ঢাকা ০২:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

শাপলা, হেফাজত : নূর মোহাম্মদ

নূর মোহাম্মদ আবু তাহের
  • আপডেট সময় : ০৬:০৭:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫
  • / 120
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ভদ্রমহিলা প্রায়শই ফোন দিয়ে বলতেন— ‘বাবা, তুমি ভালো আছো তো?’

০৫ মে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার এক শহিদের স্ত্রীর কথা বলছি।

সেদিন ৫ মে, ২০১৩।

সারাদিন ইট ছোঁড়ার বিনিময়ে শত শত গুলি আর টিয়ারশেল উপহার পেয়ে সন্ধ্যার পর ক্লান্ত হয়ে দৈনিক বাংলা মোড়ে বসে আছি। রোড ডিভাইডারের ঠিক ওপরে।

এক সফেদ দাঁড়ি ভরা মুখের বাবার বয়সী ভদ্রলোকও আমার পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

আমি ফোনে স্বজনদের সাথে কথা বলছিলাম। লোকটি অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

বিরক্ত হলাম।

ফোন রেখে বললাম আমাকে কিছু বলবেন?

লোকটি ইতস্তত করছিল। বুঝলাম কিছু বলবে। আবার বললাম—বলুন, কী বলতে চান।

খুব সাধারন একজন মানুষ মনে হলো। পোষাক দেখে মনে হলো শ্রমজীবি মানুষ। ইতস্ততা ভেঙ্গে বললেন—’বাবা তোমার মোবাইল থেকে আমার পরিবারকে একটা মিসকল দেবে?’

আমি বুঝলাম ওনার কাছে মোবাইল নাই। হয় তো সংঘর্ষের সময় হারিয়ে গেছে, নয়তো ওনার মোবাইলই নাই।

আমি বললাম—’না আমার ফোন থেকে মিসকল দিতে পারবেন না।’

লোকটি এমন জবাব হজম করে চুপ হয়ে গেল।

ইষৎ হেসে বললাম—’মিসকল নয়; কল দিতে পারবেন। নিন কথা বলুন।’

লোকটি ফোনে কী বলেছিল— স্পষ্ট মনে নেই। এতটুকু শুনলাম— ‘ভালো আছি, রাতে থাকতে হবে, দুআ করো, টেনশন করো না’।

এরপর আমি আর ওনি হারিয়ে গেলাম ভীড়ের মাঝে।

রাত ১১.০০ টার দিকে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসল।

রিসিভ করতেই বলল—’তুমি এখন কোথায়?’

ভাষার টোন শুনে বুঝলাম সন্ধ্যার সেই নম্বর। বললাম আপনার সেই মানুষটি এখন আর আমার পাশে নেই। তবে ভালো আছে। কোনো সমস্যা নেই।

৬ মে, আবার সেই নম্বর থেকে ফোন। বুঝলাম লোকটির খোঁজ চাইবে। ফোন ধরলাম না। বারবার ফোন। অবশেষে রিসিভ করলাম। হাউমাউ করে শুধু কান্না শুনলাম। প্রশ্ন একটাই—ওনি কোথায়?

বললাম, জানি না। তবে আল্লাহ চাহে তো ভালো আছে। বিকালেই বাসাই ফিরবে ইনশাআল্লাহ।

বিকালে ফোন।
কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।

রাতে ফোন। কান্না।

এবার আমিও কাঁদলাম। মিছে কিছু শান্তনা দিলাম। সেই শান্তনা অনেকদিন ধরে দিয়ে গেছি।

২০১৩ থেক ২০২৫।
১২ বছর চলে গেল।

সেই মায়ের সাথে লম্বা সময় ধরে যোগাযোগ ছিল। ২/৩ বছর পূর্বে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। তিনি হয়তো আছেন, হয়তো নাই৷ নিজ জীবনকে ফুলে ফলে সুশোভিত করতে গিয়ে শহিদের পরিবারকে ভুলে গেছি।

মুক্ত বাংলাদেশে আজকের দিনটাতে শহিদের সম্মানিতা স্ত্রীকে অনেককিছু বলার ছিল।

৫ মের সেই সফেদ শুভ্র শহিদকে আজ খুব মনে পড়ছে। খুব…

ঘুমাও তুমি বীর। ওপাড়ের সুন্দর ভূবনে। আমরা জেগে আছি অতন্দ্র প্রহরী।

অভ্যুত্থানকারী তরুণদেরও অনেকে ভয়াল ০৫ মে দেখেনি।

আহ! কী নিষ্ঠুর ছিল সে রাত! কী বিভৎস!

ঈমানদীপ্ত সে মানুষগুলোর বীরত্বগাঁথা ভুলে যাওয়া যাবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাদের বীরোচিত গল্পগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে৷

#শাপলা
#হেফাজত

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

শাপলা, হেফাজত : নূর মোহাম্মদ

আপডেট সময় : ০৬:০৭:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ মে ২০২৫

ভদ্রমহিলা প্রায়শই ফোন দিয়ে বলতেন— ‘বাবা, তুমি ভালো আছো তো?’

০৫ মে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার এক শহিদের স্ত্রীর কথা বলছি।

সেদিন ৫ মে, ২০১৩।

সারাদিন ইট ছোঁড়ার বিনিময়ে শত শত গুলি আর টিয়ারশেল উপহার পেয়ে সন্ধ্যার পর ক্লান্ত হয়ে দৈনিক বাংলা মোড়ে বসে আছি। রোড ডিভাইডারের ঠিক ওপরে।

এক সফেদ দাঁড়ি ভরা মুখের বাবার বয়সী ভদ্রলোকও আমার পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

আমি ফোনে স্বজনদের সাথে কথা বলছিলাম। লোকটি অপলক আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

বিরক্ত হলাম।

ফোন রেখে বললাম আমাকে কিছু বলবেন?

লোকটি ইতস্তত করছিল। বুঝলাম কিছু বলবে। আবার বললাম—বলুন, কী বলতে চান।

খুব সাধারন একজন মানুষ মনে হলো। পোষাক দেখে মনে হলো শ্রমজীবি মানুষ। ইতস্ততা ভেঙ্গে বললেন—’বাবা তোমার মোবাইল থেকে আমার পরিবারকে একটা মিসকল দেবে?’

আমি বুঝলাম ওনার কাছে মোবাইল নাই। হয় তো সংঘর্ষের সময় হারিয়ে গেছে, নয়তো ওনার মোবাইলই নাই।

আমি বললাম—’না আমার ফোন থেকে মিসকল দিতে পারবেন না।’

লোকটি এমন জবাব হজম করে চুপ হয়ে গেল।

ইষৎ হেসে বললাম—’মিসকল নয়; কল দিতে পারবেন। নিন কথা বলুন।’

লোকটি ফোনে কী বলেছিল— স্পষ্ট মনে নেই। এতটুকু শুনলাম— ‘ভালো আছি, রাতে থাকতে হবে, দুআ করো, টেনশন করো না’।

এরপর আমি আর ওনি হারিয়ে গেলাম ভীড়ের মাঝে।

রাত ১১.০০ টার দিকে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসল।

রিসিভ করতেই বলল—’তুমি এখন কোথায়?’

ভাষার টোন শুনে বুঝলাম সন্ধ্যার সেই নম্বর। বললাম আপনার সেই মানুষটি এখন আর আমার পাশে নেই। তবে ভালো আছে। কোনো সমস্যা নেই।

৬ মে, আবার সেই নম্বর থেকে ফোন। বুঝলাম লোকটির খোঁজ চাইবে। ফোন ধরলাম না। বারবার ফোন। অবশেষে রিসিভ করলাম। হাউমাউ করে শুধু কান্না শুনলাম। প্রশ্ন একটাই—ওনি কোথায়?

বললাম, জানি না। তবে আল্লাহ চাহে তো ভালো আছে। বিকালেই বাসাই ফিরবে ইনশাআল্লাহ।

বিকালে ফোন।
কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।

রাতে ফোন। কান্না।

এবার আমিও কাঁদলাম। মিছে কিছু শান্তনা দিলাম। সেই শান্তনা অনেকদিন ধরে দিয়ে গেছি।

২০১৩ থেক ২০২৫।
১২ বছর চলে গেল।

সেই মায়ের সাথে লম্বা সময় ধরে যোগাযোগ ছিল। ২/৩ বছর পূর্বে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। তিনি হয়তো আছেন, হয়তো নাই৷ নিজ জীবনকে ফুলে ফলে সুশোভিত করতে গিয়ে শহিদের পরিবারকে ভুলে গেছি।

মুক্ত বাংলাদেশে আজকের দিনটাতে শহিদের সম্মানিতা স্ত্রীকে অনেককিছু বলার ছিল।

৫ মের সেই সফেদ শুভ্র শহিদকে আজ খুব মনে পড়ছে। খুব…

ঘুমাও তুমি বীর। ওপাড়ের সুন্দর ভূবনে। আমরা জেগে আছি অতন্দ্র প্রহরী।

অভ্যুত্থানকারী তরুণদেরও অনেকে ভয়াল ০৫ মে দেখেনি।

আহ! কী নিষ্ঠুর ছিল সে রাত! কী বিভৎস!

ঈমানদীপ্ত সে মানুষগুলোর বীরত্বগাঁথা ভুলে যাওয়া যাবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাদের বীরোচিত গল্পগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে৷

#শাপলা
#হেফাজত