ঢাকা ০১:১৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
নবগঠিত শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত “দেখেছি সোনার মানুষ, যে মানুষ আর পাব না” পর্ব-২ “দেখেছি সোনার মানুষ, যে মানুষ আর পাব না” পর্ব-১ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ঢেউটিন ও চেক বিতরণ মুজিববাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে সুনামগঞ্জে শিবিরের জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা দারুলহুদা দাখিল মাদরাসায় ইনহাউজ প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত পুরস্কার ও প্রেরণার আলোয় প্রজ্জ্বলিত শান্তিগঞ্জের শিক্ষা সম্মিলন বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে সুনামগঞ্জ শিবিরের দোয়া মাহফিল জাতীয় সমাবেশ থেকে ফেরার পথে জামায়াত কর্মীর মৃত্যু : জেলা জামায়াতের শোক

কোরবানিকে ঘিরে সরগরম কামার-কুমার পল্লী;

শ্রমে-ঘামে গড়া কোরবানির সরঞ্জাম

এস এম মিজান :
  • আপডেট সময় : ০২:০৮:৪০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫
  • / 152
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সুনামগঞ্জ শহরের প্রান্তে কিংবা গ্রামীণ জনপদের অলিগলিতে ঢুকলেই কানে আসে ধাতব যন্ত্রপাতির গুঞ্জন। কৃত্রিম হাওয়ায় জ্বলে ওঠা আগুনের মধ্যে লোহা গলছে, গড়িয়ে তৈরি হচ্ছে দা, বটি, ছুরি, চাপাতি। এই যেন কোরবানির ঈদের পূর্বাভাস।

ঐতিহ্যবাহী কামার সম্প্রদায় এই সময়ে গড়েন নিজেদের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। কামারের হাতুড়ির আঘাতে বদলে যায় লোহার রূপ, সৃষ্টি হয় কোরবানির ঈদের অন্যতম অনুসঙ্গ—মাংস কাটার সরঞ্জাম। কামাররা জানালেন, ঈদকে ঘিরেই বছরে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা পড়ে তাদের জীবনে।

সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভপুর , তাহিরপুরসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে শত বছরের পুরোনো কামার পল্লীগুলোর ব্যস্ত রূপ। আগুনের পাশে কাজ করতে করতে কামারদের চোখেমুখে ক্লান্তি, কিন্তু কাজের মধ্যে আছে আত্মতৃপ্তি।

এই কামাররা মূলত ভারত উপমহাদেশে বহু প্রাচীনকাল থেকেই লোহাজাত শিল্পে নিয়োজিত। সুনামগঞ্জের কামার সম্প্রদায়ের শিকড় মূলত পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ সমাজে, যারা হস্তশিল্পে পারদর্শী ছিলেন। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সময় পার হলেও, কামারদের শিল্প এখনও টিকে আছে তাদের অধ্যবসায়ে।

জানা গেছে, কোরবানির ঈদের দুই-তিন সপ্তাহ আগে থেকেই কামার পল্লীগুলোয় শুরু হয় ব্যস্ততা। কেউ দা বানাচ্ছেন, কেউ ছুরি শান দিচ্ছেন। আবার কেউ পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত করে নতুন রূপে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন।

বিশ্বম্ভপুর  উপজেলার বাজার এলাকার কামার রবিন বলেন,‘ঈদের এই মৌসুমেই আয় একটু বশি অয়। লোহা-ইস্পাত কিনে দা, বটি, ছুরি বানাই। লাভ বেশি না হলেও সারা বছরের পুঁজি তোলা যায়।’

সুনামগঞ্জ সহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বড় দা (বটি) বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৬৫০ টাকায়, চাপাতি ৮০০-১১০০ টাকা, বড় ছুরি ৩৫০-৫০০ টাকা, মাঝারি ছুরি ২৫০-৩৫০ টাকা, ছোট ছুরি (চামড়া কাটার জন্য) ৫০-১০০ টাকায়।

এদিকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন  উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় এখনও কুমার সম্প্রদায়ের দেখা মেলে, যারা মাটি দিয়ে তৈরি করেন হাঁড়ি, পাতিল, প্রদীপ ও কোরবানির সময় ব্যবহৃত বড় পাত্র। যদিও এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে, তবে ঈদ এলেই কিছুটা প্রাণ পায় তাদের এই প্রাচীন পেশা।

তাহিরপুর  উপজেলার  কুমার বিতুশ চন্দ্র দাস বলেন,
‘আগে ঘরে ঘরে হাঁড়ি-পাতিল বানিয়ে বিক্রি করতাম। এখন চাহিদা কমে গেছে। তবে কোরবানির সময় কেউ কেউ এখনও কিনতে আসে। এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাজ, তাই ছাড়িনি।’

সুনামগঞ্জের এসব কামার-কুমার পল্লীতে ঈদ শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি তাদের জীবিকার প্রধান সময়।
বাদাঘাট বাজারের দা-বটি ব্যবসায়ী তৌফিক মিয়া বলেন,‘কুরবানীর হাট জমলে , দা-বটির চাহিদা বাড়ে। এখন থাইক্ক্যা বিক্রি শুরু হয়েছে,  ঈদের আগের দিন পর্যন্ত  বেশি বিক্রি অইব।’

কালের বিবর্তনে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও সুনামগঞ্জের কামার ও কুমার পল্লীগুলো এখনও টিকে আছে বিশ্বাস আর শ্রমের জোরে। কোরবানির ঈদকে ঘিরে তাদের পল্লীগুলো হয়ে ওঠে এক টুকরো শিল্পমেলা—যেখানে ধর্মীয় অনুষঙ্গ আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মিলেমিশে হয় একাকার।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

কোরবানিকে ঘিরে সরগরম কামার-কুমার পল্লী;

শ্রমে-ঘামে গড়া কোরবানির সরঞ্জাম

আপডেট সময় : ০২:০৮:৪০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ জুন ২০২৫

সুনামগঞ্জ শহরের প্রান্তে কিংবা গ্রামীণ জনপদের অলিগলিতে ঢুকলেই কানে আসে ধাতব যন্ত্রপাতির গুঞ্জন। কৃত্রিম হাওয়ায় জ্বলে ওঠা আগুনের মধ্যে লোহা গলছে, গড়িয়ে তৈরি হচ্ছে দা, বটি, ছুরি, চাপাতি। এই যেন কোরবানির ঈদের পূর্বাভাস।

ঐতিহ্যবাহী কামার সম্প্রদায় এই সময়ে গড়েন নিজেদের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। কামারের হাতুড়ির আঘাতে বদলে যায় লোহার রূপ, সৃষ্টি হয় কোরবানির ঈদের অন্যতম অনুসঙ্গ—মাংস কাটার সরঞ্জাম। কামাররা জানালেন, ঈদকে ঘিরেই বছরে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা পড়ে তাদের জীবনে।

সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভপুর , তাহিরপুরসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে শত বছরের পুরোনো কামার পল্লীগুলোর ব্যস্ত রূপ। আগুনের পাশে কাজ করতে করতে কামারদের চোখেমুখে ক্লান্তি, কিন্তু কাজের মধ্যে আছে আত্মতৃপ্তি।

এই কামাররা মূলত ভারত উপমহাদেশে বহু প্রাচীনকাল থেকেই লোহাজাত শিল্পে নিয়োজিত। সুনামগঞ্জের কামার সম্প্রদায়ের শিকড় মূলত পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ সমাজে, যারা হস্তশিল্পে পারদর্শী ছিলেন। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সময় পার হলেও, কামারদের শিল্প এখনও টিকে আছে তাদের অধ্যবসায়ে।

জানা গেছে, কোরবানির ঈদের দুই-তিন সপ্তাহ আগে থেকেই কামার পল্লীগুলোয় শুরু হয় ব্যস্ততা। কেউ দা বানাচ্ছেন, কেউ ছুরি শান দিচ্ছেন। আবার কেউ পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত করে নতুন রূপে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন।

বিশ্বম্ভপুর  উপজেলার বাজার এলাকার কামার রবিন বলেন,‘ঈদের এই মৌসুমেই আয় একটু বশি অয়। লোহা-ইস্পাত কিনে দা, বটি, ছুরি বানাই। লাভ বেশি না হলেও সারা বছরের পুঁজি তোলা যায়।’

সুনামগঞ্জ সহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বড় দা (বটি) বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৬৫০ টাকায়, চাপাতি ৮০০-১১০০ টাকা, বড় ছুরি ৩৫০-৫০০ টাকা, মাঝারি ছুরি ২৫০-৩৫০ টাকা, ছোট ছুরি (চামড়া কাটার জন্য) ৫০-১০০ টাকায়।

এদিকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন  উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় এখনও কুমার সম্প্রদায়ের দেখা মেলে, যারা মাটি দিয়ে তৈরি করেন হাঁড়ি, পাতিল, প্রদীপ ও কোরবানির সময় ব্যবহৃত বড় পাত্র। যদিও এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে, তবে ঈদ এলেই কিছুটা প্রাণ পায় তাদের এই প্রাচীন পেশা।

তাহিরপুর  উপজেলার  কুমার বিতুশ চন্দ্র দাস বলেন,
‘আগে ঘরে ঘরে হাঁড়ি-পাতিল বানিয়ে বিক্রি করতাম। এখন চাহিদা কমে গেছে। তবে কোরবানির সময় কেউ কেউ এখনও কিনতে আসে। এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাজ, তাই ছাড়িনি।’

সুনামগঞ্জের এসব কামার-কুমার পল্লীতে ঈদ শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি তাদের জীবিকার প্রধান সময়।
বাদাঘাট বাজারের দা-বটি ব্যবসায়ী তৌফিক মিয়া বলেন,‘কুরবানীর হাট জমলে , দা-বটির চাহিদা বাড়ে। এখন থাইক্ক্যা বিক্রি শুরু হয়েছে,  ঈদের আগের দিন পর্যন্ত  বেশি বিক্রি অইব।’

কালের বিবর্তনে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও সুনামগঞ্জের কামার ও কুমার পল্লীগুলো এখনও টিকে আছে বিশ্বাস আর শ্রমের জোরে। কোরবানির ঈদকে ঘিরে তাদের পল্লীগুলো হয়ে ওঠে এক টুকরো শিল্পমেলা—যেখানে ধর্মীয় অনুষঙ্গ আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মিলেমিশে হয় একাকার।