বাংলাদেশ নয়তো মৃত্যু

- আপডেট সময় : ০৪:৫৪:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ৮১ বার পড়া হয়েছে
দিনলিপি,
৫ আগস্ট, ২০২৪।
সকালে ফজর নামাজ পড়েই গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরে চুপচাপ বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিই। ছোটভাই মীর ছিবগাতুল্লাহ্ তকিকে বুঝতে দেই না৷ কারণ ও টের পাইলেই বাসা থেকে বের হয়ে যেতে চাইবে৷ মাত্র ৫ দিন হইলো তার এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হইছে। পেটে এখনো সেলাইগুলা কাঁচা৷ কিন্তু রাত থেকেই গাইগুই করতেছে যে, ৫ তারিখ সে ঢাকার উদ্দেশ্যে মার্চে যাবে৷ আগেররাতে বোধহয় ১০০ বার চে গুয়েভারার Patria O Muerte এর ভিডিও দেখেছি৷ এই দেশকে আমি এতোটা ভালোবাসি, এর আগে আর কখনোই মনে হয় নাই৷ জুলাইয়ের শহীদদের কথা ভেবে ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ শুনে একা একা বসে বসে কাঁনছি। জুলাই মাসে আমাদের কী হয়ে গেছিলো আমরা জানি না! রক্তের ঘ্রাণে অথবা মুক্তির নেশায় আমরা পাগল হয়ে গেছিলাম বোধহয়!
বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ে আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিলাম৷ বললাম, Patria O Muerte. আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, কী কস? আমি বললাম, Motherland or Death!
আম্মা কইলেন, তুই গেলে তো ছিবগাতুল্লাহও যাইতে চাইবো! ওরে বুঝায়া রাইখা যা, যাতে না বের হয়৷ ওর পেটের সেলাইগুলা কাঁচা, এখনো হাঁটতে পারে না৷
আমি বললাম, বুঝাইতে গেলে আমার সাথেই যাইতে চাইবো। এই বলে, আম্মাকে সালাম দিয়ে বের হয়ে গেলাম৷
আব্দুল্লাহ আল আমিনের বাসায় এসে তার জন্য অপেক্ষা করলাম। সে বের হলো। আস্তে আস্তে আমাদের বাকি ছোটভাইরাও আসতে শুরু করলো- তামিম, তানিম, মামুন, সোহেল৷ আব্দুল্লাহ আল তাকদির যুক্ত হলেন সাদ্দাম মার্কেট স্ট্যান্ডে৷ স্ট্যান্ডে উঠে আমরা দেখি আমরা শুধু নয়জনই রাস্তায়৷ আর কোন লোক নাই৷ একটা বিজিবির টহল গাড়ি বাঁশি দিতে দিতে আমাদেরকে রাস্তা থেকে নিচে নেমে গলিতে ঢুকে যেতে বললো। কেন যেন একটুও ভয় লাগলো না। বিজিবির তাক করে থাকা রাইফেলগুলোরেই বরং অসহায় লাগতেছিলো বোধহয়! রিক্সা নিয়ে শনির আখড়া চলে আসলাম।
শনির আখড়া এসে দেখি আমরাই আর্লি বার্ড৷ রাস্তায় আমরা ছাড়া আর কেউই আসে নাই তখনো। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮ টা৷ কিছুটা অসহায়ই লাগলো। আমরা নিজেরা নিজেরা বলাবলি করছিলাম যে, সম্ভবত মানুষ নামবে না৷ আরো একবার আমরা হেরে গেলাম!
নয়টার আশেপাশেই বিএনপির একটা গ্রুপ এসে রাস্তায় উঠলো প্রথমে৷ জনা তিরিশেক৷ তাদের দেখে আস্তে আস্তে মানুষ জড়ো হওয়া শুরু করলো। আমরাও আইল্যান্ডের উপরে গিয়ে বসলাম৷ আমি মামুন আত তানিমকে বললাম, আশেপাশের বিল্ডিংগুলার দিকে নজর রাখো। স্নাইপার শট হবে৷ আমরা যেহেতু সবার আগে এসেছি, শিওর থাকো আমাদেরকেই স্নাইপাররা টার্গেট করবে৷ ওরা আমাদেরকে দেখতেছে৷ এইজন্য এক জায়গায় আমরা দাঁড়ায়া বা বসে থাকবো না৷ মুভমেন্টে থাকতে হবে৷
ক্ষণিকবাদেই আমাদের মনে হইলো, যে কোন মূল্যে আমাদের ঢাকা ঢোকা দরকার৷ পুলিশ কাউকেই যাত্রাবাড়ী পার হতে দিচ্ছে না৷ ফলে আমাদেরকে যেতে হবে ভিতরের রাস্তা দিয়ে৷ শলাপরামর্শ করে তিনজন তিনজন করে গ্রুপ হয়ে আমরা শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম।
আমি, আল আমিন আর তাকদির এক রিক্সায়৷ আমরা ধোলাইখাল থেকে ঢাকা মেডিকেল পর্যন্ত রিক্সা নিলাম৷ রিক্সায় বসেই বুদ্ধি করলাম, রাস্তায় পুলিশ ধরলে আমরা বলবো, তাকদিরের বোনের বাচ্চা হবে৷ ঢাকা মেডিকেলে আছে৷ আমি আর আল আমিন রক্ত দিতে যাচ্ছি৷ আমাদের রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ।
ওয়ারী থানার একটু সামনে পুলিশ আমাদেরকে আটকালো। আমাদের দেখেই এক এসআই বললো, ওই তোগোরো চিনছি, নাম৷ আমরা সুস্থিরভাবে নামলাম৷ ঐ পুলিশ সদস্য একা ছিলো। ফলে আমার কনফিডেন্স ছিলো, কোন ঝামেলা হইলে তিনজন মিলে আমরা ওরে বোটি কাবাব বানায়া ফেলবো। কিন্তু রিক্সা থেকে আমরা নামা মাত্রই পিছন থেকে ২ গাড়ি পুলিশ আমাদের সামনে চলে আসলো।
আমরা এসআইকে বুঝালাম, রক্ত দিতে যাচ্ছি৷ ঢাকা মেডিকেল। এসআই খুবই স্কেপ্টিক্যাল। সে আমাদের কথা মোটেই বিশ্বাস করে না৷ বললো, মেডিকেলে কে আছে, তারে কল দেন৷ এসআইয়ের নজর ছিলো তাকদিরের মোবাইলের দিকে৷ তাকদির কল দেওয়ামাত্রই সে তার থেকে মোবাইল নিয়ে কথা বলবে, এইটাই ছিলো তার এপ্রোচ।
ঠিক এই সময়ে একটা জেন-যি মেয়ে সাইকেল রাইড করতে করতে রাস্তা পার হচ্ছিলো। পুলিশ তাকে আটকালো।
মেয়েটা পুলিশের সাথে তর্ক জুড়ে দিলো। পুলিশকে সে বললো, কেন আমি যেতে পারবো না? পুলিশ বললো, কারফিউ৷ সে বললো, আশ্চর্য! কারফিউ তো কী হইছে? আমার কাজ আছে সামনে, আমি যাবো না! তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে মেয়েটা বললো, আপনারা তো রক্ষক হয়ে ভক্ষকের মতো আচরণ করতেছেন! এই যে উনারা মেডিকেলে যাবে, উনাদের পেশেন্টের ব্লাড লাগবে৷ তো, আপনারা আটকানোর কারণে উনাদের পেশেন্টের যদি কিছু হয়ে যায়, এর দায় কে নিবে?
মেয়েটার সাথে পুলিশের তর্কাতর্কির মাঝখানে তাকদির তার বউকে কল করে সিচুয়েশন বুঝায়া ফেলছে৷ পুলিশ এরপরে ফোন নিয়ে তাকদিরের বউয়েত সাথে ১০ মিনিট কথা বললো। এখন সে কনফিউজড! সে তাকদিরের বউকে যতই প্যাচায়, দেখে যে আমাদের কথার সাথে তার কথা মিলে যাচ্ছে৷ আবার পুলিশটা আমাদের বিশ্বাসও করছে না৷ এই সময় অন্য একটা এসআই এলে আল আমিন তার আইনজীবী পরিচয় দিয়ে কথা হলে এবং আমাদের কথার সাথে তাকদিরের বউরের কথা মিলে যাওয়ার কথা বলে এই যাত্রায় আমরা ছাড়া পাই৷ রিক্সা চলতে থাকে চানখার পুলের উদ্দেশ্যে৷
চানখারপুলের কাছাকাছি গিয়ে আমরা ক্যাম্পাসের খবর নেওয়ার জন্য সমন্বয়কদের সবাইকে কল দিতে থাকি৷ কিন্তু কাউকেই ফোনে পাই না৷ এরমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি আলী আহসান জুনায়েদ ভাইকে কল দেই৷ আলী ভাই বলে যে, সে-ও রাস্তায়৷ সাইনবোর্ড। ক্যাম্পাসে কেউ এখনো দাঁড়াইতে পারে নাই৷ আমরা একটা দোটানায় পড়ে যাই৷ এরমধ্যেই সমন্বয়ক লুৎফরকে ফোনে পাই। লুৎফর বলে, ভাই, এখন ক্যাম্পাসের দিকে আগাইয়েন না৷ ক্যাম্পাসে কেউই দাঁড়াইতে পারতেছে না৷ যাত্রাবাড়ী থেকে হাজার হাজার লোক একসাথে মার্চ করে আসতে হবে৷ এরইমধ্যে আমাদের গ্রুপের একটা অংশ আগে চলে আসছিলো চানখারপুলে৷ তারা কল করে আমাদেরকে বলে, এই মুহুর্তে রিক্সা ঘুরান। চানখারপুলে শত শত পুলিশ। ঐখানে যারেই পাচ্ছে ধরতেছে৷ আমরা সঙ্গেসঙ্গে রিক্সাকে ঘুরায়ে ফেলতে বলি৷ একটা গলির ভিতরে ঢুকে পড়ি৷ সেখানে দেখি, ঢাকা মহানগর জামায়াতের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কামাল ভাই একা একা বসে আছে৷ আমরা আবার রিক্সা নিয়ে শনির আখড়া ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই৷ পথে দেখি আমাদের দীর্ঘদিনের রাজপথের লড়াই সংগ্রামের সহযোদ্ধা জামায়াত নেতা আব্দুল গফুর ভাই, আমাদের বন্ধু খলিল ভাই, মুখলেস ভাইসহ আমাদের এলাকার জামায়াত-শিবিরের জনা তিরিশেক লোক এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছে৷ আমরা তাদের সাথে হাই-হ্যালো না করেই শনির আখড়ার দিকে ফেরত যাই৷
শনির আখড়া উঠেই মাত্রই স্নাইপার শট হয়েছে৷ তিনজন স্পষ্ট ডেড৷ আর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়৷ মানুষ মারা যাচ্ছে, অদৃশ্য শত্রু স্নাইপার শট করছে, কিন্তু একজনও রাস্তা থেকে চলে যাচ্ছে না! এমন দৃশ্য জীবনে আর কখনোই দেখি নাই আমি! আশেপাশের সবগুলো মসজিদ থেকে তখন মাইকিং করা হইতেছে, সবাইকে নেমে আসার জন্য এবং যার যার বিল্ডিংয়ের ছাদ চেক করার জন্য যেন কোন স্নাইপার শট না করতে পারে।
ঠিক যেই জায়গায় আমরা সকালে বসে ছিলাম, তার ৩ হাত সামনে স্নাইপার শট হইছে৷ মামুন, তামিমদেরকে বললাম, আমরা যদি ঢাকায় ঢোকার জন্য মুভ না করতাম, এখন আমাদের মধ্য থেকেই কেউ না কেউ শহীদ হইতো!
ঘন্টাখানেকের মধ্যে যাত্রাবাড়ি রাস্তায় লাখো মানুষের ঢল নেমে আসলো। আমরা এই ঢল নিয়ে টোল প্লাজার দিকে আগাইতে থাকলাম৷ দ্বিতীয় টোল প্লাজার কাছাকাছি যেতেই মুহুর্মুহু গুলি শুরু হলো। আমরা কুজো হয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম৷ মনে হচ্ছে যেন ঠিক কানের পাশ দিয়ে গুলি গেলো! গলি ঘুরে আমরা আবার রাজপথে উঠে গেলাম।
উঠেই দেখি আমার ছোট ভাই ছিবগাতুল্লাহ পেটে কাঁচা সেলাই নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে হাঁটতে হাঁটতে শনির আখড়া চলে আসছে৷ জুনায়েদ, জাওয়াদ, মারুফ, এলাকার আরো অনেক ভাই-বেরাদারদের দেখলাম। তারপর শুরু হলো মৃত্যুর মিছিল দেখা!
অনাবিল হাসপাতালে একের পর গুলিবিদ্ধ মানুষ আসছে৷ সবগুলা হেড শট। স্নাইপারের গুলিতে৷ আমাদের সামনেই অন্তত ১০ জন স্নাইপারের গুলিতে হেড শট ছিলো। সেই দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো না।
জোহরের নামাজে দাঁড়িয়ে আমরা হাউমাউ করে কানলাম। মসজিদ থেকে বের হওয়ার পরে দুইজন মুরুব্বি আমার মাথায় হাত বুলায়ে দিলেন৷ একজন আমাকে ধরে কেঁদে দিয়ে বললেন, বয়সের কারণে আমরা তোমাদের পাশে থাকতে পারতেছি না, বাবা! আমাদেরকে মাফ করে দিও! উনার কথা শুনে বুক ফাইটা কান্না আসলো।
তারপর রাস্তায় থেকেই হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনলাম। আল আমিন ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কানলাম! আম্মাকে কল করে কানতে কানতে বললাম, মা! মা! হাসিনা পালায়া গেছে, মা! আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করছে, মা!
এদিকে যাত্রাবাড়ি থানার সামনে তখনো ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, চলছে মৃত্যুর মিছিল৷ নির্বিচারে গুলি করেই চলছে পুলিশ। আমরা দেখছি, একের পর এক লাশ যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে৷
এই সমস্ত শহীদদের লাশকে পিছনে ফেলে আমরা আরো একবার মুক্ত ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ওয়ারী থেকে একটা ট্রাক ভাড়া করে শহীদ মিনারে গেলাম৷ সেখান থেকে গণভবন।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় শত শহীদ, হাজারো বীর ভাইদের পিছনে ফেলে খোলা ট্রাকে উঠে বললাম, Patria O Muerte!
বাংলাদেশ নয়তো মৃত্যু!