সুনামগঞ্জ ০৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ সভাপতি এম এ ছাত্তার – তাহিরপুরে আগুনে পুড়ল প্রাণী সম্পদ অফিসের মোটরসাইকেল দুর্যোগ মোকালোয় রেড ক্রিসেন্ট‘র সচেতনতামূলক সভা অনুষ্ঠিত রেনেসাঁ ইসলামিক সোসাইটির উদ্যোগে ফ্রি ব্লাডগ্রুপ নির্নয় তাহিরপুরে আগুনে পুড়ে ছাই বসতঘর, ১৩ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি  পুরান বারুংকা মডেল মাদরাসায় ফ্রি চক্ষু শিবির অনুষ্ঠিত তাহিরপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’র হামদ নাত ক্বিরাত প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণ সম্পন্ন সততা ও দক্ষতা ব্যবসার মূল পূঁজি : মোঃ শহিদুল ইসলাম ছাতকে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দীক গ্রেফতার দোয়ারাবাজারের ইউএনও নেহের নিগার তনু’র প্রত্যাহারের দাবিতে বিভাগীয় কমিশনারের বরাবর আবেদন

গ্রামীণ জনজীবনে আয়নাপড়া বাটিচালান চালপড়া -ডা. এম. নূরুল ইসলাম

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:৩০:৪২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৯৭ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গল্প
ডা. এম. নূরুল ইসলাম

তখন আমি বেশ ছোট। প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। একদিন সকালে বাড়িতে বেশ তুলকালাম ঘটনা ঘটে গেলো। আমাদের ঘর থেকে হারাই হাজার টাকা চুরি হয়ে গেলো! টাকাটা রাখা ছিলো মায়ের চাল ভর্তি ড্রামের ভিতরে। ধান বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা মায়ের কাছে দিলে, মা অনেক যত্ন করে সঙ্গোপনে ড্রামের চাল সরিয়ে, চালের অনেক গভিরে সেই টাকা রেখে দিলেন। সেই টাকা চুরি হয়ে গেলো!

কতো বড় সাংঘাতিক ঘটনা! পুরো বাড়ি ও পাড়া জুড়ে হইচই পড়ে গেলো। আমাদের বাড়ির ছোট থেকে বড় এমনকি বাড়ির আশপাশের অনেকের দিকেই সন্দেহের তীর! কিন্তু স্বীকার তো করছে না কেউ?

তখনকার দিনে আড়াই হাজার টাকা মানে, অনেক বড় একটা টাকা। বাবা একজনের জমি বন্ধক রেখেছিলেন, জমির মালিককে বন্ধকের টাকা দিতে গিয়ে মা খেয়াল করলেন ড্রামের চালের ভিতর টাকা নাই! মা কান্নাকাটি শুরু করলেন, বাবা ও বড় ভাই বকাঝকা করে পুরো বাড়ি মাথায় করে তুললেন।

আশেপাশের অনেক পাড়া-পড়শী ছুটে আসলো। সেদিন আমাদের ভাই-বোন কারোরই স্কুলে যাওয়া হলো না।

ড্রামের চাল বারবার পরীক্ষা করা হলো। ড্রাম খালি করে পুরো চাল মেঝেতে নামানো হলো। টাকার ছিটেফোঁটাও কোথায় নাই!

ঘরের ভিতরেরর আনাচ-কানাচ সবজায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজা হলো। কোথায়ও টাকা পাওয়া গেলো না। টাকার শোকে মা পাথর হয়ে গেলেন!

কিন্তু টাকাটা চুরি করলো কে? কার এতো বড় দুঃসাহস?

সন্দেহের তালিকায় বাড়ির ছোট-বড়, পাড়া-পড়সী সবাই। শুধু সন্দেহ করলেই তো হবে না, আসল চোরকে শনাক্ত করতে হবে। কিন্তু সেটাই বা কিভাবে?

ঠিক হলো বাটি চালান দেওয়া হবে। তাতেও কাজ না হলে আয়নাপড়া দেয়া হবে এবং চালপড়া খাওয়ানো হবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। পুরো বাড়ি জুড়ে মানুষে গিজগিজ করছে। আমাদের ছেলেপুলেদের উৎসাহের শেষ নাই। চোর ধরার যাবতীয় বিষয়গুলো নিয়ে ভয়ানকরকম গবেষণা চলছিলো আমাদের সবার মাঝে।

আমাদের গ্রামের প্বার্শবর্তী ঢালাগাঁও গ্রামের হাবিসাবের কাছ থেকে হাদিয়া দিয়ে চাল পড়িয়ে আনা হলো, দূরগ্রম বালিকান্দি থেকে এক মহিলার মাধ্যমে একটি নতুন আয়না কিনে আয়না পড়িয়ে আনা হলো এবং তুলারাশির জাতক দিয়ে পরদিন সকালে বাটিচালান দেয়ার সব রকম ব্যবস্থা করা হলো!

যাবে কোথায় চোর? তাকে ধরা পড়তেই হবে!

আয়নাপড়া দিয়ে সেদিন রাতেই চোর ধরার মহান অভিযান শুরু হলো।

পড়ানো আয়না রুমাল দিয়ে মোড়ানো আছে। গহীন রাতে তুলারাশির জাতক দিয়ে অন্ধাকারে আয়নার রুমাল সরালেই চোরের চেহারা আয়নায় ভেসে উঠবে! সেদিন রাতে চোর ধরার জন্য অতি উৎসাহ ও উত্তেজনায় আমাদের কারোই ভালো ঘুম হলো না! কার চেহারাটা না আবার ভেসে উঠে আয়নায়!

তুলারাশির জাতক এক মহিলাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। তার খাতির-যত্নের শেষ নাই। তবে তিনি বাড়ির সবাইকে দুঃসংবাদ দিলো। আয়নাতে চেহারার পেছনের দিক দেখতে পেয়েছেন তিনি! তার মানে চোর বাড়ির বাইরের কেউ হতে পারে! হায় আল্লাহ! কিন্তু বাইরের কেউ টা আবার কে? সবাই মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। এতো বড় সাহস কার?

সকালেই শুরু হলো বাটি চালান। সে এক বিরাট কান্ড। তুলা রাশির জাতক এক পুরুষকে বাড়িতে আনা হঢেছে। তাকে সবাই সমীহ করে চলছে। তার নাকি বিরাট ক্ষমতা। গ্রামে কতো বড় বড় চোর ধরার ইতিহাস যে আছে, তার কোন ইয়ত্বা নাই!

জাতক তার শরীর থেকে জামা খুলে ফেললেন। আমাদের উত্তেজনার শেষ নাই। চালের ড্রামের কাছ থেকেই বাটি চালান দেয়া হবে। চোর টাকা চুরি করে যে যে দিক অবলম্বন করে চলাফেরা করে অবশেষে যেখানে টাকা রেখেছে, বাটি সে দিকেই যাবে!

তুমুল উত্তেজনা! কার উপর গিয়ে বাটি উঠে একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে!

শুরু হলো বাটি চালান। তুলারাশির জাতক বাটি নিয়ে ঘরের ভিতরে এদিক সেদিক যাচ্ছেন, সবশেষে আমাদের ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বাটি বের হয়ে বাটি চললো মুগাই নদীর দিকে! ছেলেপুলে, ছোট-বড় সবাই ছুটছে বাটির পেছনে পেছনে। বড়রা ছোটদের ধমক দিচ্ছে, রাস্তা ক্লিয়ার রাখতে হচ্ছে, কোথায় দিয়ে কার উপরে বাটি উঠে যায় কে জানে!

বাটি চালান করতে করতে তুলা রাশির জাতক ঘেমেটেমে অস্থির! বাটি থামলো মুগাই নদীর পাড়ে আমাদের ঘাটের ঠিক কাছেই। মুগাই নদীতে পানি আছে। তার মানে? সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। বুঝতে কারোরই অসুবিধা হলো না, চোর টাকা চুরি করে বিভিন্ন রাস্তা ধরে মুগাই নদীর ঐ ঘাট দিয়েই নদী পার হয়ে পালিয়েছে! হায় আ্ল্লাহ, এখন উপায়? বাটি চালান সমাপ্ত হলো বৈকি!

বাকী থাকলো চালপড়া।

এইবার চোর ধরা পরবেই পরবে! উঠানে আনা হলো চালপড়া। সবাইকেই চাল চিবোতে হবে। যে চাল চিবাতে চিবাতে গুরু করতে পারবে না, সেই চোর!

কলাগাছের পাতা কেটে এনে সারিসারি করে উঠানে পাতানো হলো। চালপড়া চাল মুখ দিয়ে চিবিয়ে গুড়ো করে, অতঃপর সেই গুড়ো চালের রস কলাগাছের পাতায় সবাইকে এক এক করে ফেলতে হবে। চোর আর যাবে কোথায়?

ছোটবেলায় আমার কাঁচা চাল খাওয়ার বিরাট বাতিক ছিলো। মুঠোয় মুঠোয় কাঁচা চাল আমি অনায়েশেই সাবার করে ফেলতে পারতাম। কাঁচা চালে অসাধারন একটি সাদ আছে। চাল চিবাতে চিবাতে যখন রসে পরিনতো হয়, সেটার কী যে সাদ! আহা! মনে হয় এখনো জিহবায় সেই সাদ লেগে আছে!

মায়ের হিসাব করা চাল সারাদিন মুঠোয় করে, লুঙ্গি কিংবা হাফপ্যান্টের কোরসে করে ঘরের কোনে, নদীর পাড়ে, জঙ্গলের কাছে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে মায়ের চালের হিসাবে গন্ডগোল পাকিয়ে দিতাম। মুঠো কিংবা কোরস ভর্তি চাল দিয়ে ধরা খেয়ে মায়ের হাতে ছোটবেলায় বেসুমার পিটুনি খেয়েছি।

চালপড়া দিয়ে চোর শনাক্তের পর্ব শুরু হলো। আমি কাঁচা চাল পেয়ে মহাখুশি। চালের রস কলাপাতায় ফেলবোতো দূরের কথা, মনে আছে মহানন্দে মুঠোয় মুঠোয় চাল সেদিন সাবার করতেছিলাম।

সবাই চাল চিবিয়ে কলা পাতায় মুখের ভাঙ্গা চালের রস ফেলে নিজেদেরকে নির্দোয প্রমান করে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আমাদের এক খালাতো ভাইকে নিয়ে!

খালাতো ভাইয়ের নাম বলা যাবে না। আমাদের বাড়িতে থেকে তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। আমাদের খালাতো ভাই কোনমতেই চাল চিবিয়ে রসালো করতে পারলেন না! একবার না, কয়েকবার তাকে চালপড়া দেয়া হলো। প্রতিবারই তিনি চাল চাবাতে ব্যর্থ হয়ে ছাবা ছাবা চালের গুড়া কলাপাতায় ফেলে, সন্দেহের তীর নিজের দিকে টেনে আনলেন। আর যায় কোথায়?

তার অবস্থা বেগতিক দেখে মায়ের কান্নাকাটি আর আহাজারীতে সেদিনের চালপড়া পর্বের ঘটনার ইতি হলো বৈকি।

তবে ঘটনা যাই হোক, পরদিন খালাতো ভাইয়ের অনুরোধে ড্রামের চাল পুনরায় মেঝেতে নামাতে গিয়ে যথাস্থানেই টাকাটা পাওয়া গেলো!

ফেলে আসা গ্রামীণ জনজীবন! আহা! কতোই না সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে ফেলে আসা সেই জীবন জুড়ে!

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

গ্রামীণ জনজীবনে আয়নাপড়া বাটিচালান চালপড়া -ডা. এম. নূরুল ইসলাম

আপডেট সময় : ১০:৩০:৪২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০২৩

গল্প
ডা. এম. নূরুল ইসলাম

তখন আমি বেশ ছোট। প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। একদিন সকালে বাড়িতে বেশ তুলকালাম ঘটনা ঘটে গেলো। আমাদের ঘর থেকে হারাই হাজার টাকা চুরি হয়ে গেলো! টাকাটা রাখা ছিলো মায়ের চাল ভর্তি ড্রামের ভিতরে। ধান বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা মায়ের কাছে দিলে, মা অনেক যত্ন করে সঙ্গোপনে ড্রামের চাল সরিয়ে, চালের অনেক গভিরে সেই টাকা রেখে দিলেন। সেই টাকা চুরি হয়ে গেলো!

কতো বড় সাংঘাতিক ঘটনা! পুরো বাড়ি ও পাড়া জুড়ে হইচই পড়ে গেলো। আমাদের বাড়ির ছোট থেকে বড় এমনকি বাড়ির আশপাশের অনেকের দিকেই সন্দেহের তীর! কিন্তু স্বীকার তো করছে না কেউ?

তখনকার দিনে আড়াই হাজার টাকা মানে, অনেক বড় একটা টাকা। বাবা একজনের জমি বন্ধক রেখেছিলেন, জমির মালিককে বন্ধকের টাকা দিতে গিয়ে মা খেয়াল করলেন ড্রামের চালের ভিতর টাকা নাই! মা কান্নাকাটি শুরু করলেন, বাবা ও বড় ভাই বকাঝকা করে পুরো বাড়ি মাথায় করে তুললেন।

আশেপাশের অনেক পাড়া-পড়শী ছুটে আসলো। সেদিন আমাদের ভাই-বোন কারোরই স্কুলে যাওয়া হলো না।

ড্রামের চাল বারবার পরীক্ষা করা হলো। ড্রাম খালি করে পুরো চাল মেঝেতে নামানো হলো। টাকার ছিটেফোঁটাও কোথায় নাই!

ঘরের ভিতরেরর আনাচ-কানাচ সবজায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজা হলো। কোথায়ও টাকা পাওয়া গেলো না। টাকার শোকে মা পাথর হয়ে গেলেন!

কিন্তু টাকাটা চুরি করলো কে? কার এতো বড় দুঃসাহস?

সন্দেহের তালিকায় বাড়ির ছোট-বড়, পাড়া-পড়সী সবাই। শুধু সন্দেহ করলেই তো হবে না, আসল চোরকে শনাক্ত করতে হবে। কিন্তু সেটাই বা কিভাবে?

ঠিক হলো বাটি চালান দেওয়া হবে। তাতেও কাজ না হলে আয়নাপড়া দেয়া হবে এবং চালপড়া খাওয়ানো হবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। পুরো বাড়ি জুড়ে মানুষে গিজগিজ করছে। আমাদের ছেলেপুলেদের উৎসাহের শেষ নাই। চোর ধরার যাবতীয় বিষয়গুলো নিয়ে ভয়ানকরকম গবেষণা চলছিলো আমাদের সবার মাঝে।

আমাদের গ্রামের প্বার্শবর্তী ঢালাগাঁও গ্রামের হাবিসাবের কাছ থেকে হাদিয়া দিয়ে চাল পড়িয়ে আনা হলো, দূরগ্রম বালিকান্দি থেকে এক মহিলার মাধ্যমে একটি নতুন আয়না কিনে আয়না পড়িয়ে আনা হলো এবং তুলারাশির জাতক দিয়ে পরদিন সকালে বাটিচালান দেয়ার সব রকম ব্যবস্থা করা হলো!

যাবে কোথায় চোর? তাকে ধরা পড়তেই হবে!

আয়নাপড়া দিয়ে সেদিন রাতেই চোর ধরার মহান অভিযান শুরু হলো।

পড়ানো আয়না রুমাল দিয়ে মোড়ানো আছে। গহীন রাতে তুলারাশির জাতক দিয়ে অন্ধাকারে আয়নার রুমাল সরালেই চোরের চেহারা আয়নায় ভেসে উঠবে! সেদিন রাতে চোর ধরার জন্য অতি উৎসাহ ও উত্তেজনায় আমাদের কারোই ভালো ঘুম হলো না! কার চেহারাটা না আবার ভেসে উঠে আয়নায়!

তুলারাশির জাতক এক মহিলাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। তার খাতির-যত্নের শেষ নাই। তবে তিনি বাড়ির সবাইকে দুঃসংবাদ দিলো। আয়নাতে চেহারার পেছনের দিক দেখতে পেয়েছেন তিনি! তার মানে চোর বাড়ির বাইরের কেউ হতে পারে! হায় আল্লাহ! কিন্তু বাইরের কেউ টা আবার কে? সবাই মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। এতো বড় সাহস কার?

সকালেই শুরু হলো বাটি চালান। সে এক বিরাট কান্ড। তুলা রাশির জাতক এক পুরুষকে বাড়িতে আনা হঢেছে। তাকে সবাই সমীহ করে চলছে। তার নাকি বিরাট ক্ষমতা। গ্রামে কতো বড় বড় চোর ধরার ইতিহাস যে আছে, তার কোন ইয়ত্বা নাই!

জাতক তার শরীর থেকে জামা খুলে ফেললেন। আমাদের উত্তেজনার শেষ নাই। চালের ড্রামের কাছ থেকেই বাটি চালান দেয়া হবে। চোর টাকা চুরি করে যে যে দিক অবলম্বন করে চলাফেরা করে অবশেষে যেখানে টাকা রেখেছে, বাটি সে দিকেই যাবে!

তুমুল উত্তেজনা! কার উপর গিয়ে বাটি উঠে একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে!

শুরু হলো বাটি চালান। তুলারাশির জাতক বাটি নিয়ে ঘরের ভিতরে এদিক সেদিক যাচ্ছেন, সবশেষে আমাদের ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বাটি বের হয়ে বাটি চললো মুগাই নদীর দিকে! ছেলেপুলে, ছোট-বড় সবাই ছুটছে বাটির পেছনে পেছনে। বড়রা ছোটদের ধমক দিচ্ছে, রাস্তা ক্লিয়ার রাখতে হচ্ছে, কোথায় দিয়ে কার উপরে বাটি উঠে যায় কে জানে!

বাটি চালান করতে করতে তুলা রাশির জাতক ঘেমেটেমে অস্থির! বাটি থামলো মুগাই নদীর পাড়ে আমাদের ঘাটের ঠিক কাছেই। মুগাই নদীতে পানি আছে। তার মানে? সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। বুঝতে কারোরই অসুবিধা হলো না, চোর টাকা চুরি করে বিভিন্ন রাস্তা ধরে মুগাই নদীর ঐ ঘাট দিয়েই নদী পার হয়ে পালিয়েছে! হায় আ্ল্লাহ, এখন উপায়? বাটি চালান সমাপ্ত হলো বৈকি!

বাকী থাকলো চালপড়া।

এইবার চোর ধরা পরবেই পরবে! উঠানে আনা হলো চালপড়া। সবাইকেই চাল চিবোতে হবে। যে চাল চিবাতে চিবাতে গুরু করতে পারবে না, সেই চোর!

কলাগাছের পাতা কেটে এনে সারিসারি করে উঠানে পাতানো হলো। চালপড়া চাল মুখ দিয়ে চিবিয়ে গুড়ো করে, অতঃপর সেই গুড়ো চালের রস কলাগাছের পাতায় সবাইকে এক এক করে ফেলতে হবে। চোর আর যাবে কোথায়?

ছোটবেলায় আমার কাঁচা চাল খাওয়ার বিরাট বাতিক ছিলো। মুঠোয় মুঠোয় কাঁচা চাল আমি অনায়েশেই সাবার করে ফেলতে পারতাম। কাঁচা চালে অসাধারন একটি সাদ আছে। চাল চিবাতে চিবাতে যখন রসে পরিনতো হয়, সেটার কী যে সাদ! আহা! মনে হয় এখনো জিহবায় সেই সাদ লেগে আছে!

মায়ের হিসাব করা চাল সারাদিন মুঠোয় করে, লুঙ্গি কিংবা হাফপ্যান্টের কোরসে করে ঘরের কোনে, নদীর পাড়ে, জঙ্গলের কাছে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে মায়ের চালের হিসাবে গন্ডগোল পাকিয়ে দিতাম। মুঠো কিংবা কোরস ভর্তি চাল দিয়ে ধরা খেয়ে মায়ের হাতে ছোটবেলায় বেসুমার পিটুনি খেয়েছি।

চালপড়া দিয়ে চোর শনাক্তের পর্ব শুরু হলো। আমি কাঁচা চাল পেয়ে মহাখুশি। চালের রস কলাপাতায় ফেলবোতো দূরের কথা, মনে আছে মহানন্দে মুঠোয় মুঠোয় চাল সেদিন সাবার করতেছিলাম।

সবাই চাল চিবিয়ে কলা পাতায় মুখের ভাঙ্গা চালের রস ফেলে নিজেদেরকে নির্দোয প্রমান করে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আমাদের এক খালাতো ভাইকে নিয়ে!

খালাতো ভাইয়ের নাম বলা যাবে না। আমাদের বাড়িতে থেকে তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। আমাদের খালাতো ভাই কোনমতেই চাল চিবিয়ে রসালো করতে পারলেন না! একবার না, কয়েকবার তাকে চালপড়া দেয়া হলো। প্রতিবারই তিনি চাল চাবাতে ব্যর্থ হয়ে ছাবা ছাবা চালের গুড়া কলাপাতায় ফেলে, সন্দেহের তীর নিজের দিকে টেনে আনলেন। আর যায় কোথায়?

তার অবস্থা বেগতিক দেখে মায়ের কান্নাকাটি আর আহাজারীতে সেদিনের চালপড়া পর্বের ঘটনার ইতি হলো বৈকি।

তবে ঘটনা যাই হোক, পরদিন খালাতো ভাইয়ের অনুরোধে ড্রামের চাল পুনরায় মেঝেতে নামাতে গিয়ে যথাস্থানেই টাকাটা পাওয়া গেলো!

ফেলে আসা গ্রামীণ জনজীবন! আহা! কতোই না সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে ফেলে আসা সেই জীবন জুড়ে!