ফররুখ আহমদ সাত সাগরের বিজয়ী কবি -ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

- আপডেট সময় : ০৯:৪১:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২ ১৯১ বার পড়া হয়েছে
ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়েছেন এমন মানুষের গল্প শুনেছো? হয়তো জানা নেই। আমিও জানি না। কারণ পাখির ডিমে তা দেওয়া মানুষের কাজ নয়। যারা করতে যায় তাদেরকে সবাই বোকা বলে। কিন্তু ডিমে তা দেওয়ার মতো বোকামি করেও দু’জন মানুষ খুব বিখ্যাত হয়েছেন। তাঁদের একজন টমাস আলভা এডিসন। অনেক বড়ো বিজ্ঞানী তিনি। আর একজন ফররুখ আহমদ। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন বড়ো কবি। দু’জনেই ডিমে তা দিয়েছেন। তা দিয়েছেন বোকামি করে নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য। পরীক্ষায় হয়তো সফল হননি। ডিম থেকে বাচ্চাও বের হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে জ্ঞানের ডিমে তা দিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর শিল্প-সাহিত্যের বাচ্চা ফুটাতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁরা। চলো আমরাও জ্ঞানের ডিমে তা দেই। তার আগে চলো ফররুখ আহমদের কবি হওয়ার গল্পটা পড়ে আসি।
যে কবির চোখ যতো সুন্দর তাঁর সাহিত্যকর্মও ততো নান্দনিক। চোখ মানে মনের চোখ। অন্তরের চোখ। সাধারণ মানুষ চোখের সামনে যা দেখেন কবিরা দেখেন তার চেয়ে একটু বেশি। গভীরে দেখেন। আরো নিখুঁতভাবে দেখেন। ছবির পেছনে ছবি। দৃশ্যের পেছনের কাব্যকলা। বিষয়বস্তুর পেছনের গল্প। সাগরের ওপারে সবুজবন। আকাশের নীলে জীবনের কইতর।
সুন্দর চোখের অধিকারী ছিলেন ফররুখ আহমদ। অন্তর্দৃষ্টি যেমন প্রখর তেমনি চোখের বাইরের অবয়বটাও ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। এক্কেবারে ডিমের মতো বড়ো বড়ো চোখ। মায়াবী কাজলে টানা ভুরু। বাঁশির মতো ঈগল ঠোঁটের নাক তাঁর চোখ দুটোকে আরো বেশি ঝলমলে করে তুলতো। আলতা-দুধে ফর্সা চেহারায় দারুণ মানাতো কবিকে। দরাজকণ্ঠে তিনি ছড়িয়ে দিতেন কবিতার রস। সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠান কিংবা বেতারে প্রচারিত সাহিত্যপাঠে তাঁর ভূমিকা ছিল সকলের কাছে প্রশংসিত।
বৃহত্তর যশোর জেলার মধুমতি পাড়ে জন্মেছেন ফররুখ আহমদ। ১৯১৮ সালের ১০ জুন। বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর। কাজের ব্যস্ততায় তিনি বাইরেই থাকতেন বেশি। মা রওশন আখতার তাঁকে বুকে আগলে রাখতেন। কিন্তু ফররুখের ছয় বছর বয়সেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ফররুখের দাদী ছিলেন জমিদার কন্যা। অভিজাত। শিক্ষিতা। তাঁর আদরেই বড়ো হন ফররুখ। দাদীর মুখে গল্প শুনে ঘুমিয়েছেন। দাতা হাতেম তায়ী, দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসীন, সত্যসাধক বাদশা আলমগীরের গল্প। আরো শুনতেন তাজকিরাতুল আউলিয়া, কাসাসুল আম্বিয়ার নন্দিত পাঠ। আরব্য উপন্যাসের সিন্দবাদ এবং আলী বাবার মজার কাহিনী। গল্পগুলো শুনেছেন। বুকের ভেতর একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করেছেন। তাইতো ফররুখ আহমদের সাহিত্য মানেই সিন্দাবাদ, আলীবাবা, হাতেম তায়ীসহ ঐতিহ্যের নায়কদের সমাবেশ।
ফররুখ আহমদের চেহারা যেমন সুন্দর তেমনি ছিল মনটাও। একটু চনমনে। একটু দুষ্টু। একটু আড্ডাবাজও ছিলেন। ঘরের চেয়ে বাইরের জগৎটাই তাঁর বেশি ভালো লাগতো। নদীর ধার। বাঁশের বন। কাশফুল। ফসলের মাঠ। পাখির ওড়াউড়ি। ছিমছাম বাসায় পাখির ছানা। পশুদের চলন-বলন। জীবনচক্র। মুক্ত বাতাসে ফসলের দোল। গ্রীষ্ম-বর্ষা। ঋতু-প্রকৃতি। এ সবের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। মুক্ত পাখির মতো উড়তেন। ইচ্ছে মতো ঘুরতেন। আবিষ্কার করতেন নতুন নতুন চিন্তার জগৎ। কিন্তু ফাঁকিবাজ ছিলেন না। লেখাপড়াতে ছিলেন ভীষণ আন্তরিক। ট্যালেন্ট ছাত্র। ভীষণ মেধাবী। কলকাতায় প্রাথমিক শিক্ষা, খুলনা জিলা স্কুলে প্রবেশিকা মানে মেট্রিক এবং আবারো কলকাতায় উচ্চতর শিক্ষা ইংরেজি সাহিত্যে।
সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। ফররুখের বন্ধুরাও ছিল খুব ভালো। গোলাম মোস্তফা, আবুল হাশিম, আবুল ফজল, সত্যজিৎ রায়, আবু রুশদ, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন কেউ কম নয়। শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবারই উজ্জ্বল ভূমিকা। কী সুন্দর বন্ধুজোট তাই না? মানিকে মানিক চেনে। বিষ্ণু দে, বুদ্ধুদেব বসু, প্রমথনাথ বিশীর মতো শিক্ষকের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। তাইতো অনেক কিছু শিখতে পেরেছেন। শিখেছেন বন্ধুদের আড্ডায়। শিক্ষকের ক্লাসে।
হাঁড়িত থাকলে ডইয়ত ওঠে। ছোটবেলায় আমার দাদী মা আমিরুন নেছা কথাটা প্রায়ই বলতেন। কথাটার মানে হলো- পাতিলে কিছু থাকলে তো চামচে উঠবে। শূন্য পাতিলে চামচ চালালেও খালি চামচ উঠে আসবে। ফররুখ আহমদের জ্ঞানের হাঁড়ি বা ভান্ডার ছিল সমৃদ্ধ। তাইতো চামচে উঠে এসেছে অনেক কিছু। ছড়া, কবিতা, গান, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ সব কিছুই উঠে এসেছে তাঁর কলমের চামচে। সব কিছুতেই কী অসাধারণ মজা মাখানো! মনে হয়, যা চাই তাই পাই।
এই ধরো, ফররুখ আহমদের মতো তোমার মনটাও কখনো কখনো বাউণ্ডুলে হয়। হয় না? ‘চৈতি মাঠে গনগনে রোদ্দুরে, ইচ্ছে করে বেড়াই ঘুরে ঘুরে।’ ‘আম বাগানে যাই ছুটে যাই, কাঁচা আমের সোয়াদ যে পাই, ক’দিন পরে পাকবে রে ভাই, লাল গোলাপি ডুরে।’ ফররুখ আহমদ তখন এভাবেই ঘুরেছেন। কী! তোমারও এভাবে ঘুরতে ইচ্ছে করে তো? আমি কিন্তু খুব ঘুরতাম। ফররুখ আহমদের মতো। এখনো ঘুরতে ইচ্ছে করে। পাখির বাসা দেখেছো কখনো? খড়কুটো দিয়ে কী সুন্দর করে বাসাগুলো বানায় ওরা! মমতা-মায়ায় গড়া এ বাসা। সেখানে ওরা ডিম দেয়। বাচ্চা ফুটায়। ফুলের মতো, তুলোর মতো বাচ্চা। পাখির ছানা দেখেছো কখনো? ফররুখ আহমদ ডাকছেন-
‘আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া দিনটাতে
পাখির বাসা খুঁজতে যাব একসাথে।
কোন বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙে থাকে কোন বাসাটায়
কোন বাসাতে দোয়েল ফেরে সাঁঝ রাতে।
ঝিলের ধারে ঝোপের মাঝে
কোন বাসাটা লুকিয়ে আছে
কোন বাসাতে বাবুই পাখির মন মাতে।
নদীর ধারে নিরালাতে
গাঙ শালিকের বাস যেটাতে
রাত্তিরে সে থাকে, এখন নেই তাতে।
মজা না? হুম। সত্যি দারুণ মজা। তোমাদের অনেকেই এখন অবশ্য ভিডিও গেমস কিংবা কার্টুন দেখে সময় কাটাও। আমাদের সময় ওসব ছিল না। এখন আছে। কিন্তু ভালো লাগে না। ভালো লাগিয়ে লাভ কী বলো? সেখানে কি বাস্তব কিছু শেখা যায়? শুধু শুধু সময় নষ্ট। নেশার ঘোরে আমার সময়গুলো চুরি করে নিয়ে যায় ওরা। বিপরীতে, ফররুখের মতো বাউণ্ডুলে মজায় বাস্তব অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। ন্যাচারাল জীবন। মজাই মজা। অবশ্য এর জন্য বুকে সাহস থাকতে হয়। কষ্ট করার মানসিকতা থাকতে হয়। গেমস খেলতেও নাকি সাহস লাগে। গেম খেলে কেউ সাহসী হয়েছে কখনো? বরং মন মরা হয়েছে। বিষণœতায় ডুবেছে। অনেকে আত্মহত্যাও করেছে। করেছে না? এটাকে সাহস বলে না। জীবন একটা যুদ্ধের নাম। কষ্ট করে বিজয় করতে হয়। কষ্ট করে না পড়লে কি ভালো রেজাল্ট করা যায়? জীবনে সফল হতে গেলে কষ্ট করতে হয়। অথচ তোমাদের বন্ধুদের অনেকেই গেমসের পাল্লায় পড়ে অলস সময় কাটায়। রাতভর গেমস আর দিনে ঢুলুঢুলু আলসে ঘুম। অবশেষে রেজাল্ট খারাপ। শিক্ষকের ভর্ৎসনা। আব্বা-আম্মার গালি। তখন জীবন হয়ে ওঠে পানসে। সবশেষে জীবন নামের স্বপ্নফুলের অপমৃত্যু। এটা কোনো জীবন হলো?
সত্যিকারের মানুষেরা সাহসী হয়। ফররুখ আহমদও সাহসী ছিলেন। সাহসী ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। সাহসী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। টিপু সুলতান, তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ, হাজী মুহাম্মদ মহসীন সবাই সাহসী ছিলেন। ওত পেতে থাকা হুতোম পেঁচাদের ভয় পায়নি তারা। ভয়কে জয় করেছেন। তাইতো সবাই বিখ্যাত হয়েছেন। কবি ফররুখ আহমদ তাইতো বলেন-
‘ভয়ে পালায় বোকা,
ভয় পায় না খোকা!
খোকন সোনার সাহস ছিল,
বুদ্ধি ছিল চোখা;
ভয় না পেয়ে ভেঙে দিল
হুতোম পেঁচার ধোঁকা।’
ফররুখ আহমদ ছোটোবেলা থেকেই ভীষণ মানবিক ছিলেন। অন্যের জন্য কিছু করতে পারলেই ভালো লাগতো তাঁর। সারা জীবন সেভাবেই কেটেছে তাঁর জীবন। পরের উপকার করতে পারলেই মজা পেতেন। মনটা পরিতৃপ্ত হতো।
একটা ঘটনা বলি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কথা তোমরা শুনেছো। বাংলা ১১৭৬ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল পুরো বাংলাজুড়ে। ইংরেজি বছরের ১৭৭০ সাল সেটি। ইংরেজ ফড়িয়া দালালদের অত্যাচারে প্রায় এক কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যায়। ইংরেজি ১৯৪৩ সালে আবারো একটা দুর্ভিক্ষ আসে। বাংলা সন অনুযায়ী ১৩৫০ সাল। এটাকে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ বলা হয়। এ সময়ও অগণিত লোক না খেয়ে মারা গেছে। কবি ফররুখ আহমদ এ সময়ের কোনো এক দিন রেলগাড়িতে কলকাতা থেকে যাদবপুর স্টেশনে নামলেন। সাথে ছিলেন তাঁর ভাগ্নে সুলতান আহমদ। তিনিও একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক। কবি ফররুখ আহমদ দেখলেন, স্টেশনে পড়ে আছে একজন মানুষ। মর মর অবস্থা। কবি কাছে গেলেন। ভাগ্নে সুলতানকে বললেন দুধ কিনে আনতে। যত্ন করে লোকটিকে খাওয়ালেন। কিছুক্ষণ পরে লোকটা চোখ খুলে তাকালেন। একটু মিষ্টি হাসির আভাস পাওয়া গেল। তিনি লোকটাকে যাদবপুর লঙ্গরখানায় পৌঁছে দিলেন।
আর একটি ঘটনা বলি। ঢাকা বেতারে চাকরি করেন কবি। সহকর্মীদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক তাঁর। একজন শিল্পী ছিলেন খুব গরিব। সামান্য বেতনে কোনো রকমে সংসার চালান। তিনি কবির কাছে এসে কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। রক্ত দিতে হবে এখনই। কাছে টাকা নেই। কবি ফররুখ শুনলেন। নিজেও অশ্রুসিক্ত হলেন। ওই দিনই বেতন পেয়েছেন কবি ফররুখ। বেতনের সব টাকা সেই শিল্পীর হাতে তুলে দেন। লোকটি অবাক হয়ে ফররুখ আহমদের দিকে তাকিয়ে দুআ করলেন। হৃদয়ের মাঝে এমন খাঁটি ভালোবাসা জমাতেন বলেই তো মহৎ। আমাদেরকেও দরদি হতে বলেছেন তিনি। কবি লেখেন-
‘খোকন যাবে কার বাড়ি?
খোকন যাবে তার বাড়ি
নাই জামা যার; নাই গাড়ি
খোকন যাবে কার নায়ে?
খোকন যাবে তার না’য়ে
নাইরে মাঝি যার না’য়ে।’
‘সাত সাগরের মাঝি’ কবি ফররুখ আহমদের অনবদ্য সৃজন। সিন্দাবাদকে প্রতীক বানিয়ে তিনি বিশ্বজয় করেছেন। কবিতাটি বড়দের উপযোগী। তাই বলে শিশুরা স্বপ্ন দেখবে না? কবি ফররুখ তো বড়োদের, শিশুদের, কিশোরের, সকলের। সাত সাগর বিজয়ের স্বপ্ন তৈরিতে তাইতো তিনি তোমাদের জন্য লিখেছেন-
‘সাত সাগরের মাঝি
জাহাজটা তার তাজি
সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি
নিয়ে সে যায় দূরে
দেশ-বিদেশের ঘুম ভাঙাবে
সাতটা সাগর ঘুরে।’
সাহস নিয়ে কাজ করেছেন ফররুখ আহমদ। লিখেছেন মানুষের জন্য। সততার সাথে লিখেছেন। সত্য কথা লিখেছেন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে সত্য মেনে চলেছেন। কথায় কাজে মিল রেখে চলা কবিদেরও কবি তিনি। সব ধরনের লোভ তিনি দু’পায়ে ঠেলে ফেলেছেন। কারো প্রলোভনে পা রাখেননি তিনি। সততার সাথে চলতে গিয়ে অভাবের তাড়না সয়েছেন। খাবার ছিল না। চিকিৎসার টাকা ছিল না। তবুও তিনি সত্যের পথে ছিলেন আলিফের মতো খাড়া। খ্যাতির পিছনে ছোটেননি তিনি। তবুও খ্যাতি ঘিরে রেখেছে তাঁকে। প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার সবই অর্জিত হয়েছে তাঁর। যোগ্যতা থাকলে পুরস্কার এমনিতেই আসে। খ্যাতির পেছনে ছোটা নয়, যোগ্যতা অর্জন করে খ্যাতিকে পেছনে ছুটানো শিখতে হবে। কবি ফররুখ আহমদ সেটাই শিখিয়েছেন চলনে বলনে লিখনে।
১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর শনিবার তিনি চলে গেছেন ওপারে। আজও আমাদের অনুকরণীয় কবিসত্তা ফররুখ আহমদ।