শিক্ষকদের কেন স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রয়োজন

- আপডেট সময় : ০২:৩০:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জুলাই ২০২৪ ১৯১ বার পড়া হয়েছে
অধ্যাপক ড. মোঃ নজরুল ইসলাম, শাবিপ্রবি, সিলেট
সমগ্র দুনিয়া চায় সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলি শিক্ষকতা পেশায় আসুক। আর এই দেশ চায়, এই দেশের রাজনৈতিক নেতারা চায় সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলি দেশ থেকে যেন চলে যায়।
শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী ছেলেমেয়েদের আকৃষ্ট করতে তারা সবচেয়ে বেশী বেতন ও সুযোগ সুবিধা দেয় শিক্ষকদের। এটা একেবারে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। আর এই দেশে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণীর বেতন পান, গ্রেড 13/14। অথচ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে পাশ করা এই শিক্ষকের সহপাঠী যখন অন্য পেশায় যায় সে প্রথম শ্রেণীর গ্রেড 9 বেতন পায়। কি লজ্জার!
এক শ্রেণীর লোক আছে যুক্তি দেয় যে, শিক্ষক তো জেনে বুঝেই এই বেতন ভাতা দেখেই এই পেশায় আসে। কাজেই অসুবিধা কি? কুপমন্ডুক না হলে এ কথা কেউ বলতে পারে না। আসবে না কি করবে, বাচা তো লাগবে। আসতে তো বাধ্য হয়। সে জন্য এই অন্যায়কে বৈধ বলা যাবে?
তো বাপু একই বেতন স্কেল। একজন গ্রেড 5 এ থেকে গাড়ি কেনার জন্য তাকে 50 লাখ এবং সেই গাড়ি চালানোর জন্য মাসে মাসে আরও 50 হাজার করে দিবেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গ্রেড 3 বা 2 বা এমনকি 1 এ থেকেও এই সুবিধা পাবে না। এটা কোন জাস্টিস? এগুলো বলতে ভাল লাগে না। মেধাবী ছেলেমেয়েরা এই পেশায় কেন আসতে চাইবে? এটা কি খুব ভাল লক্ষণ? উনমেধাবীরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়, তারা কি পড়াবে আর কি গবেষণা করবে? ছাগল দিয়ে হালচাষ করাবেন?
কি চমৎকার চাতুর্য! তোমরা যারা অলরেডি শিক্ষক আছো তোমরা এই পেনশন স্কীমের আওতায় পড়বা না। যারা 1 জুলাই 2024 এবং এর পরে যোগদান করবে এই খড়গ তাদের উপর বর্তাবে। আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে আন্দোলন করছেন এটা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত কোন স্বার্থের জন্য নয়। কারণ তারা কথিত পেনশন স্কীম অনুযায়ী এফেক্টেড হবেন না। তাহলে আন্দোলন কিসের জন্য? যারা 1 জুলাই বা এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করবেন তাদের জন্য। এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশিষ্ট ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য। আজকে আমাদের যারা ছাত্র যারা শিক্ষক হবেন তাদের জন্য। এবং সর্বোপরি এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা বাঁচানোর জন্য।
কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই আন্দোলন বর্তমান শিক্ষকদের কোন স্বার্থের জন্য আন্দোলন না। তাদের ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থের জন্য আন্দোলন। ছাত্রছাত্রীদের এটা বুঝতে হবে। আজকে যদি শিক্ষকরা এই আন্দোলন না করে আগামী প্রজন্মের শিক্ষক যারা কথিত 1 জুলাই বা এর পরে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করবে তারা আমাদের ক্ষমা করবে না। এই আন্দোলন না করাটাই হবে শিক্ষকদের স্বার্থপরতা।
এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হলে কাদের লাভ কাদের ক্ষতি তা সহজেই অনুমেয়। চাকর দালালরা এটা বুঝবে না। কারণ সব ব্যবস্থায়ই তারা চাটুকারিতা ও দালালির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। কিন্তু স্বাধীনচেতা ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ তা পারবে না।
শিক্ষকদের আন্দোলন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। দল মত নির্বিশেষে সকল শিক্ষক এই আন্দোলন করছেন। এই আন্দোলন সফল না হলে এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কফিনের উপর শেষ পেরেক পড়বে। উচ্চ শিক্ষার কফিনের উপর শেষ পেরেকটা পড়বে। এটা হতে দেওয়া যায় না।
শিক্ষকদের তিনটি দাবী:
এক, কথিত বৈষম্যমূলক পেনশন স্কীম বাতিল করা।
দুই, শিক্ষকদের সুপার গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করা।
তিন, স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা।
আমি মনে করি এই স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত হওয়া দরকার। সব পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন সব থেকে বেশী হওয়া উচিত। এই সরকারের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী জনাব নূরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব তাঁর মন্ত্রিত্বকালে বার বার ওয়াদা করেছিলেন শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণের। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে ওয়াদা এ সরকার পুরণ করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেন স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দরকার, কেন তাদের অতুলনীয় মান মর্যাদা ও স্বীকৃতি দরকার, কেন তাদের স্বায়ত্বশাসন ও একাডেমিক ফ্রিডম দরকার–যদি বিশ্ববিদ্যালয় কি জিনিস সে সম্পর্কে ধারণা থাকে তবে অবশ্যই বুঝবেন। আর যদি এ সম্পর্কে ধারণা না থাকে বা যাদের ধারণা নাই তারা কষ্ট করে এই একটা বই পড়তে পারেন। কার্ডিনাল জন হেনরি নিউম্যান এর। ব্রিটিশ এই ক্যাথলিক ধর্মযাজক ও শিক্ষাবিদ 1852 সালে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে একটি ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন পোপকে লিখেছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হওয়া উচিত সেই বিবরণ তিনি দিয়েছেন তার এই বইয়ে। বইটির শিরোনাম: The Idea of a University.
উল্লেখ্য যে, 1829 সালের আগে গ্রেট ব্রিটেনে ক্যাথলিকদের কোন রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। এমন কি কোন ক্যাথলিক ছাত্রছাত্রী এই সময়ে ব্রিটেনের কোন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে ভর্তি হতে পারত না। ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্টদের সংঘাত সে আরেক ইতিহাস। যাই হোক ডাবলিনে তখন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যার রেক্টরের (ভিসি) দায়িত্ব পান স্বয়ং কার্ডিনাল নিউম্যান। এটিই আজকের ডাবলিন ইউনিভার্সিটি। 1852 সালে লেখা নিউম্যানের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত এই ধারণা পৃথিবীর বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণ করে এবং এই ধারণার আলোকে চলে। আগ্রহী পাঠকগণ বইটি পড়ে দেখতে পারেন, যারা এখনও পড়েননি।