ঢাকা ০২:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
সুনামগঞ্জ ১ আসনের জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত এমপির পথসভা জনসভায় পরিণত বিশ্বম্ভরপুরে তাহিয়া একাডেমির আয়োজনে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প সুনামগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়: মাঠে সরব সম্ভাব্য প্রার্থীরা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে ইসলামী আন্দোলনের মানববন্ধন হাওরাঞ্চলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তন  করা হবে-   তোফায়েল আহমদ খান তাহিরপুরে ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ এর প্রকল্প অবহিতকরণ সভা সম্পন্ন সুনামগঞ্জে নতুন সিম কেনার সময় অভিনব প্রতারণার ফাঁদ, সতর্ক থাকুন তাহিরপুরে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন জামায়াত নির্বাচিত হলে ছাতক-দোয়ারায় মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করব:: দোয়ারাবাজারে মাও. সালাম মাদানি পিআর ছাড়া নির্বাচন হলে দেশ চাঁদাবাজের আড্ডাখানা হবে : পীর সাহেব চরমোনাই

ছাত্র আবু সাঈদের বুকে গুলি—জাতিকে নাড়া দেওয়া শহীদের আত্মত্যাগে ক্ষোভের বিস্ফোরণ

১৬ জুলাই: রক্তাক্ত গণজাগরণে জন্ম নেয় নতুন বাংলাদেশ

অনলাইন ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ০৫:৫১:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
  • / 228
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়ংকর রক্তাক্ত দিন, এক অমোচনীয় কালো অধ্যায়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে নেমে আসা শিক্ষার্থীদের ওপর ঘটে যায় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের নৃশংসতম হামলা।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদের পুলিশের গুলিতে নির্মম শাহাদাত দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয় দুঃসহ ক্ষোভের আগুন।

গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত সূচনা: রাস্তায় ঝরে পড়ে জীবন
১৬ জুলাই, সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে পালিত হয় ছাত্র বিক্ষোভ। ঠিক তার আগের দিন, ১৫ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে দেশজুড়ে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

রংপুরের বেরোবির ১ নম্বর গেট এলাকায় পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকাণ্ড মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এনটিভির সরাসরি সম্প্রচারে দেখা যায়, পুলিশ রাস্তার উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে শটগান থেকে সরাসরি আবু সাঈদের বুকে গুলি চালায়, যখন সে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে ছিল।

আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দেয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে শুরু হয় বিক্ষোভ, অবরোধ ও সংঘর্ষ। ঢাকার মহাখালী রেললাইন অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা, ফলে ছয় ঘণ্টা বন্ধ থাকে সারাদেশের রেল যোগাযোগ।
বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ, যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট, বাড্ডা থেকে উত্তরা—সর্বত্র অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা।

সায়েন্সল্যাব এলাকায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে নিহত হন আরও দুজন—একজন হকার মো. শাহজাহান এবং নীলফামারীর যুবক সাবুজ আলী।
চট্টগ্রামে রক্তাক্ত সংঘর্ষে প্রাণ হারান ছাত্রদলের নেতা ওয়াসিম আকরাম, শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ ও দোকানকর্মী ফারুক।

পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, সরকার ছয়টি জেলায় বিজিবি মোতায়েন করে। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। স্থগিত করা হয় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
এদিকে আন্দোলন থামাতে না পেরে সরকার উচ্চ আদালতে আপিলের অনুমতি (লিভ টু আপিল) নেয় কোটা বহালের হাইকোর্ট রায়ের বিরুদ্ধে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, টিআইবি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, সুজনসহ পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন আবু সাঈদসহ শহীদদের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেয়। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা পদত্যাগ করেন আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে।
১১৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক, সাবেক ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য নেতারা যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।

পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া আবু সাঈদ ছিলেন ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট।
তার বাবা মকবুল হোসেন বলেন, “তার মৃত্যু আমাদের স্বপ্নগুলো ভেঙে দিয়েছে। আমি চাই খুনিদের বিচার হোক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।”
মা মনোয়ারা বেগম বলেন, “ছেলেকে হারিয়ে আর কোনো শান্তি নেই। বিচার হলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাবো।”

আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. রহমত আলী জানান, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। আমরা দ্রুত রায় চাই।”
আহত ছাত্র তৌহিদুল হক সিয়াম বলেন, “আমার শরীরে এখনো ৬০টি স্প্রিন্টার রয়েছে। আবু সাঈদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল বলেই সে শহীদ হয়েছে।”

বেরোবির উপাচার্য ড. মো. শওকত আলী বলেন, “আবু সাঈদের আত্মত্যাগ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। তার বিচারই জাতিকে শান্তি দেবে।”

১৬ জুলাইয়ের সেই ছাত্র হত্যাযজ্ঞ দমন করতে না পেরে একপর্যায়ে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আবু সাঈদের শাহাদাত আজ শুধুই এক ব্যথার স্মৃতি নয়, এটি নতুন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের সূচনাবিন্দু—যেখানে ছাত্রদের বুকের রক্তে লেখা হয়েছে প্রতিবাদের ইতিহাস।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

ছাত্র আবু সাঈদের বুকে গুলি—জাতিকে নাড়া দেওয়া শহীদের আত্মত্যাগে ক্ষোভের বিস্ফোরণ

১৬ জুলাই: রক্তাক্ত গণজাগরণে জন্ম নেয় নতুন বাংলাদেশ

আপডেট সময় : ০৫:৫১:৫৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়ংকর রক্তাক্ত দিন, এক অমোচনীয় কালো অধ্যায়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে নেমে আসা শিক্ষার্থীদের ওপর ঘটে যায় রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের নৃশংসতম হামলা।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদের পুলিশের গুলিতে নির্মম শাহাদাত দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেয় দুঃসহ ক্ষোভের আগুন।

গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত সূচনা: রাস্তায় ঝরে পড়ে জীবন
১৬ জুলাই, সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে পালিত হয় ছাত্র বিক্ষোভ। ঠিক তার আগের দিন, ১৫ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে দেশজুড়ে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

রংপুরের বেরোবির ১ নম্বর গেট এলাকায় পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকাণ্ড মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এনটিভির সরাসরি সম্প্রচারে দেখা যায়, পুলিশ রাস্তার উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে শটগান থেকে সরাসরি আবু সাঈদের বুকে গুলি চালায়, যখন সে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে ছিল।

আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দেয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে শুরু হয় বিক্ষোভ, অবরোধ ও সংঘর্ষ। ঢাকার মহাখালী রেললাইন অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা, ফলে ছয় ঘণ্টা বন্ধ থাকে সারাদেশের রেল যোগাযোগ।
বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ, যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট, বাড্ডা থেকে উত্তরা—সর্বত্র অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা।

সায়েন্সল্যাব এলাকায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে নিহত হন আরও দুজন—একজন হকার মো. শাহজাহান এবং নীলফামারীর যুবক সাবুজ আলী।
চট্টগ্রামে রক্তাক্ত সংঘর্ষে প্রাণ হারান ছাত্রদলের নেতা ওয়াসিম আকরাম, শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ ও দোকানকর্মী ফারুক।

পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, সরকার ছয়টি জেলায় বিজিবি মোতায়েন করে। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। স্থগিত করা হয় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
এদিকে আন্দোলন থামাতে না পেরে সরকার উচ্চ আদালতে আপিলের অনুমতি (লিভ টু আপিল) নেয় কোটা বহালের হাইকোর্ট রায়ের বিরুদ্ধে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, টিআইবি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, সুজনসহ পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠন আবু সাঈদসহ শহীদদের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি ঘোষণা করে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেয়। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা পদত্যাগ করেন আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে।
১১৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক, সাবেক ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য নেতারা যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।

পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া আবু সাঈদ ছিলেন ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট।
তার বাবা মকবুল হোসেন বলেন, “তার মৃত্যু আমাদের স্বপ্নগুলো ভেঙে দিয়েছে। আমি চাই খুনিদের বিচার হোক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।”
মা মনোয়ারা বেগম বলেন, “ছেলেকে হারিয়ে আর কোনো শান্তি নেই। বিচার হলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাবো।”

আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. রহমত আলী জানান, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। আমরা দ্রুত রায় চাই।”
আহত ছাত্র তৌহিদুল হক সিয়াম বলেন, “আমার শরীরে এখনো ৬০টি স্প্রিন্টার রয়েছে। আবু সাঈদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল বলেই সে শহীদ হয়েছে।”

বেরোবির উপাচার্য ড. মো. শওকত আলী বলেন, “আবু সাঈদের আত্মত্যাগ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। তার বিচারই জাতিকে শান্তি দেবে।”

১৬ জুলাইয়ের সেই ছাত্র হত্যাযজ্ঞ দমন করতে না পেরে একপর্যায়ে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আবু সাঈদের শাহাদাত আজ শুধুই এক ব্যথার স্মৃতি নয়, এটি নতুন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের সূচনাবিন্দু—যেখানে ছাত্রদের বুকের রক্তে লেখা হয়েছে প্রতিবাদের ইতিহাস।