ইসলামী নৈতিকতা ও মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর সমন্বয় ঘটাতে হবে

- আপডেট সময় : ০৫:১৪:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫ ৬৯ বার পড়া হয়েছে
১। আমি যখন প্রথম ওয়েষ্টে (কানাডাতে) আসি, তখন বাংলাদেশী মুসলিম কমিউনিটির মধ্যে অনেককে বলতে শুনেছি, পাশ্চাত্যের সমাজ প্রাচ্যের চাইতে অনেক “ইসলামিক”। এইখানে আইন-আদালত, নিয়ম-কানুন সব ভাল। আমাদের দেশের মত ঘুষ দুর্নীতি নাই। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা আছে। কিন্তু এই আর্গুমেন্টের সাথে আমি খুব বেশী একমত হইতে পারি নাই। কারণ হইল, এইগুলো সবই মুয়ামেলাত। মুয়ামেলাত ইসলামের অবিচ্ছেদ্য পার্ট, কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ইসলাম তো শুরু হয় তাওহীদ দিয়া। ইহকাল ইবাদতের জায়গা, কাজের জায়গা, কিন্তু ইসলামের টার্গেট তো পরকাল। পাশ্চাত্যের যে আধুনিকতা, এইটার শুরু আর শেষ দুইটাই ইহকাল দিয়া, ধর্মচিন্তা থেকে অনেকটা সরে এসে মানুষের ইহিজাগতিকতা নিয়াই এর কাজ কারবার। ফলে মুয়ামেলাতের দিক দিয়ে আগানো হইলেও, তাওহীদের দিক থেকে, দুনিয়া বাদ দিয়া পরকালের দিকে মুখ ফেরানোর দিক থেকে এরা এত বেশী পিছানো যে, এইটারে কোন বিচারেই ভাল “ইসলামিক” বলার সুযোগ নাই।
২। আবার, এই যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকে ক্রমাগত সরে গিয়ে সেকুলার হয়ে যাওয়া, কনজারভেটিভ ক্রিশ্চিয়ানিটি থেকেও সরে যাওয়া, এবং ফ্যামিলি ভ্যালুজ এর ক্রমাগত অবক্ষয় – এইগুলোর কারনে অনেকে মনে করেন পাশ্চাত্য সমাজে কোন নীতি নাই, এই সমাজ টিকবেই না। এইটাও আমার কাছে প্রান্তিক অব্জারভেশান বলে মনে হয়। যেমন একটা উদাহরণ দেই। কোভিডের সময় এর প্রথম দিকে, যখন লোকজন বুঝতে পারছিল না এইটা কতখানি সিরিয়াস, আমাদের দেশে একটা-দুইটা এই ঘটনা ঘটছে যে হাসপাতালে বৃদ্ধ রোগীকে ফেলে আত্মীয়-স্বজন ভয়ে চলে গেছে। পাশ্চাত্যে তো এই রকম হাজার হাজার ঘটনা ঘটার কথা ছিল। কিন্তু ঘটে নাই । সামহাউ, খুব স্ট্রং পারিবারিক স্ট্রাকচারের অনুপস্থিতিতেও এই রকম একটা ক্রাইসিস মোকাবিলার শক্তি, মেকানিজম তাদের সমাজে-রাষ্ট্রে তারা তৈরি করতে পারছে।
৩। মাওলানা মওদুদী এই বৈপিরত্যকে ব্যাখ্যা করেছেন ইসলামী নৈতিকতা আর মৌলিক মানবীয় গুণাবলী দিয়ে। মাওলানার মতে, যদি কোন জাতির মধ্যে একই সাথে ইসলামী নৈতিকতা আর মৌলিক মানবীয় গুণাবলী দুইটাই থাকে তাইলে আল্লাহ্ সেই জাতিকে নেতৃত্ব দিবেন। কিন্তু যদি দুইটা এক সাথে না থাকে, তাইলে যাদের মধ্যে মৌলিক মানবীয় গুণাবলী বেশি আছে এবং জাগতিক উপায় উপকরণ ব্যবহার করার যোগ্যতা আছে আল্লাহ তাদেরকে নেতৃত্ব দিবেন।
৪। কাজেই, ইসলামী রাজনীতির টার্গেট শুধু তাওহীদ বেইজড সিস্টেমে ফিরে যাওয়াই না, সেই সিস্টেম যে একই সাথে মুয়ামেলাতের দিক থেকে মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে সেইটাও নিশ্চিত করা। শুধু সংবিধানে ইসলাম লিখে দিলে আর শরিয়ার হদ আইন বাস্তবায়ন করলেই একটা রাষ্ট্র আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে উঠবে না। সে ন্যায় বিচার দিতে পারবে কিনা, সেইটাও নিশ্চিত করতে হবে। মুয়ামেলাতের দিক থেকে, বিভিন্ন আধুনিক সিস্টেমের দিক থেকে যেহেতু পাশ্চাত্য এগিয়ে আছে, তাদের কাছ থেকে তাদের ভালটুকু আমাদের শিখতে হবে, নিতে হবে। ইসলামের সাথে যদি কন্ট্রাডিক্ট না করে তাইলে এইটা নেয়া ইসলামে নাজায়েজ না।
৫। কিন্তু জীবন জগত সম্পর্কে যে নৈতিক ধারনা, আইনের মাকাসিদ সংক্রান্ত ধারনা, আইনের স্পষ্ট ফ্রেইমওয়ার্ক, এবং তাওহীদ বেইজড যে ওয়ার্ল্ড ভিউ – এইটা নিতে হবে আমাদের নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে। কুরআন থেকে, রাসুল (সা. ) এর সুন্নাহ থেকে। মানুষের জন্য আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞায় যে সিস্টেম আমাদেরকে আল্লাহ দিছেন, তাতেই যে আমাদের সব চেয়ে বেশী কল্যাণ, তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। কোরআন-সুন্নাহ যেইখানে আমাদের স্পষ্টভাবে আইন বা সিস্টেম দিয়েছে, সেইখানে সেইটাই বেস্ট। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আল্লাহ আমাদেরকে শুধু মুলনীতি দিয়েছেন আর সেই মুলনীতির উপরে দাড়াইয়া ইসলামী সিস্টেম আমাদের নিজেদের প্রজ্ঞা দিয়ে আমাদের তৈরি করে নিতে হবে। এই প্রজ্ঞার জায়গায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে আমাদের ইনপুট নিতে হবে।
৬। একই সাথে বর্তমান সেকুলার সিস্টেম থেকে ইসলামী সিস্টেমে উত্তরনের পদ্ধতি হইতে হবে ধাপে ধাপে। কয়েকশ বছরের উপনিবেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রজন্ম, যার শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি – সব কিছুই আধুনিক সেকুলার সিস্টেমের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে, তারে জোর কইরা, হঠাত কইরা পরিবর্তন করা যাবে না। প্রায়োরিটি ঠিক করে আমাদের ধাপে ধাপে আগাইতে হবে। আমাদের নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনা, তাকওয়া আর মৌলিক মানবীয় গুণাবলীতে উন্নতি ঘটানোর মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে এগোতে হবে।