ঢাকা ১২:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

ফিরে যাই শৈশবে : শিরিন আক্তার

শিরিন আক্তার
  • আপডেট সময় : ০৫:৫০:৫৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫
  • / 204
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আমরা তখন আব্বার চাকুরীর সুবাদে রাজশাহী থাকতাম। ছোট ছোট পাঁচ ভাই বোন। সব ছোট ভাই হিমেলের তখনও জন্ম হয়নি। আমি তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। ছোট ভাই রুবেলকে নিয়ে খেলায় ছিলাম। আমাদের দোতলা বাসার মূল দরজায় মানে একতলার দরজায় আসামাত্র আমাদের সমবয়সী কেউ একজন বলে, তোমার বোনকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে। আমি এতই ছোট ছিলাম যে, কেন আমার বোনকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে তা জানতেও চাইনি। খালি পায়ে দৌড়ে হাসপাতাল গেলাম।

রাজশাহী মিশন হাসপাতাল। কী খুশি আমি। আমার বোন হাসপাতালে। আমি যেন বিশেষ কেউ। কারণ, আমার বোন হাসপাতালে। তখন ঐ হাসপাতালে সাদা চামড়ার বিদেশী লোকজন দেখা যেতো। ওদের দেখতে যে কী ভালো লাগতো। কতদিন আমরা গেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম। সাদা পোষাক পরিহিতা নার্সদের বারান্দায় চলাফেরা দেখতাম।

 

হাসপাতালের বাগানে অনেক ফুলগাছ ছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখতাম। খুব ইচ্ছে হতো ভেতরে যেতে। কিন্তু এক বিদেশী ছেলে তাড়িয়ে দিতো। বলতো, গো গো। আমরা হাসতে হাসতে দৌড়ে পালাতাম। সেই হাসপাতালে আমার বোন!

যথারীতি গেটে যেতেই দারোয়ান পথ আটকায়। আমি ভেতরে চুপসে গেলেও বলি, আমার বোন হাসপাতালে। তারপর কীভাবে জানি ভেতরে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি আমার বোন বেডে ঘুমিয়ে আছে। আম্মার চোখে পানি। আব্বার মন খারাপ। তাতে কী! হাসপাতালে তো ঢুকতে পারলাম। আমি বুভুক্ষের মতো এটা দেখি, ওটা দেখি, মানুষ দেখি, দৌড়ে বাগানে যাই। কী অদ্ভূত সেই অধিকারবোধ। আমার বোন দোতলা বাসার ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল। সেই উপলক্ষে তখন প্রতিদিন কয়েকবার মিশন হাসপাতালে যেতাম। হাসপাতাল আমাদের বাসার কাছেই ছিল।


বেশ কিছুদিন পর আমার বোন হাসপাতাল থেকে বাসায় এলো। আমার যে কী মন খারাপ হয়েছিল সেদিন। কারণ হাসপাতালে আর ঢুকতে দেবে না। আবার বলবে, গো গো। ঢুকতেই দেবে না।

কয়েক যুগ পরে আমি অফিসের কাজে রংপুর যাই। সেখান থেকে রাজশাহী যাই। বোর্ডে আমার এসএসসি সার্টিফিকেট সংক্রান্ত কাজ ছিল। খুঁজে বের করি আমাদের সেই দোতলা বাসাটি। পুরো বাসাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। আব্বার কথা মনে পড়ে। আম্মার অল্পবয়সী সেই মুখটা মনে পড়ে। আমার বোন আর ভাইদের কথা মনে পড়ে। কী দুরন্ত ছিলাম আমরা। আর আমাদের গৃহকর্মী ইসরাইল ভাই? সে ছিল আমাদের লীডার। সারাক্ষণ আমাদের সে এটা ওটা শিখিয়ে দিতো। আম্মার সাথে একজন মেয়ের সখ্যতা ছিল। তিনি প্রায়ই বাসায় আসতেন। তাঁর নাম ছিল ময়না। আম্মা আর তিনি এক সাথে বসে সেলাই করতেন। ইসরাইল ভাই আমাদের শিখিয়ে দিতেন, এই বল ময়না আল্লাহ আল্লাহ কর। আমরাও সমানে বলে যেতাম। তিনি নিশ্চয়ই অস্বস্তি বোধ করতেন! সেই সময়ের কথা মনে পড়ে। পুরো বাসার বিভিন্ন জায়গার ছবি তুলি, ভিডিও করি।

একবার শুনলাম হেলিকপ্টার আসবে। আর যায় কই। ভাইবোন সবাই ইসরাইল ভাইয়ের নেতৃত্বে নদী পাড়ে হেলিপুটে গেলাম। এত বাতাস। আমার মেজো ভাই আমাদের দু বোনকে মাঠে শুইয়ে দিলেন। তারপর আমাদের দু বোনের উপর তিনি বসে রইলেন। আমাদের নাকি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমরাও ভয়ে মাটির সাথে ল্যাপ্টে শুয়ে থাকলাম। আহা ! সেই না বোঝার দিনগুলো!

 

ঠিক যেখান থেকে আমার বোন পড়ে গিয়েছিল সেই জায়গাটি দেখে বুকের ভেতর হু হু করে উঠে। না জানি আমার বোন কত কষ্ট পেয়েছিল সেদিন। ঐ জায়গারও ছবি তুলে আনি।

 

সেই মিশন হাসপাতালেও যাই। হাসি পায় আমার। কী অবলীলায় আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। কেউ বাঁধা দিলো না।
গেলাম রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে। ওখানে আমার বোন ছোটদের অনুষ্ঠান করতে যেতো। আমিও দু তিনবার পিছু নিয়েছিলাম। আমি ওখানকার বাগান দেখতাম। মানুষ দেখতাম। মানুষ দেখতে যে আমার এত ভালো লাগতো।

 

বেতার কেন্দ্রপ্রধানের রুমে গেলাম। বললাম কত ছোট বয়সে আমি এই বেতার কেন্দ্রে এসেছিলাম । শুনে উনিও বিস্মিত হলেন, মজাও পেলেন। ভদ্রলোক যখন শুনলেন ঐ বয়সে বসবাস করা বাসাটি আমি স্মৃতি হাঁতড়ে খুঁজে বের করেছি, তিনি কিছুসময় হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁকে অনুরোধ করলাম ছোটদের সাপ্তাহিক প্রোগ্রাম কোন রুমে হয় একটু দেখান না প্লীজ। তিনি নিজে আমাকে সেই রুমে নিয়ে গেলেন। আমি চারিদিকে চেয়ে বলি, না, এই রুম না। ঐ রুমটি আরও বড় ছিল। তিনি লোক পাঠিয়ে গেটের দারোয়ানকে আনালেন। দারোয়ান বৃদ্ধ মানুষ। বললেন, এক সময় আরেক রুমে এই অনুষ্ঠান হতো। এখন সেখানে লাইভ প্রোগ্রাম হয়। তালাবদ্ধ রুমটি খুলে দেয়া হলো। আমি বললাম, ঠিক আছে এই সেই রুম। আমি ফিরে যাই আমার শৈশবে, আমাদের শৈশবে। কেমন কান্না পায় আমার।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

ফিরে যাই শৈশবে : শিরিন আক্তার

আপডেট সময় : ০৫:৫০:৫৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫

আমরা তখন আব্বার চাকুরীর সুবাদে রাজশাহী থাকতাম। ছোট ছোট পাঁচ ভাই বোন। সব ছোট ভাই হিমেলের তখনও জন্ম হয়নি। আমি তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। ছোট ভাই রুবেলকে নিয়ে খেলায় ছিলাম। আমাদের দোতলা বাসার মূল দরজায় মানে একতলার দরজায় আসামাত্র আমাদের সমবয়সী কেউ একজন বলে, তোমার বোনকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে। আমি এতই ছোট ছিলাম যে, কেন আমার বোনকে হাসপাতাল নিয়ে গেছে তা জানতেও চাইনি। খালি পায়ে দৌড়ে হাসপাতাল গেলাম।

রাজশাহী মিশন হাসপাতাল। কী খুশি আমি। আমার বোন হাসপাতালে। আমি যেন বিশেষ কেউ। কারণ, আমার বোন হাসপাতালে। তখন ঐ হাসপাতালে সাদা চামড়ার বিদেশী লোকজন দেখা যেতো। ওদের দেখতে যে কী ভালো লাগতো। কতদিন আমরা গেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম। সাদা পোষাক পরিহিতা নার্সদের বারান্দায় চলাফেরা দেখতাম।

 

হাসপাতালের বাগানে অনেক ফুলগাছ ছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখতাম। খুব ইচ্ছে হতো ভেতরে যেতে। কিন্তু এক বিদেশী ছেলে তাড়িয়ে দিতো। বলতো, গো গো। আমরা হাসতে হাসতে দৌড়ে পালাতাম। সেই হাসপাতালে আমার বোন!

যথারীতি গেটে যেতেই দারোয়ান পথ আটকায়। আমি ভেতরে চুপসে গেলেও বলি, আমার বোন হাসপাতালে। তারপর কীভাবে জানি ভেতরে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি আমার বোন বেডে ঘুমিয়ে আছে। আম্মার চোখে পানি। আব্বার মন খারাপ। তাতে কী! হাসপাতালে তো ঢুকতে পারলাম। আমি বুভুক্ষের মতো এটা দেখি, ওটা দেখি, মানুষ দেখি, দৌড়ে বাগানে যাই। কী অদ্ভূত সেই অধিকারবোধ। আমার বোন দোতলা বাসার ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল। সেই উপলক্ষে তখন প্রতিদিন কয়েকবার মিশন হাসপাতালে যেতাম। হাসপাতাল আমাদের বাসার কাছেই ছিল।


বেশ কিছুদিন পর আমার বোন হাসপাতাল থেকে বাসায় এলো। আমার যে কী মন খারাপ হয়েছিল সেদিন। কারণ হাসপাতালে আর ঢুকতে দেবে না। আবার বলবে, গো গো। ঢুকতেই দেবে না।

কয়েক যুগ পরে আমি অফিসের কাজে রংপুর যাই। সেখান থেকে রাজশাহী যাই। বোর্ডে আমার এসএসসি সার্টিফিকেট সংক্রান্ত কাজ ছিল। খুঁজে বের করি আমাদের সেই দোতলা বাসাটি। পুরো বাসাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। আব্বার কথা মনে পড়ে। আম্মার অল্পবয়সী সেই মুখটা মনে পড়ে। আমার বোন আর ভাইদের কথা মনে পড়ে। কী দুরন্ত ছিলাম আমরা। আর আমাদের গৃহকর্মী ইসরাইল ভাই? সে ছিল আমাদের লীডার। সারাক্ষণ আমাদের সে এটা ওটা শিখিয়ে দিতো। আম্মার সাথে একজন মেয়ের সখ্যতা ছিল। তিনি প্রায়ই বাসায় আসতেন। তাঁর নাম ছিল ময়না। আম্মা আর তিনি এক সাথে বসে সেলাই করতেন। ইসরাইল ভাই আমাদের শিখিয়ে দিতেন, এই বল ময়না আল্লাহ আল্লাহ কর। আমরাও সমানে বলে যেতাম। তিনি নিশ্চয়ই অস্বস্তি বোধ করতেন! সেই সময়ের কথা মনে পড়ে। পুরো বাসার বিভিন্ন জায়গার ছবি তুলি, ভিডিও করি।

একবার শুনলাম হেলিকপ্টার আসবে। আর যায় কই। ভাইবোন সবাই ইসরাইল ভাইয়ের নেতৃত্বে নদী পাড়ে হেলিপুটে গেলাম। এত বাতাস। আমার মেজো ভাই আমাদের দু বোনকে মাঠে শুইয়ে দিলেন। তারপর আমাদের দু বোনের উপর তিনি বসে রইলেন। আমাদের নাকি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমরাও ভয়ে মাটির সাথে ল্যাপ্টে শুয়ে থাকলাম। আহা ! সেই না বোঝার দিনগুলো!

 

ঠিক যেখান থেকে আমার বোন পড়ে গিয়েছিল সেই জায়গাটি দেখে বুকের ভেতর হু হু করে উঠে। না জানি আমার বোন কত কষ্ট পেয়েছিল সেদিন। ঐ জায়গারও ছবি তুলে আনি।

 

সেই মিশন হাসপাতালেও যাই। হাসি পায় আমার। কী অবলীলায় আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। কেউ বাঁধা দিলো না।
গেলাম রাজশাহী বেতার কেন্দ্রে। ওখানে আমার বোন ছোটদের অনুষ্ঠান করতে যেতো। আমিও দু তিনবার পিছু নিয়েছিলাম। আমি ওখানকার বাগান দেখতাম। মানুষ দেখতাম। মানুষ দেখতে যে আমার এত ভালো লাগতো।

 

বেতার কেন্দ্রপ্রধানের রুমে গেলাম। বললাম কত ছোট বয়সে আমি এই বেতার কেন্দ্রে এসেছিলাম । শুনে উনিও বিস্মিত হলেন, মজাও পেলেন। ভদ্রলোক যখন শুনলেন ঐ বয়সে বসবাস করা বাসাটি আমি স্মৃতি হাঁতড়ে খুঁজে বের করেছি, তিনি কিছুসময় হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁকে অনুরোধ করলাম ছোটদের সাপ্তাহিক প্রোগ্রাম কোন রুমে হয় একটু দেখান না প্লীজ। তিনি নিজে আমাকে সেই রুমে নিয়ে গেলেন। আমি চারিদিকে চেয়ে বলি, না, এই রুম না। ঐ রুমটি আরও বড় ছিল। তিনি লোক পাঠিয়ে গেটের দারোয়ানকে আনালেন। দারোয়ান বৃদ্ধ মানুষ। বললেন, এক সময় আরেক রুমে এই অনুষ্ঠান হতো। এখন সেখানে লাইভ প্রোগ্রাম হয়। তালাবদ্ধ রুমটি খুলে দেয়া হলো। আমি বললাম, ঠিক আছে এই সেই রুম। আমি ফিরে যাই আমার শৈশবে, আমাদের শৈশবে। কেমন কান্না পায় আমার।