ঢাকা ০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
উগ্র কর্মকাণ্ড ও গুমের অভিযোগে ইসকনকে নিষিদ্ধের দাবি নাগরিকসমাজের হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার প্রয়োজন – তোফায়েল আহমদ খান ভিজিডি উপকারভোগীদের ২১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তাহিরপুরের শ্রীপুর উত্তর ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে টাংগুয়ার হাওরে ঘুরতে এসে সড়ক দুর্ঘটনায় মা-মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু মনোনয়ন চান বিএনপির ২ নেতা একক প্রার্থী অন্য দলের উপজেলা দিবস উপলক্ষে জাতীয় পার্টির আলোচনা সভা সুনামগঞ্জ শিবিরের দারসুল কুরআন অনুষ্ঠিত সুনামগঞ্জ ১ আসনের জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত এমপির পথসভা জনসভায় পরিণত বিশ্বম্ভরপুরে তাহিয়া একাডেমির আয়োজনে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প সুনামগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়: মাঠে সরব সম্ভাব্য প্রার্থীরা

সুনামগঞ্জের সাবেক এসডিও এ.জে.এম শামসুল আলম স্মরণে

“দেখেছি সোনার মানুষ, যে মানুষ আর পাব না” পর্ব-১

জাফর সিদ্দিক
  • আপডেট সময় : ০৩:৩৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫
  • / 380
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

এতদিন মানুষটি বেঁচে ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে। এখন আর তিনি নেই। যতদিন সক্ষম ছিলেন, নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন মানুষের জন্যে, সমাজের জন্যে, দেশের জন্যে। ভয়-ভীতি, প্রলোভন, আলস্য তাকে কখনো আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তিনি এগিয়ে গেছেন দুর্বিনীত, দুর্দম পরাক্রমে জীবনের পথে: রেখে গেছেন অমোচনীয় পদচিহ্ন। যা, পথ দেখাবে ভবিষ্যতে অগণিত মানুষকে।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে তিনি ছিলেন দিল্লীর বাদশা তুঘলকের মতো। যেটি তিনি ভাল মনে করতেন তা করতে কারো সমালোচনার তোয়াক্কা করতেন না। আর তিনি নিজেও তুঘলককে দিল্লীর মসনদে সমাসীন স¤্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে সুশিক্ষিত, যোগ্য এবং ন্যায়পরায়ন মনে করতেন।
আমরা বিসিএস ৫ম ব্যাচের অফিসারদের প্রশাসনিক একাডেমিতে দীর্ঘ ৬ (ছয়) মাসের প্রশিক্ষণ। জনাব শামসুল আলম তখন মহাপরিচালক। একাডেমী চত্তরে সুন্দর ফুলের বাগান। থরে থরে ফুল ফুটে আছে। ফুটে থাকা ফুলের কেয়ারিগুলির পাশে একটি করে ছোট্র প্লাকার্ড। “ফুল চুরি করবেন না”। আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানালাম স্যার, এটি খুবই দৃষ্টিকটু। তিনি বললেন এ কারণেই এটা দেয়া হয়েছে। বাগানের একটা ফুল যতক্ষন গাছে থাকে ততক্ষনই সবার মনোরঞ্জন করে। কিন্তু যারা অবলীলায় এটি ছিড়ে নেয় তারা আসলে খুবই গুরুতর অন্যায় করে। কিন্তু আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুল ছেড়া কোন অপরাধ নয়। সাইনবোর্ডের মত করে এটা দেয়া থাকলে ফুলে হাত দিতে যেয়ে তাদের মনে একটু অপরাধবোধ কাজ করুক। সেজন্যেই এ ব্যবস্থা।

একাডেমীর কমন বাথরুমগুলোর প্রতিটিতে বদনা থাকত। প্রতিটির গলায় একটি চিকন শিকল বাঁধা। মহাপরিচালকের হুকুম, অন্যথা হবার যোগাড় নেই।
কঠোর সময়নিষ্ঠ তিনি। ক্লাসে কিংবা অনুষ্ঠানে নির্ধারিত সময়ের এক সেকেন্ড দেরিতে আসার কোন নজির নেই। একদিন ক্লাসে ঢুকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রশস্তির হাসি ছড়িয়ে বললেন, যাক সময়মতোই আসা গেল। তারপর পাজামার পকেট থেকে দুটো মোজা বের করে দু’পায়ে পড়তে পড়তে বললেন কী আর করা! সময় বাঁচাতে এটাই করতে হলো।

সাটুরিয়া উপজেলা মারাত্মকভাবে ঘুর্ণি কবলিত। দুর্যোগপূর্ণ এলাকার মানুষের পরিস্থিতি এবং ত্রাণ কার্যক্রম স্বচক্ষে দেখার জন্য আমাদের সবাইকে বাসে করে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় নিয়ে গেলেন। সত্যি বলতে আমি ঘুণিঝড় কবলিত এরকম গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এরকম এলাকা আমি আর কখনো দেখিনি। ত্রাণ কার্যক্রমও ছিল ব্যাপক পরিসরে। পরবর্তী চাকুরি জীবনে এসব অভিজ্ঞতা খুবই কাজে এসেছে। ফেরার পরে তিনি আমাদের বাসটিকে বিদায় করে দিলেন। আমরা পুরুষ মহিলা মিলিয়ে ৫০/৬০ জন অফিসার মহাসড়কের পাশ ধরে হেটে হেটে একাডেমিতে ফিরেছিলাম। তবে, এতে আমাদের কারো গুরুতর অসুবিধা হয়নি। কারণ আমরা একাডেমিতে যে শারিরীক কসরৎ করতাম তাতে আমাদের পক্ষে এটা অনেকটাই সহনীয় ছিল। মহাপরিচালক মহোদয় হয়তো এটিই পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

স্যারের চাকুরীর একেবারে শুরুর দিকের ঘটনা। সবে বিয়ে করেছেন। সচিবালয়ে আসা যাওয়ার সময় এবং খরচ বাঁচানোর জন্য তিনি সাইকেলে যাতায়াত শুরু করলেন। তাঁর শ্বশুর অনেক ধনী লোক। জামাতার এ ব্যবস্থায় তিনি বড়ই কাতর হয়ে মেয়ে-জামাতার জন্য উপহার হিসেবে একটি গাড়ি কিনে দেয়ার মনস্থ করলেন। একদিন গাড়ি কিনে জামাইয়ের কাছে গাড়ির চাবি হস্তান্তর করলেন। জামাই সাথে সাথে তার নব পরিনীতা স্ত্রীর হাতটি শ্বশুরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন তিনি যেন গাড়ি কিংবা কন্যা দু’টির কোন একটিকে তখনি ফেরত নিয়ে যান।

স্যার যখন কোন কিছু নিয়ে মেতে উঠতেন তখন সবসময় পরিস্থিতির খেয়াল রাখতে পারতেন না। তাঁর বন্ধু সচিব রেজাউল হায়াত (সম্ভবত ব্যাচমেট) একবার গল্প করেছিলেন। তিনি তাঁর ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়েতে শামসুল হক স্যারকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানস্থলের গেটে তিনি আগত সবাইকে সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন। একসময় শামসুল আলম সাহেব এসে বন্ধু রেজাউল হায়াতকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে তাবলীগের উপকারিতা এবং দুনিয়াবি কার্যক্রমের অসারতা বিষয়ে খুবই সিরিয়াস আলোচনা জুড়ে দিলেন। সে যাত্রা বন্ধুর হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য অপর বন্ধুর প্রতি সৌজন্য বহির্ভুত অসহিষ্ঞুতা দেখাতে হয়েছিল।

শামসুল আলম স্যার একসময় সুনামগঞ্জের এসডিও ছিলেন। তখনো এটি জেলা হয়নি। তিনি তহশিলদারদের দুর্নীতির সহায়ক না হওয়ার জন্য তহশীলদারদের স্ত্রীদেরকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি আন্তরিকভাবে মনে করেছিলেন স্ত্রীরা যদি স্বামীকে সৎ থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করে কিংবা টাকা পয়সার জন্য গঞ্জনা না দেয় তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

সুনামগঞ্জের এসডিও থাকাকালে ভূমি রাজস্ব আদায়ে গতি সঞ্চারের জন্য তিনি একবার মহকুমা সদর থেকে বের হয়ে গেলেন। কয়েকদিন কোন খবর নেই। তখনকার দিনের যোগাযোগ ব্যবস্থায়, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে পদব্রজে ভ্রমণই একমাত্র উপায়। তিনি হেঁটে হেঁটে এ তহশিল থেকে অন্য তহশিলে যাচ্ছেন। তাঁর পরিবার এবং অফিসের লোকজনের গভীর উৎকন্ঠার নিরসন হলো কোন এক পত্রিকায় ছবিসহ একটি সংবাদে। দেখা গেল তিনি ভাল আছেন এবং লুঙ্গি পড়ে কোন একটি বাঁশের সাঁকো পার হচ্ছেন।

পড়নের পোষাক হিসেবে লুঙ্গি ছিল তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। তিনি লুঙ্গিকে জাতীয় পোষাক হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা জন্য অনেক চেষ্টাও করেছেন। লুঙ্গির সমর্থনে জোরালো যুক্তিসহ তাঁর একটি লেখাও আমিও পড়েছি।

সুনামগঞ্জে কর্মকালে স্যারের একটি তৎপরতা আমাকে অনেক বেশি আপ্লুত করেছে। আমি সেখানে অনেকদিন জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছি। স্যারের গল্প অনেকের কাছেই শুনেছি। আর কী যে কৃতজ্ঞ সবাই, এ পাগলাটে কর্মকর্তাটির প্রতি!

গল্পটি শুনেছিলাম বিশিষ্ট জননেতা তখনকার জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় হুইপ এবং জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জনাব ফজলুল হক আসপিয়ার কাছে। তিনি তখন কলেজের ছাত্র। তমদ্দুন মজলিস বা এজাতীয় একটি ইসলাম পন্থী ছাত্র সংগঠন করেন। হয়তো ইসলামী ভাবধারার কারণে দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্টতা ছিল। সে সূত্রে অফিস সময়ের পরেও কখনো সখনো এসডিও সাহেবের সাথে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ছিল। তিনি বললেন একদিন কি কারণে বেশ রাতে তিনি এসডিও সাহেবের সাথে দেখা করতে যান। যেয়ে দেখেন এসডিও সাহেব মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি অবাক হলে এসডিও সাহেব বললেন, আরে না না, তেমন কিছুনা। আমি গত কিছুদিন ধরে মাটিতে ঘুমাই। একটু অভিজ্ঞতা নিচ্ছিলাম, যেমন ধর যারা রাস্তাঘাটে কিংবা অফিস আদালতের বারান্দায় মানুষগুলো কিভাবে রাত কাটায়।

বন্ধুরা আমি যখন এ কথাগুলো লিখছি তখন আমার চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় আপনারাও তার কিছুটা আঁচ পাবেন। এসবই ছিল এজেডএম শামসুল আলমের তুঘলকি কান্ড। তাঁর ভাল কান্ডগুলো সার্ভিসে আমাদের বন্ধুদের অনেকেই লিখছেন এবং লিখবেন। আমি সেগুলো বিশেষ লিখছিনা। (পরের বারে সমাপ্য)

লিখেছেন জনাব জাফর সিদ্দিক

সাবেক জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

সুনামগঞ্জের সাবেক এসডিও এ.জে.এম শামসুল আলম স্মরণে

“দেখেছি সোনার মানুষ, যে মানুষ আর পাব না” পর্ব-১

আপডেট সময় : ০৩:৩৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫

এতদিন মানুষটি বেঁচে ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে। এখন আর তিনি নেই। যতদিন সক্ষম ছিলেন, নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন মানুষের জন্যে, সমাজের জন্যে, দেশের জন্যে। ভয়-ভীতি, প্রলোভন, আলস্য তাকে কখনো আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তিনি এগিয়ে গেছেন দুর্বিনীত, দুর্দম পরাক্রমে জীবনের পথে: রেখে গেছেন অমোচনীয় পদচিহ্ন। যা, পথ দেখাবে ভবিষ্যতে অগণিত মানুষকে।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে তিনি ছিলেন দিল্লীর বাদশা তুঘলকের মতো। যেটি তিনি ভাল মনে করতেন তা করতে কারো সমালোচনার তোয়াক্কা করতেন না। আর তিনি নিজেও তুঘলককে দিল্লীর মসনদে সমাসীন স¤্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে সুশিক্ষিত, যোগ্য এবং ন্যায়পরায়ন মনে করতেন।
আমরা বিসিএস ৫ম ব্যাচের অফিসারদের প্রশাসনিক একাডেমিতে দীর্ঘ ৬ (ছয়) মাসের প্রশিক্ষণ। জনাব শামসুল আলম তখন মহাপরিচালক। একাডেমী চত্তরে সুন্দর ফুলের বাগান। থরে থরে ফুল ফুটে আছে। ফুটে থাকা ফুলের কেয়ারিগুলির পাশে একটি করে ছোট্র প্লাকার্ড। “ফুল চুরি করবেন না”। আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানালাম স্যার, এটি খুবই দৃষ্টিকটু। তিনি বললেন এ কারণেই এটা দেয়া হয়েছে। বাগানের একটা ফুল যতক্ষন গাছে থাকে ততক্ষনই সবার মনোরঞ্জন করে। কিন্তু যারা অবলীলায় এটি ছিড়ে নেয় তারা আসলে খুবই গুরুতর অন্যায় করে। কিন্তু আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুল ছেড়া কোন অপরাধ নয়। সাইনবোর্ডের মত করে এটা দেয়া থাকলে ফুলে হাত দিতে যেয়ে তাদের মনে একটু অপরাধবোধ কাজ করুক। সেজন্যেই এ ব্যবস্থা।

একাডেমীর কমন বাথরুমগুলোর প্রতিটিতে বদনা থাকত। প্রতিটির গলায় একটি চিকন শিকল বাঁধা। মহাপরিচালকের হুকুম, অন্যথা হবার যোগাড় নেই।
কঠোর সময়নিষ্ঠ তিনি। ক্লাসে কিংবা অনুষ্ঠানে নির্ধারিত সময়ের এক সেকেন্ড দেরিতে আসার কোন নজির নেই। একদিন ক্লাসে ঢুকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রশস্তির হাসি ছড়িয়ে বললেন, যাক সময়মতোই আসা গেল। তারপর পাজামার পকেট থেকে দুটো মোজা বের করে দু’পায়ে পড়তে পড়তে বললেন কী আর করা! সময় বাঁচাতে এটাই করতে হলো।

সাটুরিয়া উপজেলা মারাত্মকভাবে ঘুর্ণি কবলিত। দুর্যোগপূর্ণ এলাকার মানুষের পরিস্থিতি এবং ত্রাণ কার্যক্রম স্বচক্ষে দেখার জন্য আমাদের সবাইকে বাসে করে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় নিয়ে গেলেন। সত্যি বলতে আমি ঘুণিঝড় কবলিত এরকম গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এরকম এলাকা আমি আর কখনো দেখিনি। ত্রাণ কার্যক্রমও ছিল ব্যাপক পরিসরে। পরবর্তী চাকুরি জীবনে এসব অভিজ্ঞতা খুবই কাজে এসেছে। ফেরার পরে তিনি আমাদের বাসটিকে বিদায় করে দিলেন। আমরা পুরুষ মহিলা মিলিয়ে ৫০/৬০ জন অফিসার মহাসড়কের পাশ ধরে হেটে হেটে একাডেমিতে ফিরেছিলাম। তবে, এতে আমাদের কারো গুরুতর অসুবিধা হয়নি। কারণ আমরা একাডেমিতে যে শারিরীক কসরৎ করতাম তাতে আমাদের পক্ষে এটা অনেকটাই সহনীয় ছিল। মহাপরিচালক মহোদয় হয়তো এটিই পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন।

স্যারের চাকুরীর একেবারে শুরুর দিকের ঘটনা। সবে বিয়ে করেছেন। সচিবালয়ে আসা যাওয়ার সময় এবং খরচ বাঁচানোর জন্য তিনি সাইকেলে যাতায়াত শুরু করলেন। তাঁর শ্বশুর অনেক ধনী লোক। জামাতার এ ব্যবস্থায় তিনি বড়ই কাতর হয়ে মেয়ে-জামাতার জন্য উপহার হিসেবে একটি গাড়ি কিনে দেয়ার মনস্থ করলেন। একদিন গাড়ি কিনে জামাইয়ের কাছে গাড়ির চাবি হস্তান্তর করলেন। জামাই সাথে সাথে তার নব পরিনীতা স্ত্রীর হাতটি শ্বশুরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন তিনি যেন গাড়ি কিংবা কন্যা দু’টির কোন একটিকে তখনি ফেরত নিয়ে যান।

স্যার যখন কোন কিছু নিয়ে মেতে উঠতেন তখন সবসময় পরিস্থিতির খেয়াল রাখতে পারতেন না। তাঁর বন্ধু সচিব রেজাউল হায়াত (সম্ভবত ব্যাচমেট) একবার গল্প করেছিলেন। তিনি তাঁর ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়েতে শামসুল হক স্যারকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানস্থলের গেটে তিনি আগত সবাইকে সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন। একসময় শামসুল আলম সাহেব এসে বন্ধু রেজাউল হায়াতকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে তাবলীগের উপকারিতা এবং দুনিয়াবি কার্যক্রমের অসারতা বিষয়ে খুবই সিরিয়াস আলোচনা জুড়ে দিলেন। সে যাত্রা বন্ধুর হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য অপর বন্ধুর প্রতি সৌজন্য বহির্ভুত অসহিষ্ঞুতা দেখাতে হয়েছিল।

শামসুল আলম স্যার একসময় সুনামগঞ্জের এসডিও ছিলেন। তখনো এটি জেলা হয়নি। তিনি তহশিলদারদের দুর্নীতির সহায়ক না হওয়ার জন্য তহশীলদারদের স্ত্রীদেরকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি আন্তরিকভাবে মনে করেছিলেন স্ত্রীরা যদি স্বামীকে সৎ থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করে কিংবা টাকা পয়সার জন্য গঞ্জনা না দেয় তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।

সুনামগঞ্জের এসডিও থাকাকালে ভূমি রাজস্ব আদায়ে গতি সঞ্চারের জন্য তিনি একবার মহকুমা সদর থেকে বের হয়ে গেলেন। কয়েকদিন কোন খবর নেই। তখনকার দিনের যোগাযোগ ব্যবস্থায়, বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে পদব্রজে ভ্রমণই একমাত্র উপায়। তিনি হেঁটে হেঁটে এ তহশিল থেকে অন্য তহশিলে যাচ্ছেন। তাঁর পরিবার এবং অফিসের লোকজনের গভীর উৎকন্ঠার নিরসন হলো কোন এক পত্রিকায় ছবিসহ একটি সংবাদে। দেখা গেল তিনি ভাল আছেন এবং লুঙ্গি পড়ে কোন একটি বাঁশের সাঁকো পার হচ্ছেন।

পড়নের পোষাক হিসেবে লুঙ্গি ছিল তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। তিনি লুঙ্গিকে জাতীয় পোষাক হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা জন্য অনেক চেষ্টাও করেছেন। লুঙ্গির সমর্থনে জোরালো যুক্তিসহ তাঁর একটি লেখাও আমিও পড়েছি।

সুনামগঞ্জে কর্মকালে স্যারের একটি তৎপরতা আমাকে অনেক বেশি আপ্লুত করেছে। আমি সেখানে অনেকদিন জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছি। স্যারের গল্প অনেকের কাছেই শুনেছি। আর কী যে কৃতজ্ঞ সবাই, এ পাগলাটে কর্মকর্তাটির প্রতি!

গল্পটি শুনেছিলাম বিশিষ্ট জননেতা তখনকার জাতীয় সংসদের সরকারদলীয় হুইপ এবং জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জনাব ফজলুল হক আসপিয়ার কাছে। তিনি তখন কলেজের ছাত্র। তমদ্দুন মজলিস বা এজাতীয় একটি ইসলাম পন্থী ছাত্র সংগঠন করেন। হয়তো ইসলামী ভাবধারার কারণে দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্টতা ছিল। সে সূত্রে অফিস সময়ের পরেও কখনো সখনো এসডিও সাহেবের সাথে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ছিল। তিনি বললেন একদিন কি কারণে বেশ রাতে তিনি এসডিও সাহেবের সাথে দেখা করতে যান। যেয়ে দেখেন এসডিও সাহেব মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি অবাক হলে এসডিও সাহেব বললেন, আরে না না, তেমন কিছুনা। আমি গত কিছুদিন ধরে মাটিতে ঘুমাই। একটু অভিজ্ঞতা নিচ্ছিলাম, যেমন ধর যারা রাস্তাঘাটে কিংবা অফিস আদালতের বারান্দায় মানুষগুলো কিভাবে রাত কাটায়।

বন্ধুরা আমি যখন এ কথাগুলো লিখছি তখন আমার চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় আপনারাও তার কিছুটা আঁচ পাবেন। এসবই ছিল এজেডএম শামসুল আলমের তুঘলকি কান্ড। তাঁর ভাল কান্ডগুলো সার্ভিসে আমাদের বন্ধুদের অনেকেই লিখছেন এবং লিখবেন। আমি সেগুলো বিশেষ লিখছিনা। (পরের বারে সমাপ্য)

লিখেছেন জনাব জাফর সিদ্দিক

সাবেক জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ।