জাতীয় কবির জন্মদিনে নতুন করে জাগুক বিদ্রোহ ও প্রেমের চেতনা

- আপডেট সময় : ০১:২১:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫ ৫৭ বার পড়া হয়েছে
আজ ২৪ মে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
দারিদ্র্য, শৈশবের কঠোর সংগ্রাম ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের রূঢ় বাস্তবতা তাঁকে এক অদম্য সৃষ্টিশীলতায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই প্রেরণাই তাঁকে পরিণত করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায়।
নজরুল ছিলেন বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীলতার এক বিরল প্রতিভা। কবিতা, গান, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, অনুবাদ—সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’ শুধু একটি কাব্য নয়, এক প্রজন্মের চেতনা, স্বাধীনতার প্রত্যয়। এছাড়াও ‘আনন্দময়ীর আগমনে’, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘মানুষ’ প্রভৃতি রচনায় ফুটে উঠেছে তাঁর সমাজভাবনা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক দর্শন।
নজরুলের লেখনীতে সমানভাবে প্রতিফলিত হয়েছে প্রেম ও বিপ্লব, সংগ্রাম ও স্নেহ, বিদ্রোহ ও করুণা। তিনি ছিলেন কেবল কবি নন, তিনি ছিলেন এক সামাজিক বিপ্লবের ভাষ্যকার। যখন সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও ধর্মীয় সংকীর্ণতা সমাজকে গ্রাস করে ফেলছিল, তখন নজরুল সাহসিকতার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন—“গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।”
বাংলা সংগীতের ভুবনেও নজরুল এক অনন্য পথপ্রদর্শক। হাজারাধিক গানের স্রষ্টা তিনি, যা ‘নজরুলগীতি’ নামে পরিচিত। এসব গানে তিনি সমান দক্ষতায় তুলে ধরেছেন প্রেম, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, ইসলামী ভাবধারা, শ্যামাসংগীত ও দার্শনিকতা। রাগ-রাগিণীর সূক্ষ্ম ব্যবহার, ছন্দের ব্যতিক্রমী বিন্যাস এবং আরবী-ফারসী শব্দের মুন্সিয়ানাপূর্ণ প্রয়োগ বাংলা গানে নজরুলকে দিয়েছে এক স্বাতন্ত্র্য মর্যাদা।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার এক জীবন্ত প্রতীক। তিনি নিজ ধর্ম ইসলামকে ধারণ করেও হিন্দু পুরাণ, সংস্কৃতি ও সমাজকে আত্মস্থ করেছেন চমৎকার সাহসিকতায়। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ‘কৃষ্ণ’, ‘কালী’, ‘দুর্গা’র পাশাপাশি ‘আল্লাহ’, ‘নবী’, ‘আজান’-এর ছায়াও।
তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্ম নয়—মানুষই শ্রেষ্ঠ। তিনি লিখেছেন:
“এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য;
এক হাতে দীপ, আর হাতে জ্বলন্ত মশাল।”
তাঁর এই দ্বৈত চেতনা সমাজকে দিয়েছেন সহাবস্থানের একটি মানবিক পথ। আজকের দিনে যখন ধর্মীয় বিভাজন সমাজকে গ্রাস করতে চায়, তখন নজরুলের চেতনা এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নজরুলের কলম ছিল বজ্রকঠিন। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক বোধ ও বিদ্রোহ। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। তবুও তিনি থেমে যাননি। জেলে বসে লিখেছিলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, যেখানে উঠে এসেছে তাঁর আপসহীন মনোভাব।
তিনি শুধু রাজনীতি নয়, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও ছিলেন কণ্ঠস্বর। নারীর অধিকার, শ্রমিকের মর্যাদা, দারিদ্র্য দূরীকরণ—সব ক্ষেত্রেই তাঁর চিন্তা ছিল প্রগতিশীল ও সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান ও কবিতা হয়ে উঠেছিল অনুপ্রেরণার উৎস। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান কবি। তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে।
আজ যখন সমাজে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সামাজিক বৈষম্য ও মানসিক সংকীর্ণতা বেড়ে চলেছে, তখন নজরুলের ভাবনা, আদর্শ ও সাহসিকতা নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তাঁর সাহিত্য আমাদের শেখায় প্রতিবাদ করতে, ভালোবাসতে ও মানবতাকে শ্রদ্ধা করতে।
জাতীয় কবির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে হলে তাঁর সাহিত্য ও চেতনাকে শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে নজরুলের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নজরুল ইনস্টিটিউট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে নজরুল চর্চার পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
আজ জাতীয় কবির জন্মদিনে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আমরা প্রত্যাশা করি, বিদ্রোহী কবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে উঠুক একটি সাম্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতাভিত্তিক বাংলাদেশ।