সুনামগঞ্জ ০৮:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
পুরান বারুংকা মডেল মাদরাসায় ফ্রি চক্ষু শিবির অনুষ্ঠিত রেনেসাঁ ইসলামিক সোসাইটির উদ্যোগে ফ্রি ব্লাডগ্রুপ নির্নয় তাহিরপুরে আগুনে পুড়ে ছাই বসতঘর, ১৩ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি  পুরান বারুংকা মডেল মাদরাসায় ফ্রি চক্ষু শিবির অনুষ্ঠিত তাহিরপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’র হামদ নাত ক্বিরাত প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণ সম্পন্ন সততা ও দক্ষতা ব্যবসার মূল পূঁজি : মোঃ শহিদুল ইসলাম ছাতকে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দীক গ্রেফতার দোয়ারাবাজারের ইউএনও নেহের নিগার তনু’র প্রত্যাহারের দাবিতে বিভাগীয় কমিশনারের বরাবর আবেদন কাঠইর ইউনিয়নে জামায়াতের গণসংযোগ শান্তিগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ালেন শিল্পপতি মইনুল ইসলাম

লেখাটি দীর্ঘ: তবে পড়ার অনুরোধ

ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, যুক্তরাজ্য
  • আপডেট সময় : ১০:৩৫:৫৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫ ১০৬ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গত পনেরো বছর চোখের সামনে যেসব ভাই বেরাদার বন্ধুদের খুব কাছ থেকে দেখেছি গত পাঁচ মাস থেকে সেই সব মানুষগুলোকে আমি কেমন যেন ভিন্ন ভাবে দেখছি। তাদের অতীত চেহারা আর বতর্মান চেহারা যখন দেখি মাঝেমাঝে মিটমিটিয়ে হাসি। তবে অবাক হইনা কারন এগুলো আমি বুঝতে পেরেছি আগেই এবং তখন এই সংক্রান্ত একটা লেখাও লিখেছিলাম।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হত‍্যার পর সারা দেশে যখন সাহারা খাতুন “আমার আদেশ শিরোধার্য” বলে সারাদেশে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে। এর আগের দিন শুক্রবার নগরীর কোর্ট পয়েন্ট থেকে জুম্মার পর একটা ঐতিহাসিক মিছিল বের হয়। ডাক্তার শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কোর্ট পয়েন্ট বনফুলের সামনে মিছিল আটকে দেয় পুলিশ। মিছিল নিয়ে ঘুরে বন্দর, জেল রোড, নয়া সড়ক হয়ে চৌহাট্টা পয়েন্টে গিয়ে সমাবেশের মাধ‍্যমে মিছিল শেষ হয়।

মিছিল শেষে মানুষ ফিরে যাওয়ার পথে নিরীহ জনতার উপর গুলি, লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। গোটা চৌহাট্টা জিন্দাবাজার আম্বরখানা হাওয়াপাড়া নয়া সড়ক পযর্ন্ত রনক্ষেত্রে পরিনত হয়। সেদিন এডভোকেট জুবায়ের ভাইকে গ্রেফতার করলেও জনতার রোষানলে পড়ে ছেড়ে দেয়। মাওলানা হাবিব ভাইয়ের পায়ে আঘাত করে পুলিশ, রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন হাবিব ভাই। জুবায়ের ভাইকে পুলিশের হাত থেকে লাফ দিয়ে ঝাপটে ধরে ছুটিয়ে নিয়ে আনেন শিপার ভাই।

জিন্দাবাজার ব্র‍্যাক ব‍্যংকের সামনে শিবিরের মিছিলে হামলার পর তৎকালীন মহানগর শিবিরের প্রচার সম্পাদক হাফিজ সোহেল আহমদকে রাস্তায় ফেলে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে অর্ধমৃত করে রাখে পুলিশ।

আরেকদিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কোর্ট পয়েন্ট থেকে জিন্দাবাজার অভিমূখে মিছিল শুরু হয়। লন্ডন ম‍্যানশনের সামনে আসা মাত্র পিছন থেকে এবং জিন্দাবাজার পয়েন্ট থেকে এক সাথে ঘিরে হামলা চালায় পুলিশ। একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেডে প্রকম্পিত হয়ে উঠে জিন্দাবাজার। তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে। আমরা জুবায়ের ভাইকে ঠেলে লন্ডন ম‍্যানশনের ভিতরে ঢুকিয়ে দেই। এরপর ব‍্যবসায়ীরা গেইট লাগিয়ে দিয়ে জুবায়ের ভাইকে সেইভ করে ভিতরে নিয়ে যান। তখন দুইটা গ্রুপ পুলিশের সাথে বৃষ্টির মধ‍্যে কন্টিনিউ কয়েক ঘন্টা সংঘর্ষ চালিয়ে যেতে থাকে। সেদিন বৃষ্টি থাকায় টিয়ার গ‍্যাসের ঝাঁঝ কাজ করছিলোনা।

সেই সময় শাবি শিবিরের সাবেক সভাপতি আনোয়ার ভাইকে জিন্দাবাজারের রাস্তায় ফেলে বুন্দুকের বাট ও বুট দিয়ে আঘাত করতে করতে রক্তাক্ত করে রাখে। সেদিন বৃষ্টির পানির সাথে আনোয়ার ভাইয়ের রক্তে লাল হয়ে যায় জিন্দাবাজারের রাজপথ।

সেদিন সন্ধ‍্যা পর্যন্ত লন্ডন ম‍্যানশন থেকে যেকোন সময় জুবায়ের ভাই গ্রেফতার হবেন এই আশংকায় আমি আর আমার দেশের বেলায়েত ভাই লন্ডন ম‍্যানশনের গেইটে সন্ধ‍্যা পযর্ন্ত বৃষ্টিতে ভিজে দাড়িয়ে থাকি। মাগরিবের পর বেলায়েত ভাই ফখরুল ভাইকে ফোন করেন। ফখরুল ভাই বলেন তোমরা চলে আস জুবায়ের ভাইকে আমরা সেইভ করেছি।

টানা অবরোধে যখন প্রতিদিন ফজরের পর থেকেই মিছিল মিটিং পিকেটিং হতো। হুমায়ূন রশীদ চত্বরে ১৮ দলীয় জোটের মিছিলে একাধিক দিন হামলা গুলি নিত্য দিনের ব‍্যপার ছিল। একবার পুলিশ গুলি করার পর একটি দোকানে এমএ হক ও জামায়াতের একজন মুরব্বি দায়িত্বশীল আটকা পড়েন। আমি মোটর সাইকেল চালাতে পারিনা। তাৎক্ষণিক একজন সিনিয়র সাংবাদিক মোটর সাইকেল নিয়ে এসে তার মোটর সাইকেলে তুলে ফেঞ্চুগঞ্জ রোড হয়ে পাঠানপাড়া পৌছে নিরাপদ করে দেন।

সেদিন সানী সহ অসংখ্য মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হাত নিয়ে তেমুখী বাইপাস পর্যন্ত লড়াই করতে করতে টিপু ভাই সানীরা ফিরে আসেন।

জেলরোড, বন্দর পেপার পয়েন্ট তো ঐ দিনগুলো ছিল আমাদের কাছে ডাল ভাতের মতো।

কাদের মোল্লার ফাঁসির রাত!
গভীর রাত তখন দেড়টা। গোটা নগরী পিন পতন নিরবতা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা নগরী। আমি, সহকর্মী আহবাব ভাই ও সংগ্রাম কবীর ভাই হাতের কাজ শেষ করে চা খেতে বন্দর মাশরাফি রেষ্টুরেন্টে যাই। ঐ একটা রেষ্টুরেন্ট ছাড়া আর কোন দোকান কোন মানুষ শহরে ছিলনা। আওয়ামীলীগ নেতারা প্রাণ ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। কোতোয়ালি থানার গেইটে পাচ কেজি ওজনের তালা ঝুলানো। পুলিশ র‍্যাব বিজিব হর্ণ বাজিয়ে মহড়া দিচ্ছে। গোটা শহর যেনো একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান।

সেই কঠিন দু:সময়ে এই নগরীর বুক চিরে কাপা কাপা হাতে কাদের মোল্লা ভাইয়ের ফাসির নিউজ আর শহরের সকল নিউজ লিখে রাত চারটায় মেসে পৌছি। ফজরের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলে কাঁদি।

পরদিন আলীয়ার মাঠে জানাযায় সায়েফ ভাইয়ের কান্না! আর আমার নিউজ “মাদ্রাসা মাঠে হাজারো মানুষের বুক ফাটা কান্না”।

শহীদ রাহাত যেদিন গুলিবিদ্ধ হয় সেদিন বাংলা ভিশনের দীপু ভাই চৌহাট্টা থেকে আমাকে মোটর সাইকেলে তুলেন। হাওয়া পাড়া গলির মুখে যাওয়ার পর আর সামনে যেতে পারিনি। তখন গুলিবিদ্ধ রাহাতকে উইমেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অপরদিকে হাওয়া পাড়া, নয়াসড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়েকটি গ্রুপ পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে। ওসি আতাউর একেবারে বেফানা হয়ে চারদিকে গুলি আর গ‍্যাস ছাড়ছে। গ‍্যাসের ঝাঁঝ সহ‍্য করতে না পেরে আমি দৌড়ে মানরুতে ঢুকে পড়ি।

এরপর রাহাত ওসমানীতে যাওয়া, ঢাকায় যাওয়া, শাহাদাত বরণ করা, লাশ বাড়িতে আসা পযর্ন্ত একের পর এক নিউজ আমি আর কামরুল করতে থাকি।
শহীদ রাহাতের জানাযায় প্রচন্ড রোদ ছিল। আমি কালো সানগ্লাস পরা ছিলাম। মাওলানা লোকমান ভাইয়ের বক্তব্যের সময় আমার কান্না চলে আসে। আমার পাশে দাড়িয়ে নোট করছিল ডিজিএফআই এর খালেদ। তার বাড়ি ছিল ধর্মপাশা। আমি সানগ্লাস খুলে চোখের পানি মুছি। তখন সে বললো আপনি কাঁদেন কেন? আপনিও কি শিবির করতেন? আমি বললাম জি অবশ্যই আমি শিবির করেছি।

এমসি কলেজ হোস্টেল পড়ানোর ঘটনা কিংবা সায়েফ ভাই হারুন ভাইয়ের বাড়ি পুড়ানোর ঘটনা সহ অসংখ্য ঘটনা তো সবার চোখের সামনেই ছিলো।

এই যে কয়েকটি উল্লেখিত ঘটনার স্মৃতিচারণ করলাম ঐসময়টাতে অধিকাংশ মানুষ জামায়াতের আশেপাশে আসতোনা। অনেক সাংবাদিক ছাত্রজীবনে শিবির করতেন পরবর্তীতে সাংবাদিকতায় গিয়েছেন কিন্তু ঐসময় তারা প্রকাশ‍্যে টিভি ক‍্যামেরায় বা পত্রিকায় জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রকাশ‍্যে বলেছেন লিখেছেন আমাদের চোখের সামনেই। গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেন। জামায়াতের তান্ডব, জামায়াত বিদ‍্যুৎ অফিসে হামলা চালিয়েছে এমন কতো ঘটনা তখন শয়তান ও মুচকি হাসতো!

জুবায়ের ভাইয়ের ইলেকশনের সময় অনেক কাছের মানুষ কাছে আসতোনা। আমি সহ আমরা কয়েকজন সাংবাদিকতার সকল ইথিকসের বাইরে গিয়ে প্রকাশ‍্যে জুবায়ের ভাইয়ের পক্ষে স্ট‍্যন্ড নেই। অনেকেই তখন কামরান ভাই আরিফ ভাইয়ের পক্ষে গলাগলি ভাব করেন এমনকি খামও পান।

সেসময় অনেকেই আমার ভূমিকার জন্য সমালোচনাও করেন। এও বলতে শুনেছি আমি সাংবাদিকতা ও কৌশল বুঝিনা।

এখন গত ৫ আগষ্টের পর থেকে ঐ চরিত্রের মানুষ গুলো দেখি পুরোটাই বদলে গেছে। এখন জামায়াত নেতাদের সাথে তাদের উঠাবসা সেলফি, জামায়াতের সংবাদ সম্মেলনে ‘দাত মুরাইয়া মুরাইয়া’ প্রশ্ন করা দেখে আজ নিজেকে বড়ই অচেনা মনে হয়।

এখন এসে অনেকেই মনে করে আমরা ইসলাম বুঝিনা, আন্দোলন বুঝিনা, সংগঠন বুঝিনা, এখন এসে অনেকেই এগুলো নতুন করে বুঝাতে চান।

আমরা যে সাংবাদিকতা করে এসেছি এখন সেই সাংবাদিকতা নেই। আগের মতো বতর্মান সাংবাদিকতাকে এখন আর ধারণ করিনা। তবে সাংবাদিকতাকে যতোটা ধারন করতাম ঠিক ততটাই ধারন করতাম গণ মানুষের রাজনীতিকে। এখনো আমার চিন্তা চেতনায় কল্পনায় গণ মানুষের রাজনীতি।

আজ সুসময়ে এসে যদি আমাদের অতীত কেউ ভুলে যায় তাদের জন্য আমাদের কোন আফসোস নেই। তবে আবার কোনদিন মজলুম হয়ে গেলে অবশ্যই আমরা মজলুমের পক্ষে সত‍্যের পক্ষে সেই ঝান্ডা আবারও তুলে ধরবো।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

লেখাটি দীর্ঘ: তবে পড়ার অনুরোধ

আপডেট সময় : ১০:৩৫:৫৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫

গত পনেরো বছর চোখের সামনে যেসব ভাই বেরাদার বন্ধুদের খুব কাছ থেকে দেখেছি গত পাঁচ মাস থেকে সেই সব মানুষগুলোকে আমি কেমন যেন ভিন্ন ভাবে দেখছি। তাদের অতীত চেহারা আর বতর্মান চেহারা যখন দেখি মাঝেমাঝে মিটমিটিয়ে হাসি। তবে অবাক হইনা কারন এগুলো আমি বুঝতে পেরেছি আগেই এবং তখন এই সংক্রান্ত একটা লেখাও লিখেছিলাম।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হত‍্যার পর সারা দেশে যখন সাহারা খাতুন “আমার আদেশ শিরোধার্য” বলে সারাদেশে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে। এর আগের দিন শুক্রবার নগরীর কোর্ট পয়েন্ট থেকে জুম্মার পর একটা ঐতিহাসিক মিছিল বের হয়। ডাক্তার শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কোর্ট পয়েন্ট বনফুলের সামনে মিছিল আটকে দেয় পুলিশ। মিছিল নিয়ে ঘুরে বন্দর, জেল রোড, নয়া সড়ক হয়ে চৌহাট্টা পয়েন্টে গিয়ে সমাবেশের মাধ‍্যমে মিছিল শেষ হয়।

মিছিল শেষে মানুষ ফিরে যাওয়ার পথে নিরীহ জনতার উপর গুলি, লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। গোটা চৌহাট্টা জিন্দাবাজার আম্বরখানা হাওয়াপাড়া নয়া সড়ক পযর্ন্ত রনক্ষেত্রে পরিনত হয়। সেদিন এডভোকেট জুবায়ের ভাইকে গ্রেফতার করলেও জনতার রোষানলে পড়ে ছেড়ে দেয়। মাওলানা হাবিব ভাইয়ের পায়ে আঘাত করে পুলিশ, রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন হাবিব ভাই। জুবায়ের ভাইকে পুলিশের হাত থেকে লাফ দিয়ে ঝাপটে ধরে ছুটিয়ে নিয়ে আনেন শিপার ভাই।

জিন্দাবাজার ব্র‍্যাক ব‍্যংকের সামনে শিবিরের মিছিলে হামলার পর তৎকালীন মহানগর শিবিরের প্রচার সম্পাদক হাফিজ সোহেল আহমদকে রাস্তায় ফেলে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে অর্ধমৃত করে রাখে পুলিশ।

আরেকদিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কোর্ট পয়েন্ট থেকে জিন্দাবাজার অভিমূখে মিছিল শুরু হয়। লন্ডন ম‍্যানশনের সামনে আসা মাত্র পিছন থেকে এবং জিন্দাবাজার পয়েন্ট থেকে এক সাথে ঘিরে হামলা চালায় পুলিশ। একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেডে প্রকম্পিত হয়ে উঠে জিন্দাবাজার। তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামছে। আমরা জুবায়ের ভাইকে ঠেলে লন্ডন ম‍্যানশনের ভিতরে ঢুকিয়ে দেই। এরপর ব‍্যবসায়ীরা গেইট লাগিয়ে দিয়ে জুবায়ের ভাইকে সেইভ করে ভিতরে নিয়ে যান। তখন দুইটা গ্রুপ পুলিশের সাথে বৃষ্টির মধ‍্যে কন্টিনিউ কয়েক ঘন্টা সংঘর্ষ চালিয়ে যেতে থাকে। সেদিন বৃষ্টি থাকায় টিয়ার গ‍্যাসের ঝাঁঝ কাজ করছিলোনা।

সেই সময় শাবি শিবিরের সাবেক সভাপতি আনোয়ার ভাইকে জিন্দাবাজারের রাস্তায় ফেলে বুন্দুকের বাট ও বুট দিয়ে আঘাত করতে করতে রক্তাক্ত করে রাখে। সেদিন বৃষ্টির পানির সাথে আনোয়ার ভাইয়ের রক্তে লাল হয়ে যায় জিন্দাবাজারের রাজপথ।

সেদিন সন্ধ‍্যা পর্যন্ত লন্ডন ম‍্যানশন থেকে যেকোন সময় জুবায়ের ভাই গ্রেফতার হবেন এই আশংকায় আমি আর আমার দেশের বেলায়েত ভাই লন্ডন ম‍্যানশনের গেইটে সন্ধ‍্যা পযর্ন্ত বৃষ্টিতে ভিজে দাড়িয়ে থাকি। মাগরিবের পর বেলায়েত ভাই ফখরুল ভাইকে ফোন করেন। ফখরুল ভাই বলেন তোমরা চলে আস জুবায়ের ভাইকে আমরা সেইভ করেছি।

টানা অবরোধে যখন প্রতিদিন ফজরের পর থেকেই মিছিল মিটিং পিকেটিং হতো। হুমায়ূন রশীদ চত্বরে ১৮ দলীয় জোটের মিছিলে একাধিক দিন হামলা গুলি নিত্য দিনের ব‍্যপার ছিল। একবার পুলিশ গুলি করার পর একটি দোকানে এমএ হক ও জামায়াতের একজন মুরব্বি দায়িত্বশীল আটকা পড়েন। আমি মোটর সাইকেল চালাতে পারিনা। তাৎক্ষণিক একজন সিনিয়র সাংবাদিক মোটর সাইকেল নিয়ে এসে তার মোটর সাইকেলে তুলে ফেঞ্চুগঞ্জ রোড হয়ে পাঠানপাড়া পৌছে নিরাপদ করে দেন।

সেদিন সানী সহ অসংখ্য মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হাত নিয়ে তেমুখী বাইপাস পর্যন্ত লড়াই করতে করতে টিপু ভাই সানীরা ফিরে আসেন।

জেলরোড, বন্দর পেপার পয়েন্ট তো ঐ দিনগুলো ছিল আমাদের কাছে ডাল ভাতের মতো।

কাদের মোল্লার ফাঁসির রাত!
গভীর রাত তখন দেড়টা। গোটা নগরী পিন পতন নিরবতা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা নগরী। আমি, সহকর্মী আহবাব ভাই ও সংগ্রাম কবীর ভাই হাতের কাজ শেষ করে চা খেতে বন্দর মাশরাফি রেষ্টুরেন্টে যাই। ঐ একটা রেষ্টুরেন্ট ছাড়া আর কোন দোকান কোন মানুষ শহরে ছিলনা। আওয়ামীলীগ নেতারা প্রাণ ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। কোতোয়ালি থানার গেইটে পাচ কেজি ওজনের তালা ঝুলানো। পুলিশ র‍্যাব বিজিব হর্ণ বাজিয়ে মহড়া দিচ্ছে। গোটা শহর যেনো একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান।

সেই কঠিন দু:সময়ে এই নগরীর বুক চিরে কাপা কাপা হাতে কাদের মোল্লা ভাইয়ের ফাসির নিউজ আর শহরের সকল নিউজ লিখে রাত চারটায় মেসে পৌছি। ফজরের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলে কাঁদি।

পরদিন আলীয়ার মাঠে জানাযায় সায়েফ ভাইয়ের কান্না! আর আমার নিউজ “মাদ্রাসা মাঠে হাজারো মানুষের বুক ফাটা কান্না”।

শহীদ রাহাত যেদিন গুলিবিদ্ধ হয় সেদিন বাংলা ভিশনের দীপু ভাই চৌহাট্টা থেকে আমাকে মোটর সাইকেলে তুলেন। হাওয়া পাড়া গলির মুখে যাওয়ার পর আর সামনে যেতে পারিনি। তখন গুলিবিদ্ধ রাহাতকে উইমেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অপরদিকে হাওয়া পাড়া, নয়াসড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়েকটি গ্রুপ পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে। ওসি আতাউর একেবারে বেফানা হয়ে চারদিকে গুলি আর গ‍্যাস ছাড়ছে। গ‍্যাসের ঝাঁঝ সহ‍্য করতে না পেরে আমি দৌড়ে মানরুতে ঢুকে পড়ি।

এরপর রাহাত ওসমানীতে যাওয়া, ঢাকায় যাওয়া, শাহাদাত বরণ করা, লাশ বাড়িতে আসা পযর্ন্ত একের পর এক নিউজ আমি আর কামরুল করতে থাকি।
শহীদ রাহাতের জানাযায় প্রচন্ড রোদ ছিল। আমি কালো সানগ্লাস পরা ছিলাম। মাওলানা লোকমান ভাইয়ের বক্তব্যের সময় আমার কান্না চলে আসে। আমার পাশে দাড়িয়ে নোট করছিল ডিজিএফআই এর খালেদ। তার বাড়ি ছিল ধর্মপাশা। আমি সানগ্লাস খুলে চোখের পানি মুছি। তখন সে বললো আপনি কাঁদেন কেন? আপনিও কি শিবির করতেন? আমি বললাম জি অবশ্যই আমি শিবির করেছি।

এমসি কলেজ হোস্টেল পড়ানোর ঘটনা কিংবা সায়েফ ভাই হারুন ভাইয়ের বাড়ি পুড়ানোর ঘটনা সহ অসংখ্য ঘটনা তো সবার চোখের সামনেই ছিলো।

এই যে কয়েকটি উল্লেখিত ঘটনার স্মৃতিচারণ করলাম ঐসময়টাতে অধিকাংশ মানুষ জামায়াতের আশেপাশে আসতোনা। অনেক সাংবাদিক ছাত্রজীবনে শিবির করতেন পরবর্তীতে সাংবাদিকতায় গিয়েছেন কিন্তু ঐসময় তারা প্রকাশ‍্যে টিভি ক‍্যামেরায় বা পত্রিকায় জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রকাশ‍্যে বলেছেন লিখেছেন আমাদের চোখের সামনেই। গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেন। জামায়াতের তান্ডব, জামায়াত বিদ‍্যুৎ অফিসে হামলা চালিয়েছে এমন কতো ঘটনা তখন শয়তান ও মুচকি হাসতো!

জুবায়ের ভাইয়ের ইলেকশনের সময় অনেক কাছের মানুষ কাছে আসতোনা। আমি সহ আমরা কয়েকজন সাংবাদিকতার সকল ইথিকসের বাইরে গিয়ে প্রকাশ‍্যে জুবায়ের ভাইয়ের পক্ষে স্ট‍্যন্ড নেই। অনেকেই তখন কামরান ভাই আরিফ ভাইয়ের পক্ষে গলাগলি ভাব করেন এমনকি খামও পান।

সেসময় অনেকেই আমার ভূমিকার জন্য সমালোচনাও করেন। এও বলতে শুনেছি আমি সাংবাদিকতা ও কৌশল বুঝিনা।

এখন গত ৫ আগষ্টের পর থেকে ঐ চরিত্রের মানুষ গুলো দেখি পুরোটাই বদলে গেছে। এখন জামায়াত নেতাদের সাথে তাদের উঠাবসা সেলফি, জামায়াতের সংবাদ সম্মেলনে ‘দাত মুরাইয়া মুরাইয়া’ প্রশ্ন করা দেখে আজ নিজেকে বড়ই অচেনা মনে হয়।

এখন এসে অনেকেই মনে করে আমরা ইসলাম বুঝিনা, আন্দোলন বুঝিনা, সংগঠন বুঝিনা, এখন এসে অনেকেই এগুলো নতুন করে বুঝাতে চান।

আমরা যে সাংবাদিকতা করে এসেছি এখন সেই সাংবাদিকতা নেই। আগের মতো বতর্মান সাংবাদিকতাকে এখন আর ধারণ করিনা। তবে সাংবাদিকতাকে যতোটা ধারন করতাম ঠিক ততটাই ধারন করতাম গণ মানুষের রাজনীতিকে। এখনো আমার চিন্তা চেতনায় কল্পনায় গণ মানুষের রাজনীতি।

আজ সুসময়ে এসে যদি আমাদের অতীত কেউ ভুলে যায় তাদের জন্য আমাদের কোন আফসোস নেই। তবে আবার কোনদিন মজলুম হয়ে গেলে অবশ্যই আমরা মজলুমের পক্ষে সত‍্যের পক্ষে সেই ঝান্ডা আবারও তুলে ধরবো।