কোরিয়া জীবনের গল্প-৬
আমি তোমার ধর্মকে পছন্দ করে ফেলেছি

- আপডেট সময় : ০৫:৪৩:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫ ৩২ বার পড়া হয়েছে
কোরিয়ানরা কোন বিদেশীর লাইফস্টাইলের প্রতি কৌতুহলী হননা। কিন্তু, নাইট ক্লাবের ঘটনার পর থেকে আমি কোম্পানীর কলিগ ও মালিকের কাছে এলিয়েন বনে গেলাম। সবাই আমার দেশ, সংস্কৃতি ও ধর্ম বিষয়ে জানতে শুরু করলো। মালিক এক ধাপ এগিয়ে আমকে নজরদারি করতে লাগলেন। দিনে-রাতে, কাজের দিনে-ছুটির দিনে, তাঁর নজরদারি থেকে মুক্ত থাকলনা আমার ডিভিডির সেল্ফ, ড্রয়ার, আলমারী, রান্না ঘর, এমনকি মোবাইল পর্যন্ত। রাতের বেলায় কোম্পানীর মধ্যে আমিই থাকতাম। নিঃস্বংগতা এড়াতে আমি ডিভিডি দেখতাম। সপ্তাহের অধিকাংশ রাতে ঘুমিয়ে পরতাম চেয়ারে অথবা মেঝেতে (বিছানা ছাড়া)। একবার রাত ৩টায় মালিক দরজার সামনে এসে আমাকে ডাকাডাকি করতে লাগলো! লাইট জ্বালানো, টিভিতে কোরআন তেলাওয়াতের ক্যাসেট চলতেছে। বললেন- ‘কি করতেছো?’ আমি কিছুটা বিব্রত হলাম। বললেন- ‘লাইট জ্বালিয়ে রেখোনা, সিকোরিটি অফিস থেকে অভিযোগ আসে।‘ এটা বলে ওনি রুমের সামনে স্যান্ডেল দেখিয়ে বললেন- ‘এগুলো কার?’ বললাম- ‘আমার, দেশ থেকে ভাইয়া আনছে।‘ এরপর ওনি চলে গেলেন। আসলে ওনি তালাশ করতেছেন কোন মেয়ের কোন কিছু পাওয়া যায় কিনা। আরেকদিন ছুটিরদিন শনিবার রাত ১ টায় কাছের এক কোম্পানির বাংলাদেশী লোক(লিটন ভাই)কে দেখলো আমার রুমে। ভাল করে থাকায় দেখে কিছু না বলে চলে গেল। রাতে বাতি জ্বালিয়ে রাখার অভ্যাশ আমার গেলোনা। পরবর্তীতে মালিক এটা দেখেও ওনি আমাকে কিছুই বলেননি। কারন- সেসময় কোম্পানীতে এত বেশী প্রোডাকশান হতে লাগল যে বাইরেও অনেক মাল রাখতে হল। আমার লাইট এগুলোর সিকোরিটির দায়ীত্ব পালন করতে লাগলো।
সাধারনত রোববার ছুটির দিনে আমি রুমে থাকতামনা। ছুটে বেড়াতাম এক গলি থেকে অন্য গলি, কোরিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। যেদিন থাকতাম সেদিন পুরো ভবনের অধিকাংশ পরিস্কার করতাম। মালিক আমাকে এর তাগাদা দিতেন। একদিন রোববারে দেখি মালিক এবং একজন আধ-বয়সী মহিলা অফিসরুমে ঢুকছেন (আমার রুমের পাশে)। মেয়েটি মালিকের বউ নয়। দুজনেরই পোষাক সংক্ষিপ্ত। আমি বিব্রত হলাম, ওনাদের কাউকে বিব্রত মনে হলনা। এই মেয়েকে মালিকের সাথে দেখে তাঁর বউয়ের জন্যে খারাপ লাগল। আমাকে ফ্লোর পরিস্কাররত অবস্থায় দেখে মালিক খুশি হয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাশা করে অফিসে ঢুকে গেলেন। মালিকের বউ কোম্পানীর অফিস সহকারী। প্রায়ই আমি তাদের মধ্যে ঝগড়ার আওয়াজ শুনতাম। মাঝেমাঝে ঝগড়ার মাত্রা এত তীব্র থাকে যে, ভয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা হত।
আরেকদিন রোববার। সকাল থেকে শেষদুপুর পর্যন্ত রুমের কাজ ও রান্না-বান্না করে পার করলাম। দ্বীর্ঘ-গোসলের পর রুমের ভিতরে নামাজ পড়তে ইচ্ছা হলনা। ভবনের ছাদে চলে গেলাম। খোলা আকাশ, ঠান্ডা বাতাস, ক্লান্তির অবসাদ, তবে রোধের সুস্বাদ। নামাজে কাটাতে লাগলাম দ্বীর্ঘসময়। তেলাওয়াত, রুকু, সিজদা করতে-করতে আমি ভেদ করতে লাগলাম সকল জাগতিক বাঁধা। মনে হচ্ছিল যত দ্বীর্ঘ হচ্ছে ততই আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছি, মুণীবের নিকটবর্তী। আকুতি ছিল চোখে, মুখে ও মনে।সন্তুষ্টিও ছিল। কোরিয়াতে যখনই আমার পদঃস্খলন হয়েছে বলে মনে হতো, তখন এভাবেই দাঁড়ানোর চেস্টা করতাম। খোলা পরিবেশে স্রস্টাকে ডাকা নিদারুন পছন্দ আমার। হাজারো সৃস্টির মধ্যে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। আশপাশের সকল সৃস্টির সাথে যোগ দিয়ে প্রভূর কাছে নত হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। দ্বীর্ঘ-সিজদারত অবস্থায় আমি কারো পায়ের আওয়াজ পেলাম! বেশ কয়েকবার আমার আশপাশে ঘুরতেছিল। ছাদের উপর এই সময়ে কে আসতে পারে ভাবতেছিলাম। নামাজ শেষ করে আস্তে-আস্তে নিচে নেমে দেখি মালিক অফিসরুমে! পরদিন থেকে আমি তাঁর আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম! আমার উপর ওনার মনোভাব পালটে গেল! মেয়ে ও মদ ছাড়া একজন যুবক চলে কেমনে- এতদিনের এই কৌতুহলটার জবাব পেলেন হয়তো। আগেরমত নজরদারি ছেড়ে দিলেন। কাজে তদারকি করতে আসতেননা। সম্বোধন করতে লাগলেন সম্মানের সাথে। মিটিং এর সময় কাজ নিয়ে আমার আইডিয়া পেশ করতে বলতেন। ইমার্জেন্সি প্রয়োজনে টাকা এডভান্স দিতেন। জুমা পড়তে দেরী হলে কিছু বলতেননা। ডিউটির মাঝে, আমার কাজে কোথাও যাওয়ার অনুমতি চাইলে ‘না’ করতেন না। সাধারণত কোরিয়াতে এসব ফ্যাসিলিটিস পাওয়া দূর্লভ।
কোম্পানীর কাজে দূরে কোথাও মাল ডেলিভারী দিতে আমাকে সাথে নিতেন। একবার মালিকের গাড়ী করে কোম্পানীর কাজে গিয়েছিলাম অনেক দূরে। ফেরার পথে গাড়ীর জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতেছিলাম। অনেকক্ষন ধরে আমাকে আকাশের দিকে তাকাতে দেখে ওনি আমাকে জিজ্ঞাশা করলেন- ‘উপরের দিকে কী দেখো?’ আমি বললাম- ‘গাড়ীতে করে কোথাও গেলে আমি বাইরের দৃশ্য দেখি।’ ওনি বললেন- ‘তোমার স্রস্টাকে খোঁজতেছো নাকি?’ বললাম- ‘স্রস্টাকে দেখার মত চোখ মানুষের নেই। তবে অনুভব করা যায়।’ বললেন- ‘তাকে কখনো দেখোনি!’ বললাম- ‘আমি প্রোডাকশন দেখে মালিককে অনুভব করতেছি।‘ বললেন- ‘বুঝলাম না’। বললাম- ‘একটু আগে আমরা যে মালগুলো সেটিং করে আসলাম সেগুলোর স্টিকার বা কাজ দেখে অন্যরা বুঝতে পারে যে এগুলো আপনার প্রোডাক্টস। আপনার প্রোডাক্টস দেখে মানুষেরা আপনার কথা স্বরণ করে, কৃতজ্ঞ হয় এবং বারবার অর্ডার দিতে চায়। তেমনিভাবে আমাদের চারপাশে যা আছে সবকিছুই হল প্রোডাক্টস- গাছ, পাহাড়, নদী, সমূদ্র, আকাশ, বাতাস, আমরা মানুষ, ইত্যাদি। বুদ্ধিমানরা এগুলো দেখে বুঝতে পারেন এসবের মালিক আছে। আপনি ছাড়া আপনার প্রোডাক্টস আপনা-আপনি তৈরী হয়নি, আপনি এগুলো অনর্থক তৈরি করেননি। তেমনিভাবে একজন মালিক ছাড়া চারপাশের প্রোডাক্টগুলোও আপনা-আপনি তৈরী হয়নি, সেই মালিকও এগুলো অনর্থক তৈরী করেননি।‘
এরপর প্রশ্ন করলেন- ‘তুমি প্রার্থনা করো কেন, বলতো?’ বললাম- ‘আপনারা কর্মীদেরকে অন্তত ৩ বার খাওয়া-দাওয়ার তাগাদা দেন। যাতে শরীর শক্তি পায়, কোন অসুখে না পরে, পরিশ্রম করতে পারে। আল্লাহও আমাদেরকে প্রতিদিন অন্তত ৫ বার প্রার্থনা করতে তাগাদা দেন। যাতে মন শক্তি পায়, কোন অসুখে না পরে, শফথ নিতে পারে। খাওয়া-দাওয়া হল দেহের খোরাক, প্রার্থনা হল মনের খোরাক। প্রার্থনা একটা ট্রেইনিং, যেখানে, আল্লাহর কথা কোরআন থেকে পড়তে হয়, যেমন- মনোযোগ দিয়ে কাজ কর, মানুষের উপকার কর, পিতা-মাতাকে সেবা কর, কাজে ফাঁকি দিওনা, অন্যের ক্ষতি করনা, মিথ্যা কথা বলনা, এই রকম। এরপর, তাঁর প্রশংসা করি, অবনত হই, এবং মানার শফথ নিই।‘
ওনি বললেন- ‘ভাল তো! তো, প্রার্থনা করে তুমি কী পেয়েছো?’ বললাম- ‘আমি পেয়েছি কোনটা ভাল এবং কোনটা মন্দ- এর নির্দেশনা, নিয়ম-শৃংখলা পেয়েছি, মানসিক প্রশান্তি পেয়েছি। আমি আশা রাখি এই দুনিয়ায় সব কাজের বেতন না পাইলেও মৃত্যুর পর আরেকটা জীবনে সব পাব। যদি না পাই, এতে তো আমার ক্ষতি নেই! হয়তো দুনিয়ায় কিছু আরাম-আয়েশ থেকে বঞ্চিত হলাম, এইতো! কিন্তু, আজকের এই বিশ্বাসসমূহ আমাকে সুশৃংখল ও সুন্দর হতে সাহায্য করতেছে। যদি সত্যিই পরকালে এসবের বেতন পাই, তবে আমিই তো হিরো, তাইনা?’ বললেন- ‘দুনিয়াতে ভালভাবে খেয়ে-পরে বসবাস করবানা?’ বললাম- ‘হ্যাঁ, নিয়ম মেনে ভালভাবে বসবাস করার কথা বলতেছি। মন যখন-তখন যা চায় তা করার নাম জীবন নয়, প্রতিটি কাজে নিয়ম পালন করার নাম জীবন। নিজের বানানো নিয়ম ফলো করলে ভুল হয়, অন্য মানুষের বানানো নিয়মেও অপূর্ণতা থাকে। আল্লাহর দেওয়া নিয়ম ফলো করলে সবার জন্যে ভাল হয়।‘
কথাগুলো শুনে ওনি কিছুক্ষন চুপ ছিলেন। মনে হল কথাগুলো ওনার ভেতরে অটো-ডাউনলোড হয়েছে।
এই সময়ে আমি বলে গেলাম- ‘আমি আপনার কোম্পানীতে কাজ করতেছি। আমি যদি বিশ্বাস করি যে, আপনি আমাকে সবসময় সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখেন, তখন আপনার মন মত ভালভাবে কাজ করে যাব, রাইট? একইভাবে, আমি যদি বিশ্বাস করি যে দুনিয়া ও আকাশের সব প্রোডাক্টসের সাজাং(মালিক) আমাকে দেখতেছেন সবসময়, এই বিশ্বাস আমাকে তাঁর পছন্দের কাজগুলো করতে শক্তি দেবে। সুতরাং এতে ক্ষতিটা কী?’
‘এবার ধরুন, আপনার প্রতি আমার ভালবাসা ও বিশ্বাস আছে এবং ভবিষ্যতের পেরেশানী আছে; তখন আপনি দেখেন বা না দেখেন, আমি খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে থাকবো। আপনার দেওয়া নিয়ম ফলো করবো। আপনার প্রেরিত ম্যানেজার, সুপারভাইজারদের কথা শুনবো, রাইট? সুতরাং, এই ভালবাসা ও বিশ্বাস থাকলে আরো ভাল হবে। কারন, এটা আমাকে কাজচোর না হয়ে পরিশ্রমী হতে সাহায্য করবে। বেতন নিয়ে পেরেশান না হয়ে স্থায়ী ও বিশ্বাসী কর্মী হতে সাহায্য করবে, তাইনা? একইভাবে, এই বিশ্ব-কোম্পানীর সুপার সাজাং এর প্রতি ভালবাসা ও বিশ্বাস থাকলে, ভবিষ্যত জীবন নিয়ে পেরেশানী থাকলে, তিঁনি আমাকে দেখতেছেন নাকি দেখতেছেন না- তা নিয়ে ভাববোনা। তাঁর পছন্দের কাজগুলো মনোযোগ দিয়ে করে যাব। তাঁর প্রেরিত ম্যানেজার-সুপারভাইজারদের কথা শুনে যাব, রাইট? সুতরাং এতে ক্ষতিটা কী?’
‘আর ভালবাসা ও বিশ্বাস না থাকলে আপনাকে দেখলে কাজ করতে ইচ্ছা হবে, না দেখলে কাজ করতে ইচ্ছা হবেনা। আপনার দেওয়া কোম্পানীর নিয়ম আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হবে। নিজের নিয়মেই চলতে ইচ্ছা হবে। আপনার প্রেরিত ম্যানেজার, সুপারভাইজারদের কথা শুনতে ইচ্ছা হবেনা। বেতন পাওয়ার ব্যাপারে অস্থিরতা থাকবে, বোনাস নিয়ে অজুহাত থাকবে, কাজ নিয়ে আপত্তি থাকবে, রাইট? সুতরাং, ভালবাসা ও বিশ্বাস না থাকলে তো আমারই ক্ষতি! তাইনা?’
‘এখানে প্রতিদিন কাজ করে প্রতিদিন বেতন পাইনা। একটা বিশ্বাস নিয়ে কাজ করি যে একদিন এই কস্টের বিনিময় পাব। সেটা হচ্ছে বেতনের দিন। কাজের পর বেতন পাবার ব্যাপারে যেমন আপনার উপর আস্থা রয়েছে, তেমনিভাবে, দুনিয়ার যাবতীয় কাজের পর বেতন পাবার ব্যাপারেও সুপার সাজাং এর উপর আস্থা রয়েছে। তাৎক্ষণিক কিছু পাওয়ার প্রার্থনা, আসল প্রার্থনা নয়; ভালবাসা ও বিশ্বাসের প্রার্থনাই আসল প্রার্থনা।’
ওনি এতক্ষণ ধরে শুনতেছিলেন। এবার বললেন- ‘আচ্ছা! তুমি তো আমাকে বলেছিলে যে তুমি ছোটকাল থেকে প্রার্থনা করে আসছো। কখনো কি তোমার হানা নিম (এক আল্লাহ) জবাব দিয়েছেন?’ বললাম- ‘যতজন আপনার প্রোডাক্টস এর জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; সবাইকে কি আপনি জবাব দিয়েছেন? বড়-বড় কোম্পানীর মালিক(হেজাংনিম)দের সাথে কর্মচারীদের দেখাও হয়না কোন দিন। তারপরেও তারা কি আনুগত্য করেনা?’ বললেন- ‘কিন্তু মালিকের পক্ষ থেকে মানুষ তো থাকে! ম্যানেজার, ক্যাপ্টেন, অন্যান্য কর্মকর্তা…। বললাম- ‘জি, আমি যাঁর প্রার্থনা করি তাকে দেখা যায়না, কিন্তু তাঁর পাঠানো ম্যানেজার, শিক্ষক, ক্যাপ্টেনকে ফলো করি। তিঁনি হলেন মুহাম্মাদ (সাঃ)। যেভাবে আপনি কোম্পানীর জন্যে নিয়ম দিয়েছেন, কর্মীরা তা ফলো করে। আল্লাহও আমাদের জীবনের জন্যে নিয়ম দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে কোরআন, আমরা তা ফলো করি।’
এবার মালিক সবচেয়ে মূল্যবান প্রশ্নটি করলেন- ‘তোমরা স্বাবলম্বী হতে পারতেছনা কেন? তোমরা তো সবাই প্রার্থনা কর, তাহলে তোমাদের দেশ গরীব কেন?’ বললাম- ‘দেখুন, আমরা যারা কাজ করি, আপনার থেকে অনেক টাকা পাই, অভিজ্ঞতা অর্জন করি, সবাই কি এগুলোর সঠিক ব্যবহার করে সফল হয়েছি? সারা কোরিয়াতে যেসব দেশী-বিদেশী কর্মী আছে, সবাই কি এমন ইনকাম পেয়েও কাজে লাগাতে পেরেছে? না, পারেনাই। তো, এই দোষ কি মালিকদের? কোম্পানীর নিয়মের? হতে পারে আমাদের ইনকাম মিস ইউজ হয়েছে অথবা কোন কারনে আমরা কাজে লাগাতে পারিনাই।’
‘আমাদের দেশ গরীব। কারন- আমাদের দেশের মানুষ ভাল নেতা পায়নি প্রেসিডেন্ট কিম এর মত। তারা দেশকে মন দিয়ে ভালবাসে কিন্তু কাজ দিয়ে ভালবাসেনা। অন্যদের দিয়ে পরিশ্রম করায় কিন্তু নিজেরা করেনা। কোরিয়া ধনী দেশ। কারন- কোরিয়ানরা ভাল ভাল নেতা পেয়েছে। ওরা দেশকে কাজ দিয়ে ভালবাসে। এরা প্রত্যেকে প্রচুর পরিশ্রম করে। মানুষের সেবা, দেশপ্রেম, পরিশ্রম- এগুলো সব আল্লাহর শিক্ষা। কোরিয়ানরা ধর্মের কথাই মানতেছে।’ বললেন- ‘তোমাদের দেশের মানুষ বিশ্বাসী হয়েও ধর্মের কথা মানতেছেনা!’ বললাম- ‘জি।’ এসব কথাবার্তার মধ্যে আমাদের রাস্তা ফুরিয়ে এলো।
প্রতি বছর গরম কালে কোম্পানীর পক্ষ থেকে সমুদ্র বিহারের আয়োজন করা হয়। সেখানে সবাই ট্রলারে করে গভীর সমূদ্রে গিয়ে মাছ ধরে। এরপর ট্রলারেই কাঁচা খায়, রান্না করেও খায়। সেখানে সাগর থেকে আকাশ- সব নীল। মাঝখানে ছোট-ছোট হলদে দ্বীপ। এর আশপাশ ঘেঁষে ভেসে-ভেসে উদয়াস্থ পার করা! আহা, মুহূর্তগুলো ছিল কোরিয়া জীবনের অন্যতম সেরা! সে বছর শুনলাম ভ্রমণের দিনটা শুক্রবার নির্ধারণ করা হয়েছে। শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল! কলিগদেরকে এবং মালিকের ভাই (ম্যানেজার)কে বুঝালাম, যেন মালিক দিনটা পরিবর্তন করে। মালিকের বউ এসে বলল- ‘চলো, আমাদের ছেলে-মেয়েরাও যাবে। অনেক প্রতিযোগীতা ও উপহার আছে। আমরা তোমাকে মিস করতে চাইনা।’ মালিক শুনে আমার উপর তেড়ে আসলো। বলল- ‘তোমার কারণে আমার সব কাজের সিডিউল পরিবর্তন করবো নাকি! একদিনের জন্যে তোমার সাপ্তাহিক প্রার্থনায় না গেলে কী হয়।’ মালিকের সিরিয়াস মোড দেখে মনকে বিরত করলাম জুমার পড়ার আকর্ষণ থেকে।
ঘড়িতে যখন ১টা, তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল। নৌকার উপর দাড়িয়ে ভাবতেছি- এই বুঝি সবাই দাঁড়িয়ে গেল নামাজে, আর আমি এখানে! ও আল্লাহ ক্ষমা করো। এরমধ্যে মালিকের বউ ঘোষনা দিল- ‘যার বড়শি থেকে সবচেয়ে আগে মাছ আসবে তার জন্যে ১ লক্ষ উন পুরুস্কার।’ সবাই উচ্ছাসিত এবং সক্রিয়। সবাই লক্ষ্য করলেন আমি চিন্তিত ও নিস্ক্রিয়। কিন্তু, দেখলাম আমার বড়শিতেই সবার আগে মাছ ধরা পড়লো! সবাই চেঁচামেচি করতে লাগলো। কেউ-কেউ বলল- ‘ভাল হয়েছে। এবার হোছাইনের মন ভাল হয়ে যাবে।’ এদিকে আমি ভাবলাম- নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করতেছেন আমার মধ্যে অনুশোচনাবোধ কতক্ষণ থাকে। কয়েকঘন্টা পর মালিকের বউ আবার ঘোষণা দিল- ‘এবার যার বড়শি থেকে সবচেয়ে বড় মাছটি আসবে তার জন্যেও ১ লক্ষ উন পুরস্কার।’ সবাই একের পর এক মাছ ধরতেছে এবং চেক করতেছে। শেষদিকে দেখা গেল- একটা বড় মাছ আমারি বড়শিতে! অন্যরা জিজ্ঞাশা করতে লাগলো- ‘তুমি প্রার্থনা করে-করে বড়শি ফেল নাকি? কী পড়বো আমাদের শিখায়ে দাও প্লীজ!’ সবশেষে চেক করে দেখা গেল আমারটাই সবচেয়ে বড়! এবার সবাই আমাকে ঘিরে ধরলো। হইহুল্লা শুরু করলো। সবার সামনে পুরস্কার নেওয়ার সময় মালিকের বউ আমাকে জিজ্ঞাশা করলো- ‘তুমি তোমার হানা নিম এর কাছে এটা চেয়েছিলে?’ আমি বললাম- ‘না, আমি শুধু হানা নিম এর কাছ থেকে ক্ষমা চাচ্ছিলাম।‘ ওনি বললেন- ‘সে জন্যে তিঁনি তোমাকে এই উপহার দিলেন।‘ সব শেষে বিদায় নেওয়ার সময় মালিক আমাকে একাকী ডেকে নিয়ে বললেন- ‘তুমি অনেক উপহার পেয়েছো। তুমি কি এসব একা খাবে? দেখো, আজকের সবকিছু হল সহকর্মীদের সাথে একটা আনন্দদায়ক সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে। তাই, যা পেয়েছো তা শুধু নিজে না খেয়ে একটা পার্টি (হোয়েসিক) করবা। কোম্পানীর সবাইকে খাওয়াই দিবা।‘ আমি উত্তর দিলাম- ‘আপনি না বললেও আমি তাই করতাম। আমি প্রতিমাসে এর চেয়ে বেশী টাকা অন্যদের জন্যে খরচ করি। এটা আমার আনন্দ।’ বললেন- ‘জানি তোমার মন ভাল।‘
একবার এক হোয়েসিক পার্টিতে মালিক বললেন- ‘আমাদের কোম্পানী কোরিয়াতে অনেক পরিচিত হয়েছে, আপনাদেরকে অভিনন্দন।‘ এরপর সবাই সবাইকে খাবার তুলে দিচ্ছিল। মালিকের বউ আমাকে মদ সাদলো। আমি না করাতে তিনি বললেন- ‘একটু পান করলে তো সমস্যা নাই! বেশী পান করে টাল হয়ে গেলে সমস্যা, তাইনা?’ আমি বিনয়ের সাথে বললাম- ‘বিষ একটু হলেও সমস্যা, এটা ক্ষতি করবেই (হা হা হা)। আচ্ছা, কাজের সময় কি মদ পানের অনুমতি দেবেন? একটু হলেও? ড্রাইভিং করার সময়? পরীক্ষার হলে? এভাবে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ও সময়ে মদ পানের অনুমতি কোথাও কেউ দেয়না, একটু হলেও না। কোন ডাক্তারও বলবেনা মদ একটু করে পান করলে সমস্যা নেই। বলবে- বেশী পান করার চেয়ে একটু করা ভাল, তবে একেবারে না করলে উত্তম। আমি উত্তমটাই বেঁচে নিলাম! কারণ, আমার কাছে প্রত্যেকটা কাজ ও সময় গুরুত্বপূর্ণ।’
বললেন- ‘তোমার কথা ঠিক আছে। তবে, রিল্যাক্সেরও দরকার আছে। মদ রিল্যাক্স সময়ের জন্যে।’ বললাম- ‘রিল্যাক্সের সময় এভাবে খেয়ে-দেয়ে অনুস্টহান করে আনন্দ করতে পারি, কিন্তু মদ পান করতে পারিনা। কারণ, কাজ শেষ করে পরিবারকে সময় দিতে হয়, এরপর প্রার্থনা করতে হয়, মানুষের কাজ করতে হয়। মদ খেলে আমি এত কাজ করবো কেমনে! আর মদ ও প্রার্থনা একে অপরের সাংঘর্ষিক। মদ্যপায়ী কখনো প্রার্থনাকারী হতে পারেনা, প্রার্থনাকারী কখনো মদ্যপায়ী হতে পারেনা। এসব কারণে- আল্লাহ মানা করেন, আব্বা-আম্মাও মানা করেন, ডাক্তার-শিক্ষক, সবাই মানা করেন। মদ না নেওয়া আমার সংস্কৃতি, আর মদ পান করা আপনার সংস্কৃতি। আজ আপনার সংস্কৃতিকে সম্মান করে একটু পান করা শুরু করলে, কাল আরো একটু, পরশু আরো একটু, এভাবে পুরো এক বোতলে আসক্ত হয়ে যাব। তখন কারো মানা শুনতে মন চাইবেনা। কারণ এটা নেশা। এরপর শুধু ফূর্তি করতে ইচ্ছা হবে। আপনারা তো জানেন যে আমি কোন মেয়ের কাছে যাইনি। মদ খাইলে না গিয়ে থাকতে পারবোনা, হা হা হা।’ বললেন- ‘যাবে, এতে সমস্যা কি?’
‘তুমি কি বিয়েই করবানা!’ বললাম- ‘করবো। ভালভাবে যাচাই-বাচাই করে মেয়ে ঠিক করবো, এরপর বিয়ে করবো। এরপর তাকে নিয়েই সন্তুস্ট থাকবো। এটা ভাল না! আর যদি আমি এখন থেকে মদ খেয়ে মেয়েদের সাথে মেলামেশা করি তবে তাদের সাথে শুধু আনন্দ-ফূর্তিতে থাকবো। তখন উপযুক্ত মেয়ে বাচাই করা সম্ভব হবেনা। কারণ- ফ্রীতে সব কিছু পাওয়া গেলে পারিবারিক দায়ীত্ব-কর্তব্য ভাল লাগবেনা, চোখ লম্বা হয়ে যাবে। যার উদাহরণ দেখেন- কোরিয়ার দূর্বল পরিবার-ব্যবস্থা। এখানে বিয়ের আগে যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে নারী-পুরুষ লিভটুগেদার করে। পরে বিয়ের পরও অনেকে এই অভ্যাশ ছাড়তে পারেনা। দ্বীর্ঘদিন ধরে লিভটুগেদার করে যাচাই-বাছাই করলে তো বিয়ের পর কোন সমস্যা হওয়ার কথা না! কিন্তু কোরিয়ার অধিকাংশ পরিবারগুলোতে শান্তি আছে কী? সুন্দর স্ত্রী ও পরিপূর্ণ পরিবার থাকা সত্তেও মানুষেরা অন্যদের সাথে সম্পর্কে জড়ায়।‘ এ কথাগুলো শোনার পর মালিক বলে উঠলো- ‘কঠিন! কঠিন! এতসব চিন্তা-ভাবণা করে জীবন চলবেনা!’ তখন মালিকের বউ- চিৎকার করে বলে উঠলো- ‘কিসের কঠিন! তোমার মত লোকের জন্যে কঠিন। তোমরা খারাপ চিন্তা-ভাবণার লোক!’ ইত্যাদি। গোল করে বসা সব সহকর্মীরা হতভম্ব হয়ে গেলো। মালিকের ভাই (মেনেজার) সব বুঝতে পারলেন আগ-পিছ। আমার পেয়ালায় মাছ তুলে দিলেন। সবার জন্যে আরো খাবার অর্ডার করলেন। বিষয়টা ক্লোজ করলেন।
প্রতি ৩মাস পর-পর বন্ধের সময় মালিক আমাদের বোনাস ও উপহার দেওয়ার নিয়ম। বেতনের অর্ধেক! এই সময়ে কাজ কম থাকলে তিনি অন্য কোম্পানী থেকে কাজ ধার করে নিয়ে আসেন। তাও না পেলে কোম্পানীটা আগাগোড়া পরিস্কার করতে বলেন। নিজেও কাজ করেন। কাজের ভুল ধরে হুদাই চিল্লানি দেন। বোনাস দিতে হবে বলে কলিজা ফেটে যায় মনে হয়। তখন আমি খুব মনমরা হই। কাজের কারণে না জানি পিটানি খাইতে হয়!
একবার, সবাই ফ্রেশ হয়ে অফিসে এসে বিদায় নেন। সবশেষে মালিক কোম্পানী ত্যাগ করার আগে আমার রুমে ঢুকে বলেন- ‘শুধু তোমাকেই বোনাস দিয়েছি, একাউন্ট চেক করো।‘ আমি খুব সুন্দর করে একটা ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় দেই। এরপর আমি লুটিয়ে পরি ফ্লোরে। বলি- ‘ও আল্লাহ! ধন্যবাদ তোমায়। আমার অসহায় মুহূর্তে বহুবার সে আমার উপকারে এসেছে। তুমি তাকে রহম কর মাবুদ।‘ এভাবে কাজ কম হোক বা বেশী হোক, প্রত্যেকবার তিনি আমাকে বোনাস দিতেন।
একবার এমন এক মুহূর্তে মাথায় আসলো আমিও একটা উপহার দিবো। ইতোপূর্বে কোরিয়ান ভাষায় অনেক ছোট বই দিয়েছি। এবার এর ধারাবাহিকতায় কোরআন দিতে চাইলাম যাতে ওনার মনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ইথেউন মাসজিদের নিকটস্থ এক লাইব্রেরী থেকে কোরিয়ান ভাষায় অনুবাদ সহ একটা কোরআন কিনলাম। ভাবলাম- ‘কিভাবে দিবো? গুরুত্ব দিবে তো!’ মাথায় আসলো-কোরিয়ান ভাষায় একটা সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষনীয় মেসেজ বইয়ের উপর লিখে দেব এবং মুখেও বলব। অনেক ভাবনার পর মেসেজটা ঠিক করলাম এবং বড় ভাইয়ের মাধ্যমে কোরিয়ান ভাষায় তা লিখে আনলাম। ‘’বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, এই কোরআন অন্তত একবার ভালভাবে পড়ে দেখুন- যেটা, বলা হচ্ছে সৃস্টি কর্তার পক্ষ থেকে সর্বশেষ বাণী’’। সেভাবে প্যাকেটটা তাঁকে দিলাম। বললাম- ‘আপনার থেকে আমি অনেক উপহার পেয়েছি। এটা আমার পক্ষ থেকে এই উপহার। অন্তত আমার একটা সৃতি আপনার কাছে থাকুক!’ ওনি অট্টহাসি দিলেন। ধন্যবাদ দিয়ে গ্রহন করলেন। এরপর থেকে আমি যতবার অফিসরুমে যেতাম ততবার খোঁজতাম বইটাকে। বইটার সাথে কেমন আচরণ করে দেখার কৌতুহল ছিল। কিছুদিন পর দেখলাম সেটা অফিসরুমের একটা বড় বুক-সেলফে শোভা পাচ্ছে।
কিছুদিন পর, এক সফর থেকে ফেরার পথে আমি জিজ্ঞাশা করেছিলাম- ‘আপনি কি কোরআনটা পড়ে দেখেছেন?’ বললেন- ‘পুরা পড়িনি, কিছু পড়েছি। সময় পাচ্ছিনা!’ বললাম- ‘কী বুঝলেন?’ বললেন- ‘মাথা ভাল লোকেরাই এই বইটা লিখেছে।‘ বললাম- ‘এই বইটা কোন মানুষের লিখা নয়। এগুলো আল্লাহর কথা, মুহাম্মাদ (সাঃ) এর কছে বলা হয়েছিল। পরে কথাগুলো লিখে একজায়গায় করা হয়েছে।’ বললেন- ‘না না, এটা হতে পারেনা। সকল অনুসারীরা এসব বইগুলোকে আল্লাহর কথা হিসেবেই মানে। আমি বিভিন্ন ধর্মের গুরুদের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি- এগুলো সব মাথা ভাল (জ্ঞানী) লোকেরাই লিখেছে।’ বললাম- ‘মুহাম্মদ (সাঃ) লিখতে ও পড়তে পারতেননা। আর, এখানে টিভির মত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মত নতুন-নতুন কথা আছে (বিজ্ঞানের কথা বলেছিলাম এভাবে)। মানুষের জন্যে ক্ষতিকর কোন কিছু এখানে নেই, কোন ভুল নেই। মানুষের যেটা প্রয়োজন সেটা অস্বীকার করেনি। এমনসব কথা বলা হয়েছে যেগুলো মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।‘ এরপর ওনি অন্যান্য ধর্মের বইগুলোর ব্যাপারে অনেক কথা বললেন।
বললাম- ‘অন্যান্য ধর্মের বইগুলোর সাথে কোরআনের অনেক মিল আছে। আল্লাহ বিভিন্ন সময়ে তাঁর কথা পছন্দনীয় মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন। সে কথাগুলো আগের। সেগুলো মানুষেরা কাট-সাট করে পরিবর্তন করে দিয়েছে। কোরআনের কথাগুলো আপডেটেড। এবং এতে কোন পরিবর্তন হয়নি। আপনি এককাজ করেন- সব ধর্মের মেইন বইগুলো একবার পড়ে নেন। এরপর বুঝবেন কোনটা আল্লাহ কথা, কোনটা মানুষের কথা। একসময় আমিও এসবের সত্যতা নিয়ে অনুসন্ধান করতাম। কোরআন যত পড়েছি, ততই একে পছন্দ করেছি, অবশেষে আমি স্থির হয়েছি।‘ বললেন- ‘আল্লাহ আর পাঠাচ্ছেনা কেন?’ বললাম- ‘এটা আল্লাহর ইচ্ছা। তিঁনিই বলেছেন কোরআন সর্বশেষ। দেখেন, কোরআন যদি আল্লাহর না হয়ে মানুষের বানানো হত, তবে মানুষ নতুন করে আরো বানাতো, তাইনা? নতুন করে কেউ বানাতে পারছেনা কেন?’
দেখতে-দেখতে কোরিয়া জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়টি চলে আসলো। শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম, তার উপর পেটে কিছু না দেওয়া! আহা! কী নিদারুন কস্ট! ক্লান্তি আমাকে এতটাই ঘায়েল করতো যে, সেহেরী না খেয়ে রোজা রাখতে হত অধিকাংশ দিন! এমনও অনেক দিন গেছে, ইফতার করার পর আর কোন কিছুই খাওয়া হয়নি, পরদিন থেকে আবার রোজা ছিলাম। মানে, সামান্য আহারে ইফতার আর সেহেরী একাকার। এর মধ্যে প্রতিদিন তারাবী পড়তে যেতাম। মসজিদে আমাকে না পেলে আমার জন্যে অপেক্ষা করতো অনেকক্ষণ। তারপরেও না আসলে রুমে ডাকতে পাঠাতো। তখন দেখতো আমি পাঞ্জাবী টুপি পরে ঘুমিয়ে পরছি ফ্লোরে বা চেয়ারে। ভেবে শিহরিত হই- কোরিয়া জীবনের একটা রোজাও ভাঙ্গা লাগেনাই। সে কী এক স্পিরিট! এর আগেও কোরিয়াতে হাজারো মুসলিম এভাবেই রোজা রেখে সমানে কাজ করে আসছিল- শুনে অনুপ্রাণিত হই।
আমি কোরিয়াতে অনেক কিছুই খেয়েছি, করেছি, আজ এসবের কোন মূল্যই নেই আমার কাছে। অনেক টাকা আয় করেছি, আজ এসবের খুব সামান্যই অবশিস্ট আছে। কিন্তু, কোরিয়া থেকে যে বুঝ (অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান) পেয়েছি, তার পুরোটা আজও আমাকে প্রানবন্ত করে রেখেছে। সেই সাধনায় স্বাদ ছিলনা, কিন্তু আজ এর ফলের স্বাদ মধুময়। প্রার্থনা করে, বলে, শুনে যেই ‘বুঝ’টা অর্জন করা যায়না, সেটা অর্জন করতে হয় রমজান নামক সাধনার মাধ্যমে। রমজান এর মর্মার্থ এটাই।
প্রথম প্রথম রমজানের সময় মালিক আমাকে নিয়ে কোথাও গেলে তাঁর বক্সের মধ্যে ঠান্ডা পানির বোতল নিতেন। কাজের ফাঁকে আমাকে পান করতে বলতেন। আমি ‘না’ করলে অবাক হয়ে বলতেন- ‘পানিও পান না করলে শক্তি পাবি কোত্থেকে?’ বলতাম- ‘মন থেকে। আপনি আমাদের সবসময় বলেন- কাজ করতে শক্তির চেয়ে বুদ্ধির দরকার হয় বেশী, বুদ্ধির চেয়ে ইচ্ছাশক্তির দরকার হয় বেশী। আজকে একটু ক্ষুধা ও শারীরিক কস্ট সহ্য করতে অভ্যস্ত হলে আগামীতে আরো বেশী কস্ট-যন্ত্রণা সহ্য করার ইচ্ছাশক্তি তৈরি হবে। আল্লাহ এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে আমরা এই ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে পারি। কস্টের মধ্যে যারা বড় হয় তারা সফল হয়। কস্টের স্বাদটা সবাই একটু হলেও অনুভব করুক।‘
একবার ফিরার পথে বললেন- ‘রোজা রেখে কী হবে?’ বললাম- ‘রোজা রাখলে গরীবদের কথা মনে হবে। তাদের দুক্ষ-কস্ট বুঝলে তাদেরকে সাহায্য করতে মন চাইবে।‘ বললেন- ‘তাহলে তো রোজা শুধু ধনী ও উচ্চ-শ্রেণীদের রাখা উচিত। গরীবরা রোজা রেখে কী বুঝবে?’ বললাম-‘গরীব-ধনী সবাই রোজা রেখে আল্লাহকে বুঝবে।‘ বললেন- ‘কিভাবে?’ বললাম- ‘মা’কে যেভাবে বুঝেছে। মায়ের অবদানকে বুঝতে পেরেছি বলে মাকে সবচেয়ে বেশী সম্মান করি, মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ হই। মা ছাড়া কত তুচ্ছ ছিলাম, শক্তিহীন ছিলাম, অসহায় ছিলাম- আমরা তা বুঝতে পারি বলে মায়ের পায়ে নত হই। তাইনা? একইভাবে- একবেলা না খেয়ে থাকলে আমরা কত অসহায়, শক্তিহীন ও দূর্বল হয়ে পরি!’
‘একবার ভাবুন তো- মায়ের পেটে আমাদের জীবন কে দিয়েছেন? আমরা নাকি মা? নাকি আল্লাহ? আমরা যে খাবার ও পানি খেয়ে কাজ করি, ফূর্তি করি- সেগুলো কে দিয়েছেন? মানুষ কী খাদ্য বানাতে পারে? মানুষ শুধু জমীনে কাজ করে আল্লাহর দেওয়া জিনিশগুলো একত্রিত করে চাষ করে। কিন্তু খাদ্যগুলো সৃস্টি করতে পারেনা। এগুলো দিয়েছেন আল্লাহ। আল্লাহ জীবন দিয়েছেন, খাদ্য দিয়েছেন, বেঁচে থাকার জন্যে সুস্থ শরীর দিয়েছেন (শরীরের ফাংশান মানুষের হাতে নেই, মানুষ শুধু খাইতে পারে) এবং সুন্দর প্রকৃতি দিয়েছেন। আমাদের উপর আল্লাহর অবদান বেশী নাকি মায়ের অবদান বেশী? উপবাস থাকলে বুঝতে পারি যে আমরা আল্লাহর করুণার কাছে কতটাই নির্ভরশীল! সুতরাং রোজা রাখলে সকল মানুষ নিজের ছোটত্ব ও অসহায়ত্ব বুঝতে পারে, আল্লাহর বড়ত্ব ও অবদানকে বুঝতে পারে। তখন মায়ের চেয়েও বেশী করে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে মন চায়, তাঁর কাছে নত হতে মন চায়।‘
বললেন- ‘হানানিম দয়া করে আমাদের পানি ও খাবার দিলেন, এখন আবার না খাইতে বলতেছেন কেন?’ বললাম- ‘মা তার সন্তানদেরকে আদর যত্ন করে বড় করার পর, আবার না খেয়ে- না ঘুমিয়ে পড়ালেখা করতে পাঠান কেন? কোরিয়া তার সৈন্যদেরকে তৈরি করার পর, আবার না খাওয়ায়ে- কস্ট দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয় কেন? আমরাও তো নিজেদেরকে এভাবে কস্ট দিয়ে থাকি। আপনি এই কোম্পানী গড়ে তুলতে কত দিন- কত রাত না খেয়ে ছিলেন, না ঘুমায়ে থেকেছেন- আমাদের বলেছিলেন। আমরা প্রত্যেকে না খেয়ে, না ঘুমায়ে, কস্ট করে সার্টিফিকেট অর্জন করেছি, পদবী অর্জন করেছি, ক্যারিয়ার করেছি, ব্যবসা করেছি, প্রোগ্রাম করেছি, অনুষ্ঠান করেছি। সুতরাং, আমাদের ভালর জন্য রমজানে একবেলা না খেয়ে থাকতে পারবোনা কেন? এই কয়দিন কস্ট পাওয়ার মাধ্যমে আমরা কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করার ট্রেনিং পাবো (কুপ্রবৃত্তি অনিচ্ছায় পদস্খলনের দিকে নিয়ে যায়), দুঃখ-কস্ট হজম করার প্রশিক্ষণ পাবো (তীব্র সুখাংকা মানুষকে অসুখী বানায়ে ছাড়ে), নিজেকে ছোট ও আল্লাহকে বড় মনে করবো (অহংকার নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়), পরের উপকার করা ও তাদের বিরক্তি সহ্য করার মানসিকতা অর্জন করবো। এ সকল প্রশিক্ষন পৃথিবীর কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লাভ করা যায় না।‘
বললেন- ‘সবি ভাল। কাজ করে রোজা রাখতে তোমার কস্ট হয় না?’ বললাম- ‘তেমন না। ছোটবেলা থেকে অভ্যস্ত। আসলে রোজার সময় খাবারের সিডিউলটা পরিবর্তন হয় শুধু, আর কিছু নয়। সাধারণত, আমরা সকালে সামান্য রুটি আর দুধ খেয়ে কাজে ঢুকি। বেশীরভাগ সকালে না খেয়েই কাজে ঢুকি। সেই রাত থেকে না খেয়ে দুপুরে খাওয়া আর ভোরে খেয়ে সন্ধ্যায় খাওয়া- আমার কাছে বেশী পার্থক্যের না। পার্থ্যক্য শুধু খাবারের সিডিউলের। অন্যরা এটাকে কঠিন মনে করে। আসলে এটা অভ্যাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপরেও যে কস্ট হয় এর মধ্যে ভাল কিছু আইডিয়া আমার মাথায় আসে।‘ বললেন- ‘কি রকম?’ বললাম-‘এই মনে করেন, দুপুরে যখন সবাই খেতে যায়, তখন ভাবি, পৃথিবীর তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ এভাবেই অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। আহারে! আমরা কখনো তাদের কথা ভাবিনা! ৪ টার দিকে যখন ক্ষুধায় কাতর হয়ে যায়, তখন সবাই কপি বা জুস পান করে। তখন আমার কাছে মনে হয়, ঐ জুস বা কপিই যেন দুনিয়ার সবচেয়ে মজার খাবার। আহারে! অন্যদের ঐচ্ছিক খাবার ক্ষুধার্ত মানুষের প্রানের খাবার! তখন বুঝতে পারি, আমরা ঐচ্ছিক খাবার ও আয়েশের জন্যে যে টাকা খরচ করি তা এক সাথে করলে পৃথিবীর সকল অর্ধাহারী মানুষদের খাবার দিতে পারবো। বিকেল যত গড়ায় ততই আমি দূর্বল হয়ে যায়। অনেক সময় কাজ বেশী করলে কথা বলতে শক্তি পাইনা, পিপাসায় জিহ্ববা নড়েনা। তখন নালার পানি বা ভিজা ডাস্টবিনের দিকে চোখ পরলে সেগুলোও খাইতে ইচ্ছা হয়! তখন ভাবি- আহারে! আমার মৃত্যুর সময়ও এভাবে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাব, পিপাসায় জিহ্ববা নড়বেনা। তখন আল্লাহর কাছে বলি- ও আল্লাহ! আমাকে মৃত্যুর সময় পানি দিও। আব্বা-আম্মাকে পানি দিও। মৃত্যুর পর আমাদেরকে শাস্তি দিওনা।‘
ওনি ড্রাইভিং করতে করতে আমার কথাগুলো শুনতেছিলেন। এর মধ্যে কোম্পানীতে পৌঁছে গেলাম। তখনো কাজ শেষ হতে প্রায় ৩ ঘন্টা বাকি। বললেন- ‘তোমার আর কাজে ঢুকার দরকার নেই। রুমে গিয়ে রেস্ট করো। রাতে বেশী করে খেয়ো। হানা নিমের কাছে আমার জন্যে প্রার্থনা কইরো।‘ আমি ধন্যবাদ দিয়ে রুমে উঠে গেলাম। ভাবলাম- মালিকের মনে আমার ধর্মের প্রতি কোমলতা তৈরি হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে ওনার উপর আমার করণীয় নিয়ে ভাবতে লাগলাম। পরে, সেই এলাকার অনেক বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করলাম। কোরিয়ানদের নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করার সিদ্ধান্ত নিলাম, সেটা ইফতার মাহফিল। যেখানে, সকলের মালিকদের দাওয়াত দেওয়া হবে, কোরিয়াস্থ বাংলাদেশের রাস্ট্রদূত মহোদয় এবং সকল স্টাফগণও উপস্থিত থাকবেন। কোরিয়ান ভাষায় একটা দাওয়াত পত্র ছাপালাম। আমরা সকলে যার যার মালিক ও কলিগদের দাওয়াত দিতে লাগলাম।
আমি একটা দাওয়াত পত্র নিয়ে মালিকের সাথে দেখা করলাম। বললাম- ‘এই এলাকা বিশ্বের ২য় বৃহত্তম ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা। এখানে হাজারো বিদেশী কাজ করে। এদের অধিকাংশ মুসলিম, ১০-১২টা দেশের। আমরা সবাই একজায়গায় হচ্ছি। আমরা নিজেরা এবং আমাদের পরিবারের সবাই আপনাদের কাছে ঋণী। এই সমাগমে অনেক কোরিয়ান মানুষ, কোরিয়ান প্রশাসনের অফিসারগণ এবং বিভিন্ন দেশের রাস্ট্রদূতগণ আসবেন। ওনারা সরাসরি আপনাদেরকে দেখলে কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন, আপনারাও বিদেশীদের নিয়ে কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। আমাদের কোম্পানীর সকলকে আমি দাওয়াত দিয়েছি। জানি আপনি ব্যস্ত; যদি একটা ঘন্টা সময় দিতেন আমার এত কস্ট সার্থক হবে।
আপনি এটা মনে করবেননা যে- এটা মুসলিমদের অনুষ্ঠান। মনে করবেন এটা কোরিয়ান ও বিদেশী বন্ধুদের মিলনমেলা। তখন ওনি বললেন- মুসলিমদের অনুষ্ঠান হলেও সমস্যা নাই। আমার পূর্ব-বংশ আগুন পূঁজারী। আমার মা-বাবাও। বিভিন্ন ধর্মের পুরোহিতদের জীবন-যাপন আমার মোটেও ভাল লাগতোনা। এরা কোন কাজের না। প্রার্থনা কেন্দ্রগুলো এক একটা ব্যবসার কেন্দ্র। সেজন্যে আমার কোন ধর্মের প্রতি আকর্ষণ ছিলনা। সত্যি বলতে- যতগুলো ধর্ম আমি বুঝেছি, তার মধ্যে ইসলাম ধর্মের কথাগুলো আমার ভাল লেগেছে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে ইসলাম নিয়ে কথা হয় বেশী। আমি তোমার ধর্মকে পছন্দ করে ফেলেছি। ঠিক আছে, আমি যাব। তবে তোমাদের তৈলাক্ত খাবার আমি খাবনা।‘ আমি বললাম- ‘অনেক ধন্যবাদ। অনুষ্ঠানের দিন আপনার কথার প্রমান দেখতে চাই।‘
অবশেষে, বিভিন্ন দেশের মানুষ নিয়ে বিশাল সমাবেশ হলো। সেখানে বেশ কিছু অমুসলিম ও এসেছিলেন। অনেক কোম্পানীর মালিক, কর্মকর্তা মিলে প্রায় অর্ধ-শত কোরিয়ান এসেছিলেন। আমার কোম্পানীর মালিকসহ সকল স্টাফ গিয়েছিলেন। সকল কোরিয়ানগণ রাস্ট্রদূতদের হাত থেকে উপহার নিয়েছেন, কেউ-কেউ বক্তব্য রেখেছেন, আমার মালিক ছাড়া প্রায় সবাই খাবার খেয়েছেন। প্রোগ্রামটি করার পর মুহূর্তগুলো ছিল আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আমি যে দিকে তাকাতাম সেদিকেই খুশি দেখতাম। আকাশের খন্ড খন্ড মেঘ, বাতাসের ধাক্কা, গাছের নড়া-চড়া, মেশিনের আওয়াজ, বন্ধুদের সাক্ষাত; সব যেন আমাকে দেখে হাসতেছিল।
যেদিন কোরিয়া থেকে চলে আসবো বলে মালিককে বিদায় দিচ্ছিলাম, ওনি চলে যাবার মুহূর্তে আমি ওনার দিকে তাকায়ে ছিলাম। ওনিও আবার পিছনে ফিরে তাকায়েছিলেন। দু’জনেই কিছুটা ইমোশনাল হয়েগেছিলাম। এই মুহূর্তে আমার জিহ্ববা বলতেছিল- ‘’বিদায় হে বন্ধু, আর আমাদের মধ্যে কনভারসেশন হবেনা। ভাল থেকো।‘’ একটা আফসোস আসলো মনে- ‘’ইশশ! ঐ সময়ে যদি তিনি বলতেন- আমি তোমার ধর্মকে ‘গ্রহন’ করে ফেলেছি। তবে আজকের বিদায় কতই না আনন্দের হতো!‘’ এর জন্যে নিজের অযোগ্যতাকে দায়ী করলাম। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে মালিক হয়তো সেটাই বলতো। দেশে চলে আসার পর মালিক আমাকে বেশ কয়েকবার কল করেছিলেন। বার-বার বলতেন- ‘তোমার মত কর্মী আমার জীবনে পাইনি, আমরা সবাই তোমাকে মিস করি। তুমি আবার কখন আসবে? সেদিন স্বপ্নে দেখলাম- মালিক তার কোম্পানী অনেক বড় করে ফেলতেছেন, ভেতরে ক্রেন দিয়ে কাজ চলতেছে।
https://www.facebook.com/share/1Bmhoxb7yu/
প্রোফাইল লিংক।
অনেক বছর কোরিয়ায় ছিলাম, এরকম বহু স্মৃতি আমার মাঝেও জড়িয়ে আছে। নাদো কুরে, ছিনছা।