বর্ষার জলে টইটম্বুর হাওরের জলরাশি যেন এক বিশাল নীলাভ সমুদ্র। দিগন্ত ছোঁয়া এই জলধারার মাঝে মাঝে দেখা যায় সবুজে ঘেরা চর, গাছপালার ছায়া, পাখির কোলাহল আর সূর্যের ঝলকানি। সকালবেলার কুয়াশা মোড়া দৃশ্য, দুপুরের দীপ্ত রোদ্দুর আর সন্ধ্যার নরম আলোতে হাওরের সৌন্দর্য হয়ে ওঠে অপার্থিব।
রাতে হাউসবোটে বসে উপভোগ করা যায় জলজোছনার দৃশ্য—চাঁদের আলো পানিতে পড়ে এক অপার সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। একদিকে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা, অন্যদিকে জলের উপর ভাসমান জীবন—এ যেন এক ধ্যানমগ্ন অভিজ্ঞতা।
এবারের ঈদকে কেন্দ্র করে টাংগুয়ার হাওরে নতুন করে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক শতাধিক হাউসবোট। এসব হাউসবোটে রয়েছে—
আরামদায়ক শয়নকক্ষ,পরিবার ও বন্ধুদের জন্য পৃথক কেবিন,নিরাপদ বাথরুম ব্যবস্থা,সোলার বিদ্যুৎ,স্থানীয় রান্নার স্বাদে রেস্তোরাঁ সুবিধা,লাইফ জ্যাকেটসহ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী,পর্যটন গাইড ও নেভিগেশন সুবিধা।
হাউসবোটে থাকাকালীন পর্যটকরা হাওরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে—
ভারত সীমান্তঘেঁষা একটি স্বচ্ছ জলাধার নীলাদ্রি লেক,
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পাহাড়ি টিলা বারিক টিলা,
স্বচ্ছ জল ও স্রোতের গাঙ জাদুকাটা নদী,
প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য লাউড়ের গড়, এশিয়ার বৃহত্তর শিমুল বাগান।
টাংগুয়ার হাওরের আশেপাশের গ্রামগুলোতে ভ্রমণের সময় পর্যটকরা স্থানীয় জেলে ও কৃষিজীবী মানুষের জীবনধারা, নৌকা তৈরির কৌশল, হাওরের গান এবং খাদ্যসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। এখানকার চিংড়ি, দেশি মাছ ও মাছ-ভাজা পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ আকর্ষণ।
তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যটন উদ্যোক্তাদের যৌথ উদ্যোগে ঈদ উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও পর্যটন ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা। হাওরের বিভিন্ন স্থানে ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন, নৌকা চলাচলের নিয়মতান্ত্রিকতা, হেল্প ডেস্ক, লাইফ সাপোর্ট এবং ইমারজেন্সি সার্ভিসও চালু করা হয়েছে।
নগরজীবনের কোলাহল ও একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে এবং প্রকৃতির গাঢ় ভালোবাসায় সিক্ত হতে চাইলে, এই ঈদুল আজহা-তে ঘুরে আসুন তাহিরপুরের টাংগুয়া হাওর। হাউসবোটে ভাসমান দিনরাত্রি, স্বচ্ছ জলের প্রতিবিম্বে চাঁদের আলো, আর পাহাড়-নদী-পাখির সুরে মেতে উঠুক আপনার ঈদের আনন্দ।
ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের ভিড় বাড়বে ধরে নিয়ে প্রশাসন বাড়তি নিরাপত্তা ও তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং বোট চলাচলে নির্ধারিত সংখ্যক যাত্রী বহনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি বোটে একজন করে মনিটরিং সদস্য রাখা হচ্ছে এবং পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং স্থানীয় পর্যটন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করছে।
স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, একটি বোটে ১৫ থেকে ২০ জন পর্যটক আরোহন করতে পারবেন। জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট বোটগুলোর ভাড়া ঈদ উপলক্ষে কিছুটা বাড়তি হলেও মান ও নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় পর্যটকদের আগ্রহ রয়েছে। দুইদিনের একটি ট্যুর প্যাকেজের খরচ গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যার মধ্যে নৌবিহার, লাকমাছড়া,নীলাদ্রি লেক, বারিক টিলা, যাদুকাটা ও শিমুল বাগান অন্তর্ভুক্ত।
তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। নৌ-পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশ পৃথকভাবে দায়িত্ব পালন করবে। তাহিরপুর ঘাট ও আনোয়ারপুর ঘাটে স্থায়ী পুলিশ বুথ থাকবে। সেইসঙ্গে পর্যটকদের নিরাপত্তায় প্রতিটি বোটে পুলিশ যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর দেওয়া হবে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাসেম জানিয়েছেন, “আমরা টাংগুয়ার হাওরকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এবারের ঈদে পর্যটকরা যেন নিরাপদ, আরামদায়ক ও স্মরণীয় সময় কাটাতে পারেন, তার জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।”
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওরে ট্যুরিজম নীতিমালা মেনে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি বা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সৃষ্টি হলে বোট চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিকল্প পরিকল্পনা রয়েছে এবং অতিরিক্ত পর্যটকদের নিরাপদ রাখতে প্রশাসনের টহল টিম সক্রিয় থাকবে।