য সংগঠন’ ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ স্মরণ সংখ্যা’ প্রকাশ করে। সেখানে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি মির্জা ইউসুফ আলী যে মুন্সী মেহেরুল্লাহকে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন, এ কথা জানিয়েছেন।

অধ্যাপক মুহম্মদ আবু তালিবের লেখা ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ : দেশ কাল সমাজ’ গ্রন্থ উদ্ধৃত করে একই নিবন্ধে বলা হয়, “সমকালীন মুসলিম মনীষীরা মুন্সী সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছেন।” নিবন্ধে তিনি মুন্সী মেহেরুল্লাহর কর্মজীবনের ওপর আলোকপাত করে তার অর্জিত অন্য সব খেতাবের কথাও উল্লেখ করেন। তার মধ্যে রয়েছেÑ ‘কর্মবীর’, ‘মোসলেমহিতৈষী’, ‘দীনের মশাল’ প্রভৃতি।

দৈনিক নয়াদিগন্তের সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করা লেখক, গবেষক নাসির হেলাল; মুন্সী মেহেরুল্লাহকে নিয়ে যার নিজেরও অনেক কাজ আছে। তিনি আমার দেশকে বলেন, মুন্সী মেহেরুল্লাহকেই যে এই জনপদে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করা হয়, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।

ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ধর্ম প্রচারক মির্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী তাকে ‘দুগ্ধ-সরোবর’ বইয়ে এই খেতাব দেন। ১৮৫৮ সালে জন্ম নেওয়া মির্জা ইউসুফ ১৮৯১ সালে ‘দুগ্ধ-সরোবর’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন, যার কপি এখন দুষ্প্রাপ্য।

মুন্সী মেহেরুল্লাহর পরিচয়

মুন্সী মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর মাতুলালয় যশোর জেলার তৎকালীন কালীগঞ্জ থানার (বর্তমানে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা) ঘোপ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন যশোর শহরের ৬-৭ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ছাতিয়ানতলা গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি বাবা মুন্সী মুহাম্মদ ওয়ারেছ উদ্দীনকে হারান।

বই ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন একটা পাননি মেহেরুল্লাহ। সামান্য আরবি, ফারসি ও উর্দু শিখেছিলেন। সেই বুনিয়াদে ছোটখাটো একটি চাকরি জুটে যায় যশোর জেলা বোর্ডে। কিন্তু স্বাধীনচেতা মেহেরুল্লাহ কিছুদিন বাদে চাকরি ছেড়ে শহরের দড়াটানা মোড়ে একটি দর্জির দোকান দিয়ে বসেন।

তখন ব্রিটিশ রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় মিশনারিরা তৎপর ছিল প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে স্থানীয় মুসলিম ও হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতকরণে। মেহেরুল্লাহও প্রথমে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি দার্জিলিং গিয়ে কিছু বইপত্র ও পত্রিকা হাতে পান। এগুলো পড়ে তার ভুল ভাঙে। ফিরে আসেন নিজ ধর্ম ইসলামে।

শুধু তা-ই নয়, এবার তিনি মিশনারিদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার শুরু করেন। মিশনারিরা যেখানে ইসলাম ও সনাতন ধর্মকে হেয় করে সভা করত, মেহেরুল্লাহও সেখানে পাল্টা কার্যক্রম পরিচালনায় লিপ্ত হন। একই সঙ্গে পাদ্রিদের লেখার জবাব লেখার মাধ্যমেই দিতে থাকেন। ক্রমে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলা ও আশপাশের এলাকায়। তার ধর্মসভাগুলোতে বিপুল লোকসমাগম হতে থাকে।

কারো কারো মতে, এখন ‘ওয়াজ মাহফিল’ নামে খ্যাত অনুষ্ঠান ‘ধর্মসভা’ নামে মুন্সী মেহেরুল্লাহই প্রবর্তন করেছিলেন বাংলা ভূমিতে।

মেহেরুল্লাহ উত্তরবঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৯০৭ সালের ৮ জুন ইন্তেকাল করেন অক্লান্ত পরিশ্রমী এই মানুষটি।

লেখক মেহেরুল্লাহ

জীবদ্দশায় মুন্সী মেহেরুল্লাহ বেশকিছু বই লিখেছেন। তার মধ্যে রয়েছেÑ খৃষ্টীয় ধর্মের অসারতা (১৮৮৬), মেহেরুল ইসলাম (১৮৯০), খৃষ্টান মুসলমান তর্ক-যুদ্ধ, বিধবা গঞ্জনা, পান্দনামাহ (১৯০৮), হিন্দুধর্ম রহস্য (১৮৯৬), রদ্দে খৃষ্টান ও দলিলোল ইসলাম (১৯০৯), ইসলামী বক্তৃতামালা (১৯০৮) এবং নবরত্নমালা বা বাংলা গজল (১৯১১)। এর বাইরেও মেহেরুল্লাহর লেখা আরো কিছু বইয়ের হদিস বের করেছেন গবেষক নাসির হেলাল।

যারা লিখেছেন

মুন্সী মেহেরুল্লাহর কর্ম, জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন দেশের প্রখ্যাত লেখক, গবেষক, কবি, দার্শনিকরা।

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেনÑ ফররুখ আহমদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী দীন মুহম্মদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, শেখ মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন ওরফে রেভারেন্ড জন জমিরুদ্দীন, আনিসুজ্জামান, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, শাহেদ আলী, নাসির হেলাল, শেখ হবিবর রহমান, মুহম্মদ আবু তালিব প্রমুখ।

মেহেরুল্লাহ সম্পর্কে পুস্তক রচনা করেছেন শেখ মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন, মোহাম্মদ আছিরউদ্দীন প্রধান, শেখ হবিবর রহমান, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, মুহম্মদ আবু তালিব, মুহম্মদ শাহাদাত আলী আনসারী, আবুল হাসনাত, দেওয়ান আবদুল হামিদ, জোবেদ আলী, মুহম্মদ জিলহজ আলী, নাসির হেলাল, এম এ মজিদ প্রমুখ।

নামের বানান বিভ্রাট : নাসির হেলাল সম্পাদিত ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ : জীবন ও কর্ম’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, “মুন্সী মহম্মদ মেহেরুল্লাহ’র নামের বানান নিয়ে জটিলতা রয়েছে। …আমরা মুন্সী সাহেবের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছি, তিনি সেখানে তার নামের বানান লিখেছেন ‘মহম্মদ মেহেরুল্লাহ’। অপরদিকে তার প্রথম ছেলে মনসুর আহমদের স্বহস্তে তৈরিকৃত তাদের বংশতালিকায় মুন্সী সাহেবের নামের বানান লেখা হয়েছে, ‘মুন্সী মহম্মদ মেহেরুল্লাহ।”

মুন্সী মেহেরুল্লাহর নামে নামকরণ

যশোরে মুন্সী মেহেরুল্লাহর নামে বেশকিছু স্থাপনা, স্থান ও সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে যশোর শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত টাউন হল মাঠের নামকরণ করা হয়েছে ‘মুনশী মেহেরুল্লাহ ময়দান’। শহরের একটি সড়ক ছাড়াও রেলওয়ের একটি স্টেশন রয়েছে তার নামে। রয়েছে বাড়ির পাশে ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ অ্যাকাডেমি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুন্সী মেহেরুল্লাহ স্বয়ং। সম্প্রতি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত একটি ছাত্রাবাসের নাম মুন্সী সাহেবের নামে করা হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

প্রথম বঙ্গবন্ধু মুন্সী মেহেরুল্লাহ

আপডেট সময় : ০৭:০৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

‘বঙ্গবন্ধু’ বললেই দেশের মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে বোঝেন। শেখ মুজিবের এই উপাধি বা খেতাব রাষ্ট্রীয় নয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় ছাত্রলীগের তখনকার নেতা তোফায়েল আহমেদ এই খেতাব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবকে।

তবে এরও প্রায় ৭৮ বছর আগে এই বাংলারই একজন সমাজ সংস্কারক ও ধর্ম প্রচারক মুন্সী মেহেরুল্লাহকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি বা খেতাব দেওয়া হয়েছিল। তাকে এই উপাধি দিয়েছিলেন লেখক ও সংগঠক মির্জা ইউসুফ আলী।

মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহই যে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিপ্রাপ্ত, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক ড. মো. জহুরুল ইসলাম। সাতক্ষীরার শ্যামনগর সরকারি মহসীন কলেজের এই শিক্ষক ‘মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ : হিজ লাইফ অ্যান্ড কন্ট্রিবিউশন’ শীর্ষক পিএইচডি অভিসন্দর্ভে এই তথ্য উদ্ধৃত করেছেন।

তিনি ২০০১ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে ড. মুহাম্মদ ইয়াহিয়া রহমানের তত্ত্বাবধানে এই অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

মেহেরুল্লাহর কর্মজীবনের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে ড. জহুরুল লেখেন, “…মুন্সী সাহেবের এরূপ জনপ্রিয়তা ও বাংলার অধিবাসীদের প্রতি সমান মমত্ববোধ ও দয়া থাকার কারণে তৎকালীন সভ্যসমাজ কর্তৃক প্রদেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি যথার্থই হয়েছে। প্রখ্যাত লেখক ও সমাজ সংস্কারক রাজশাহীর অধিবাসী মির্জা ইউসুফ আলী মুন্সী সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মির্জা ইউসুফ ১৮৯১ সালে রচিত তার প্রসিদ্ধ ও প্রথম মৌলিক গ্রন্থ ‘দুগ্ধ-সরোবর’- এর ভূমিকাতেই মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে আখ্যায়িত করেন।”

ড. জহুরুল বলছেন, “মির্জা ইউসুফের উক্ত গ্রন্থে সমকালীন মুসলিম বাংলার উন্নয়নমূলক যে মহাপরিকল্পনা উত্থাপিত হয়, তার পুরোগামী হিসেবে সমকালীন ‘বঙ্গবন্ধু’ মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।”

আমার দেশ-এর এক প্রশ্নে ড. জহুরুল বলেন, “থিসিস পেপারের ওপর আয়োজিত সেমিনারে পিএইচডি কমিটির সভাপতি তখনকার উপাচার্য ড. মোস্তাফিজুর রহমান আমাকে প্রশ্ন করেন, মুন্সী মেহেরুল্লাহ ‘বঙ্গবন্ধু’ হলেন কীভাবে? আমি রেফারেন্সসহ উত্তর দিয়ে ড. মোস্তাফিজুরসহ সেখানে উপস্থিত শতাধিক স্কলার ও মাস্টার্স লেভেলের শ’তিনেক শিক্ষার্থীকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হই। যথাযথ উত্তর না দিতে পারলে আমাকে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হতো না।”

মুন্সী মেহেরুল্লাহই যে বাংলার প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’, এ কথা লিখেছেন মতিউর রহমান মল্লিকও। ঢাকাভিত্তিক ‘প্রেক্ষণ সাহিত্য সংগঠন’ ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ স্মরণ সংখ্যা’ প্রকাশ করে। সেখানে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি মির্জা ইউসুফ আলী যে মুন্সী মেহেরুল্লাহকে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন, এ কথা জানিয়েছেন।

অধ্যাপক মুহম্মদ আবু তালিবের লেখা ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ : দেশ কাল সমাজ’ গ্রন্থ উদ্ধৃত করে একই নিবন্ধে বলা হয়, “সমকালীন মুসলিম মনীষীরা মুন্সী সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে সম্বোধন করেছেন।” নিবন্ধে তিনি মুন্সী মেহেরুল্লাহর কর্মজীবনের ওপর আলোকপাত করে তার অর্জিত অন্য সব খেতাবের কথাও উল্লেখ করেন। তার মধ্যে রয়েছেÑ ‘কর্মবীর’, ‘মোসলেমহিতৈষী’, ‘দীনের মশাল’ প্রভৃতি।

দৈনিক নয়াদিগন্তের সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করা লেখক, গবেষক নাসির হেলাল; মুন্সী মেহেরুল্লাহকে নিয়ে যার নিজেরও অনেক কাজ আছে। তিনি আমার দেশকে বলেন, মুন্সী মেহেরুল্লাহকেই যে এই জনপদে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করা হয়, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।

ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ধর্ম প্রচারক মির্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী তাকে ‘দুগ্ধ-সরোবর’ বইয়ে এই খেতাব দেন। ১৮৫৮ সালে জন্ম নেওয়া মির্জা ইউসুফ ১৮৯১ সালে ‘দুগ্ধ-সরোবর’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন, যার কপি এখন দুষ্প্রাপ্য।

মুন্সী মেহেরুল্লাহর পরিচয়

মুন্সী মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ২৬ ডিসেম্বর মাতুলালয় যশোর জেলার তৎকালীন কালীগঞ্জ থানার (বর্তমানে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা) ঘোপ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন যশোর শহরের ৬-৭ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ছাতিয়ানতলা গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি বাবা মুন্সী মুহাম্মদ ওয়ারেছ উদ্দীনকে হারান।

বই ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন একটা পাননি মেহেরুল্লাহ। সামান্য আরবি, ফারসি ও উর্দু শিখেছিলেন। সেই বুনিয়াদে ছোটখাটো একটি চাকরি জুটে যায় যশোর জেলা বোর্ডে। কিন্তু স্বাধীনচেতা মেহেরুল্লাহ কিছুদিন বাদে চাকরি ছেড়ে শহরের দড়াটানা মোড়ে একটি দর্জির দোকান দিয়ে বসেন।

তখন ব্রিটিশ রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় মিশনারিরা তৎপর ছিল প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে স্থানীয় মুসলিম ও হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতকরণে। মেহেরুল্লাহও প্রথমে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি দার্জিলিং গিয়ে কিছু বইপত্র ও পত্রিকা হাতে পান। এগুলো পড়ে তার ভুল ভাঙে। ফিরে আসেন নিজ ধর্ম ইসলামে।

শুধু তা-ই নয়, এবার তিনি মিশনারিদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার শুরু করেন। মিশনারিরা যেখানে ইসলাম ও সনাতন ধর্মকে হেয় করে সভা করত, মেহেরুল্লাহও সেখানে পাল্টা কার্যক্রম পরিচালনায় লিপ্ত হন। একই সঙ্গে পাদ্রিদের লেখার জবাব লেখার মাধ্যমেই দিতে থাকেন। ক্রমে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলা ও আশপাশের এলাকায়। তার ধর্মসভাগুলোতে বিপুল লোকসমাগম হতে থাকে।

কারো কারো মতে, এখন ‘ওয়াজ মাহফিল’ নামে খ্যাত অনুষ্ঠান ‘ধর্মসভা’ নামে মুন্সী মেহেরুল্লাহই প্রবর্তন করেছিলেন বাংলা ভূমিতে।

মেহেরুল্লাহ উত্তরবঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৯০৭ সালের ৮ জুন ইন্তেকাল করেন অক্লান্ত পরিশ্রমী এই মানুষটি।

লেখক মেহেরুল্লাহ

জীবদ্দশায় মুন্সী মেহেরুল্লাহ বেশকিছু বই লিখেছেন। তার মধ্যে রয়েছেÑ খৃষ্টীয় ধর্মের অসারতা (১৮৮৬), মেহেরুল ইসলাম (১৮৯০), খৃষ্টান মুসলমান তর্ক-যুদ্ধ, বিধবা গঞ্জনা, পান্দনামাহ (১৯০৮), হিন্দুধর্ম রহস্য (১৮৯৬), রদ্দে খৃষ্টান ও দলিলোল ইসলাম (১৯০৯), ইসলামী বক্তৃতামালা (১৯০৮) এবং নবরত্নমালা বা বাংলা গজল (১৯১১)। এর বাইরেও মেহেরুল্লাহর লেখা আরো কিছু বইয়ের হদিস বের করেছেন গবেষক নাসির হেলাল।

যারা লিখেছেন

মুন্সী মেহেরুল্লাহর কর্ম, জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন দেশের প্রখ্যাত লেখক, গবেষক, কবি, দার্শনিকরা।

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেনÑ ফররুখ আহমদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান, কাজী দীন মুহম্মদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, শেখ মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন ওরফে রেভারেন্ড জন জমিরুদ্দীন, আনিসুজ্জামান, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, শাহেদ আলী, নাসির হেলাল, শেখ হবিবর রহমান, মুহম্মদ আবু তালিব প্রমুখ।

মেহেরুল্লাহ সম্পর্কে পুস্তক রচনা করেছেন শেখ মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন, মোহাম্মদ আছিরউদ্দীন প্রধান, শেখ হবিবর রহমান, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, মুহম্মদ আবু তালিব, মুহম্মদ শাহাদাত আলী আনসারী, আবুল হাসনাত, দেওয়ান আবদুল হামিদ, জোবেদ আলী, মুহম্মদ জিলহজ আলী, নাসির হেলাল, এম এ মজিদ প্রমুখ।

নামের বানান বিভ্রাট : নাসির হেলাল সম্পাদিত ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ : জীবন ও কর্ম’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, “মুন্সী মহম্মদ মেহেরুল্লাহ’র নামের বানান নিয়ে জটিলতা রয়েছে। …আমরা মুন্সী সাহেবের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছি, তিনি সেখানে তার নামের বানান লিখেছেন ‘মহম্মদ মেহেরুল্লাহ’। অপরদিকে তার প্রথম ছেলে মনসুর আহমদের স্বহস্তে তৈরিকৃত তাদের বংশতালিকায় মুন্সী সাহেবের নামের বানান লেখা হয়েছে, ‘মুন্সী মহম্মদ মেহেরুল্লাহ।”

মুন্সী মেহেরুল্লাহর নামে নামকরণ

যশোরে মুন্সী মেহেরুল্লাহর নামে বেশকিছু স্থাপনা, স্থান ও সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে যশোর শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত টাউন হল মাঠের নামকরণ করা হয়েছে ‘মুনশী মেহেরুল্লাহ ময়দান’। শহরের একটি সড়ক ছাড়াও রেলওয়ের একটি স্টেশন রয়েছে তার নামে। রয়েছে বাড়ির পাশে ‘মুন্সী মেহেরুল্লাহ অ্যাকাডেমি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুন্সী মেহেরুল্লাহ স্বয়ং। সম্প্রতি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত একটি ছাত্রাবাসের নাম মুন্সী সাহেবের নামে করা হয়েছে।