সুনামগঞ্জ ০৮:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
তাহিরপুরের কামারকান্দি গ্রামে কালবৈশাখী ঝড়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে বহু গ্রাম বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ মিথ্যা বিবৃতি প্রত্যাহারের দাবিতে সচেতন সুনামগঞ্জবাসীর মানববন্ধন মিথ্যা ও বানোয়াট বিবৃতি প্রত্যাহারের দাবিতে সচেতন সুনামগঞ্জবাসীর মানববন্ধন জামালগঞ্জে ৪০ কেজি গাঁজাসহ নারী মাদক কারবারি গ্রেফতার ১৫ কেজি গাঁজাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার মেধাসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা আ’লীগ নিষিদ্ধ প্রশ্নে শহীদ পরিবারগুলো যা বললো পেহেলগামে হামলা: নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জামায়াত-শিবির নিধনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট আমলে হত্যার শিকার বিএনপির ৪৭৭১ নেতাকর্মী

জামায়াত-শিবির নিধনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ

রকীবুল হক
  • আপডেট সময় : ০৯:২৭:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৭ বার পড়া হয়েছে
সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

পতিত আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশি রোষানলের শিকার হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। একটানা সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে জামায়াত-শিবির নিধনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শেখ হাসিনা সরকার।

বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ পাঁচ নেতার ফাঁসি কার্যকরসহ সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনের জীবন বিপন্ন করে তৎকালীন সরকার।
মিথ্যা অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে এখনো কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন কেন্দ্রীয় এক নেতা। এ ছাড়া কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা অপরাধে মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ড, ক্রসফায়ারে হত্যা, গুম-অপহরণ, হামলা, গুলিসহ নানাভাবে অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন চালায় ফ্যাসিবাদী সরকার।
দলীয় কার্যক্রমে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ও অন্যসব কার্যালয়। বাতিল করা হয় দলটির নিবন্ধন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বিপন্ন হয় অনেকের শিক্ষাজীবন। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও অপপ্রচারে র‌্যাব-পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় শক্তি, মিডিয়া এবং আওয়ামী নেতাকর্মীদের ব্যবহার করা হয়।
আওয়ামী নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি মহিলা জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার নেতাকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরাও। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের চারদিন আগে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটায় আওয়ামী সরকার। অবশ্য হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় জামায়াত-শিবির। মাত্র ২৬ দিনের মাথায় নিষিদ্ধের আদেশটিও বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে দলটির ৩৫৮ জন শহীদ হন। ক্রসফায়ারে নিহত হন ৮৬ জন। মহিলা জামায়াতের ছয়জন এবং ছাত্রী সংস্থার একজন বিভিন্ন সময় শহীদ হন। ১৪ হাজার ৮২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন এক লাখ ১০ হাজার ৯০১ জন নেতাকর্মী। এরমধ্যে জামায়াতের পুরুষ ৯১ হাজার ৬৭৫ জন, নারী এক হাজার ৮৭ জন, ছাত্র ১৭ হাজার ৪৬৩ জন এবং ৬৭৬ জন ছাত্রী গ্রেপ্তার হন। বিভিন্নভাবে আহত হন ৭৫ হাজার ৫৮৫ নেতাকর্মী। পঙ্গু হন পাঁচ হাজার ২০৪ জন। পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতিত হন ৯৬ হাজার ৯৩ জন আর গুম-অপহরণের শিকার হন ২৫ জন, যাদের মধ্যে এখনো অন্তত সাতজন নিখোঁজ।
আওয়ামী শাসনামলে দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাঁচ হাজার বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ওই সময়ে জামায়াতের তিন হাজার ২১টি দলীয় অফিস বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষতি হয় ৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া জামায়াত নেতাদের সংশ্লিষ্ট ২২০টি ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং লুটপাটে ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
এদিকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জামায়াত-শিবির সমর্থিত ৮৫৮ নেতাকর্মী শহীদ হন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে। তবে এসব শহীদের আলাদা দলীয় পরিচয় দিতে চাইছে না দলটি। এ ছাড়া গত সাড়ে ১৫ বছরে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে যেসব সমর্থক নিহত হয়েছেন, তাদের পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়নি।
শিবির সূত্রে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী আমলে তাদের ১০১ জন নেতাকর্মী শহীদ হন। মামলা হয় ১৭ হাজারের বেশি। ওই সব মামলায় গ্রেপ্তার হন ৬৬ হাজার নেতাকর্মী।
সূত্রমতে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল জামায়াতের। অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই চলত দলীয় কার্যক্রম। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর থেকেই চরম জুলুম-নির্যাতন ও দমনের মুখে পড়ে দলটি। একই ভাবে নির্যাতনের শিকার হয় সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরও। অবশ্য ক্ষমতায় আসার আগেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাধ্যমে জামায়তবিরোধী অবস্থানের জানান দেয় আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী জুলুম-নির্যাতন প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, পতিত আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে কঠিন আঘাত করা হয় জামায়াতের ওপর। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ওপর পিলখানায় আঘাতের পর জামায়াতকে বেছে নিয়েছিল তাদের আঘাতের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে। ওই আঘাত দিয়ে তারা মনে করেছিল জামায়াত এ দেশের মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। দেশের মানুষের সঙ্গে আর থাকতেই দেবে না, কাজও করতে দেবে ন। শেষ করে দেবে। ওই পথেই তারা এগিয়েছিল।
জামায়াত আমির আরো বলেন, তারা প্রথম আঘাত হিসেবে জামায়াত নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে অত্যন্ত বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য ট্রায়ালের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে সাজা দিয়েছে। কাউকে ফাঁসি দিয়েছে, কাউকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ব্রিটেনের একজন বিচারক বলেছেনÑ এটা ছিল ‘জেনোসাইড অব জাস্টিজ’ বা বিচারিক গণহত্যা। এরপর তারা অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ করা জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এককভাবে তখন লক্ষ্যবস্তু ছিল জামায়াত। তবে কঠিন সময়ে জামায়াত তার কার্যক্রম একদিনের জন্যও বন্ধ করেনি। শেষ আঘাত হিসেবে আওয়ামী সরকার জামায়াতকে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ করে।
জামায়াতের ওপর আওয়ামী দমননীতি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, এটা হাসিনার একটা কৌশল ছিল। পশ্চিমা দেশগুলোর মনরক্ষায় মৌলবাদ ধ্বংসের কাজে সম্পৃক্ততা ছিল হাসিনা সরকারের। অবশ্য জামায়াতের সঙ্গে তারা রাজনীতিও করেছে। তাদের রাজনীতিটা ঘোলাটে। পরিষ্কার কোনো অবস্থান তাদের দেখা যায় না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই তাদের স্ট্যান্ডগুলো নেয়। জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে তারা খুব কম কৌশল নেয়। এতে তারা দলগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের নামে প্রহসন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১০ সালে। এর মধ্য দিয়ে জামায়াত নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে দলটিকে দমনে সর্বোচ্চ তৎপরতা শুরু করে আওয়ামী সরকার। সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে সাজানো মামলায় বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে একে একে দলটির সাবেক আমির ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা এবং নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
যাবজ্জীবন দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে বিনা চিকিৎসাসহ বিভিন্ন নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক নেতা বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কারা হেফাজতে চিকিৎসার নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ করে জামায়াত।
এ ছাড়া ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু হয় দলটির নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুস সুবহান, নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ এবং সাতক্ষীরা জেলা আমির ও সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুল খালেক মণ্ডলের। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে এখনো কারাগারে আছেন দলটির সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম।
ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের নির্দেশে সাজানো মামলা, সাক্ষী আর আওয়ামী আস্থাভাজন বিচারকদের মাধ্যমে এ বিচার কার্যক্রম চালানো হয়। মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নামে বিচারিক হত্যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল আওয়ামী সরকার। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও প্রবাসী আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন ফাঁসের মধ্য দিয়ে তার প্রমাণ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া জোর করে সাক্ষ্য দেওয়ারও অভিযোগ করেন অনেক সাক্ষী।
হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার আর বানোয়াট মামলা দিয়ে কারারুদ্ধ করার বিষয়টি ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। মিছিল-মিটিং করলেই ধাওয়া বা ঘেরাও করে যেমন গ্রেপ্তার করা হতো, তেমনি দিনে-রাতে বাসাবাড়ি, অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে কাউকে পাওয়া গেলেই ধরে নিয়ে যেত পুলিশ। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পরিচিত নেতাকর্মীদের কেউ প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারতেন না। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে বা নিরাপদ স্থানে থাকতেন সবাই। এতে অনেকেই চরম হয়রানির পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং কাজকর্ম থেকে বঞ্চিত হন। পরিবারের সদস্যরাও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন।
দলীয় সূত্রমতে, বিগত আওয়ামী শাসনামলে ১৪ হাজার ৮২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন এক লাখ ১০ হাজার ৯০১ জন নেতাকর্মী। ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এটিএম আজহারুল ইসলাম ছাড়া তেমন নেতাকর্মী জেলে না থাকলেও অধিকাংশ মামলা এখনো চলমান।
এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল জানান, জামায়াত নেতাকর্মীদের মামলা এখনো চলমান। তবে সরকার রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে জামায়াতের মামলাগুলোও প্রত্যাহার হবে বলে আশা করছি।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের নায়েবে আমির অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন জানান, বিচারিক প্রক্রিয়ায় মাত্র হাজারখানেক মামলা শেষ হয়েছে। আর সরকার যে মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া করছে, তাতে প্রাথমিকভাবে জামায়াতের ৬০০ মামলা আছে। এ ছাড়া মহানগর দক্ষিণের এক হাজার ৭০৫টি এবং উত্তরের এক হাজার 0৫০০ মামলার তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা এখনো চলমান। এর মধ্যে আমিরে জামায়াত থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয়, মহানগরসহ সারা দেশের শীর্ষ নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। তবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী মামলাগুলোয় হাজিরার ক্ষেত্রে শিথিলতা রয়েছে। আইনজীবীরাই হাজিরা দিচ্ছেন।
আদালত ও থানায় বিপুল খরচ
আওয়ামী আমলে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মামলা চালাতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে জামায়াত ও শিবিরের। দলীয়ভাবে কিছু খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবার থেকেও লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। শুধু মামলা পরিচালনায় আইনজীবীদের পেছনেই নয়, থানা পুলিশ এবং জেলখানায় নির্যাতন থেকে রেহাই পেতেও অনেককে বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে বলে জানা গেছে।
বারবার গ্রেপ্তার, রিমান্ডে বর্বর নির্যাতন
জামায়াত নেতাকর্মীদের নির্যাতনের অন্যতম একটি প্রক্রিয়া ছিল দফায় দফায় গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে নির্যাতন। এক্ষেত্রে আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা করা হতো না। অনেক প্রক্রিয়া করে আদালত একবার জামিনে মুক্তির আদেশ দিলেও জেলগেট থেকে ফের আটক করে নতুন বা পুরোনো মামলায় জড়িয়ে কারাগারে পাঠানো হতো। এভাবে অসংখ্য নেতাকর্মীকে বছরের বছর পর জেলে কাটাতে হয়েছে। রিমান্ডে নির্যাতন আর দীর্ঘ জেলজীবন থেকে মুক্তি পেলেও অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
কয়েক দফায় গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে চার বছর জেল খাটেন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। গ্রেপ্তারের পর একটানা ৬৭ দিন রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ে তার ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। আজও সে নির্যাতনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। একই ভাবে গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের শিকার হন জামায়াতের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা।
এ বিষয়ে ড. মাসুদ বলেন, রিমান্ডের বিভিন্ন সময় আমাকে ক্রসফায়ার, ছাদ থেকে ফেলা দেওয়াসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এ ছাড়া আমাকে শারীরিকভাবে ব্যাপক নির্যাতনের একপর্যায়ে অবস্থা খারাপ হলে গোপনে পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও জানাজানির আশঙ্কায় পরে ডিবিতে নিয়ে নামমাত্র চিকিৎসা দেওয়া হয়। ব্রেন ও পায়ের নিচে আঘাতের কারণে এখনো বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমি সুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার হলেও আদালতে নেওয়া হতো হুইলচেয়ারে।
জামায়াতের এই নেতা আরো বলেন, আদালত ‘নো অ্যারেস্ট, নো হ্যারেজ’ রায় দিলেও তা মানত না পুলিশ। মুক্তির সময় জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তার করা হতো। চিকিৎসার আদেশ দিলেও আওয়ামী চিকিৎসকরা আমাদের ভর্তি না করে সামান্য কিছু ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দিত।
একই ভাবে জামায়াতের বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেনসহ শীর্ষ অনেক নেতা দফায় দফায় রিমান্ডে নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি এক থেকে চার বছর পর্যন্ত জেল খেটেছেন। এ ছাড়া রিমান্ডে ও কারাগারে নির্যাতনের শিকার কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য অধ্যাপক তাসনীম আলম মুক্তির পরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। বর্তমানে প্যারালাইজড অবস্থায় আছেন তিনি। এভাবে বহু নেতাকর্মীর জীবন বিপন্ন করে দিয়েছে আওয়ামী সরকার।
গুম-অপহরণ
শুধু গ্রেপ্তার-নির্যাতনই নয়, জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে অপহরণ ও দীর্ঘদিন গুম করে রাখা হয় গত সাড়ে ১৫ বছরে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী গুম হওয়া বেশ কয়েকজন ফিরে আসার পর নির্যাতনের ভয়াবহতা প্রকাশ পায়। তবে এক যুগ আগে ইবি শাখা শিবির নেতা ওয়ালী উল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসসহ বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া অন্তত সাতজনের এখনো সন্ধান মেলেনি। জামায়াত পরিবারের সদস্যরাও রেহাই পাননি গুম থেকে। এর মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহিল আমান আল আযমী এবং মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমান আট বছর পর আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান। আরো তিন শিবির নেতা তিন বছর গুমের পর অসুস্থ অবস্থায় ফেরত আসেন।
সব অফিস ছিল বন্ধ
জামায়াত দমনের অংশ হিসেবে একপর্যায়ে দলটির কেন্দ্রীয়, মহানগরসহ সব কার্যালয় অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেয় ফ্যাসিস্ট সরকার। কার্যালয়সহ জামায়াত নেতাদের বাসা, অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় থাকত পুলিশ ও গোয়েন্দা নজরদারি। এ অবস্থায় বিকল্প অফিস এবং গোপনীয়তা রক্ষা করে চলত জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রম।
কোরআন-হাদিসের আলোচনায় ছিল বাধা
আওয়ামী আমলে জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক বই প্রকাশ্যে রাখা ও পড়ার ক্ষেত্রে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। এমনকি জামায়তের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের লেখা তাফসির ও অন্যান্য ইসলামী বইপত্রও পড়া এবং বহন করা যেত না। কোথাও ধর্মীয় বই পেলেই জামায়াত-শিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালানো হতো। ধর্মীয় অনেক বই বেচাকেনা বা প্রকাশনায়ও ছিল বাধা। কাউকে আটক করলেই সঙ্গে ধর্মীয় বই রেখে তাকে জিহাদি বই আখ্যা দিয়ে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রচার চালাত পুলিশ-র‌্যাব।
কার্যক্রম দেখলেই পুলিশের অ্যাকশন
মিছিল-মিটিং বা কোনো কর্মসূচি পালন করলেই চালানো হতো পুলিশি অ্যাকশন। টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ ছাড়াও অতর্কিত গুলি চালানো হতো জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর। ধরে নিয়ে কাছ থেকে গুলি করারও বহু ঘটনা ঘটেছে। নেতাকর্মীদের ওপর প্রথমে হামলা চালিয়ে সেটাকে পুলিশের ওপর হামলা-আক্রমণ বলে অপপ্রচার চালানো হতো বিভিন্ন মিডিয়ায়। এতে গ্রেপ্তার-নির্যাতন সহজ হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। শুধু প্রকাশ্যে নয়, কোনো বাসা বা অফিসে সাংগঠনিক বৈঠক বা কোরআন-হাদিসের আলোচনা করার খবর পেলেই তা রাষ্ট্রবিরোধী গোপন কার্যক্রম হিসেবে অপপ্রচার করে নির্যাতন চালাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আওয়ামী নির্যাতন প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের যুব বিভাগের সেক্রেটারি হাসানুল বান্না চপল বলেন, ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর গভীর রাতে আমার বাসায় হানা দেয় ডিবি পুলিশ। পরিবারকে জিম্মি করে বিনা অপরাধে আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে তুলেই চোখ বেঁধে শুরু হয় নির্যাতন। একপর্যায়ে ক্রসফায়ারে দিয়ে লাশ গুম করারও হুমকি দেওয়া হয়। দীর্ঘ দুই মাস পর জামিনে মুক্তি পেলেও পরবর্তীতে আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি আমার। শুধু আমি নই, দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী এমন পরিস্থিতির শিকার হন। তবে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছি।
ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার শিবির
শিক্ষাঙ্গনকে শিবিরমুক্ত করতে ব্যাপক ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী সরকার। ছাত্রলীগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে একের পর এক হামলা, গ্রেপ্তারসহ চতুর্মুখী নির্যাতন চালানো হয়। শিবির সন্দেহ হলেই ধরে নির্যাতন ও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া যেন অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এতে প্রকাশ্য কার্যক্রম চালানো তো দূরের কথা, শিবির পরিচয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
শিবির সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী আমলে ১৭ হাজার ১৮১টি মামলায় শিবিরের ৬৬ হাজার ২৪০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। রিমান্ডে নির্যাতিত হন ১৯ হাজার ১৯৬ জন। অনেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হন। এ সময় ১০১ জন শহীদ, ৩১ হাজার ২৫৭ জন আহত এবং ১৩৩ জন পঙ্গু হন।
শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ জানান, শিবির নেতাকর্মীদের নামে এখনো ১১ হাজার রাজনৈতিক মামলা চলমান। এগুলো নিষ্পত্তির জন্য আইন উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের ইতিহাসে গত দেড় দশক ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়। ওই সময় হাসিনার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ছাত্রশিবির। তাই শিবির নিধনের এক জঘন্য কৌশল অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ। চিরুনি অভিযানের নামে হাসিনার পোষা বাহিনী শিবিরের নেতাকর্মীদের মেস ও বাসাবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়। তারা অসংখ্য নিরপরাধ কর্মীর সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের অধিকার হরণ করে। কোরআন-হাদিসের ক্লাস, ঘরোয়া প্রোগ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি মসজিদে নামাজরত অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে গুম ও হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করেনি।
শিবির সভাপতি আরো বলেন, গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকার শিবিরের ১০১ জনকে হত্যা এবং সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে চিরতরে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ওই সময় অজস্র কর্মীকে গুম করে। এখনো তাদের মধ্যে সাতজন নিখোঁজ। সবচেয়ে নির্মম বিষয় হলো, রাবি শিবির সেক্রেটারি শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানীসহ সারা দেশের প্রায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে ভিকটিমদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়। শিবির সম্পৃক্ততার কারণে হাজারো বৈধ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। অনেককে ক্লাস-পরীক্ষায়ও অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। অসংখ্য শিবিরকর্মী তাদের ছাত্রজীবন সময়মতো শেষ করতে পারেননি। কারো কারো গোটা ক্যারিয়ারই ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু শারীরিক নির্যাতনই নয়, শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে শত শত যোগ্য ও মেধাবী যুবককে বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ বা পেশাগত জীবন থেকেও বঞ্চিত করা হয়। জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ওই ভয়াল ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করেছি।
ক্রসফায়ারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঝিনাইদহের নিজ বাসা থেকে আটক করা হয় শিবির নেতা সাইফুল ইসলাম মামুনকে। কিন্তু তাকে আটকের কথা অস্বীকার করে পুলিশ। একপর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে মামুনকে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ১৯ জুলাই রাতের আঁধারে হত্যা করে পুলিশ। এভাবে ঝিনাইদহ এলাকায়ই একের পর এক জামায়াত-শিবিরের অন্তত ১৭ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। জামায়াত-শিবির দমনে সম্ভাবনাময় ও সক্রিয় নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি ক্রসফায়ার নাটকের মধ্য দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড চালায় ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ ও র‌্যাব।
দলীয় সূত্রমতে, পতিত আওয়ামী আমলে জামায়াত-শিবিরের ৮৬ নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ার দেওয়া হয় ঝিনাইদহে। একই ভাবে ক্রসফায়ার আর হত্যা-নির্যাতনের জন্য আতঙ্কিত জনপদ ছিল সাতক্ষীরা। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী।
ঝিনাইদহে হত্যা-নির্যাতনের বিভীষিকাময় চিত্র তুলে ধরে সদর উপজেলা জামায়াতের আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা ড. হাবিবুর রহমান বলেন, সে সময় খুবই ভয়ঙ্কর অবস্থা গেছে। পুলিশ ধরলেই বেঁচে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। প্রথমে গুম করত পুলিশ, পরে টিভিতে ক্রসফায়ারের কথা জেনে পরিবার গিয়ে লাশ শনাক্ত করত।
নির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট উপজেলা পরিষদ থেকে ডিসি ও ইউএনওর উপস্থিতিতে গ্রেপ্তার হন ড. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ওই সময় জামায়াত-শিবিরের কোনো নেতাকর্মী শহরে ঢুকতে বা কোথাও বসে কথা বলতে পারতেন না। প্রকাশ্যে কোনো বৈঠকও করা যেত না। খবর পেলেই পুলিশ হানা দিত। ডিএসবির মুরাদ নামে এক পুলিশ সদস্য (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ধরিয়ে দেওয়ার কাজ করত। কামরুল নামে সাবেক এক শিবিরকর্মী এখনো গুম আছে বলেও তিনি জানান।
ক্রসফায়ারের পাশাপাশি জামায়াত-শিবির দমনে ভয়াবহ তৎপরতা চালানো হয় সাতক্ষীরায়। মাওলানা সাঈদীর রায়কে ঘিরে আন্দোলনের সময় ওই এলাকায় গুলি করে অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করে পুলিশ। অনেককে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার জামায়াতকর্মী আব্দুল্লাহ রুম্মান বলেন, আওয়ামী আমলে সাতক্ষীরা ছিল একটি আতঙ্কের জনপদ। এখানে জামায়াত নেতাদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। নেতাকর্মীদের ধরে পায়ে গুলি, মিছিল-মিটিং বা বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে মামলা, হামলার ঘটনা ছিল স্বাভাবিক। বিগত ১৫ বছর এ এলাকার জামায়াত নেতাকর্মীরা কেউ নিজের বাড়িতে ঠিকমতো থাকতে পারেননি। কারো জানাজায় গেলেও ধরে নিয়ে যেত পুলিশ।
রেহাই পাননি নারী কর্মীরাও
২০০৯ সালে পিরোজপুরে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার চার নেত্রীকে বোরকা পরা অবস্থায় ইসলামী বই-পুস্তকসহ আটক করে জঙ্গি বলে প্রচার চালিয়ে আওয়ামী সরকার তার ইসলাম নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করে। এরপর বিগত ১৬ বছরে দেশের সর্বত্র ইসলাম পালন করাকে ভয়ানক দেশবিরোধী অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালায় বিগত পতিত সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোয় বোরকা ও হিজাব-নিকাব পরা, নামাজ আদায় করা, ইসলামী বই পড়া ও সংগ্রহে রাখার কারণে জঙ্গি বলে নারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ছাড়াও রমজান মাসের ইসলামী আলোচনা, কোরআন তালিম, তারাবির নামাজ এবং দলীয় সাধারণ প্রোগ্রামগুলোয় সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সশস্ত্রভাবে হানা দিয়ে শত শত নারীকে গ্রেপ্তার করে। বোরকা পরতে না দিয়ে বেপর্দা অবস্থায় জেল থেকে কোর্টে হাজিরা দিতে আনা হয় অনেককে। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে শুধুমাত্র ইসলাম পালনের কারণে। বিগত সময়ে জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগ ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার এক হাজার ৮৭৮ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীণ করে আওয়ামী সরকার। ওই সময়ে ছাত্রী সংস্থার এক কর্মী ও জামায়াতের ছয় নারী শহীদ হন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রী সংস্থার কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
আওয়ামী নির্যাতন প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার বলেন, আওয়ামী শাসনামলে আমাদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত কোথাও আমাদের নেতাকর্মীরা গত সাড়ে ১৫ বছরে স্বাভাবিকভাবে কোনো কাজ করতে পারেননি। হাজার হাজার নেতাকর্মী বেকার হয়ে পড়েন। এখনো পাঁচ হাজারের বেশি নেতাকর্মী পঙ্গু অবস্থায় আছেন। এসব জুলুম-নির্যাতনের প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা আমাদের সবার দাবি।
দৈনিক আমার দেশ

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

জামায়াত-শিবির নিধনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ

আপডেট সময় : ০৯:২৭:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

পতিত আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বেশি রোষানলের শিকার হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। একটানা সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে জামায়াত-শিবির নিধনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শেখ হাসিনা সরকার।

বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ পাঁচ নেতার ফাঁসি কার্যকরসহ সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনের জীবন বিপন্ন করে তৎকালীন সরকার।
মিথ্যা অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে এখনো কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন কেন্দ্রীয় এক নেতা। এ ছাড়া কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা অপরাধে মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ড, ক্রসফায়ারে হত্যা, গুম-অপহরণ, হামলা, গুলিসহ নানাভাবে অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন চালায় ফ্যাসিবাদী সরকার।
দলীয় কার্যক্রমে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বন্ধ করে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ও অন্যসব কার্যালয়। বাতিল করা হয় দলটির নিবন্ধন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বিপন্ন হয় অনেকের শিক্ষাজীবন। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও অপপ্রচারে র‌্যাব-পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় শক্তি, মিডিয়া এবং আওয়ামী নেতাকর্মীদের ব্যবহার করা হয়।
আওয়ামী নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি মহিলা জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার নেতাকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরাও। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের চারদিন আগে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটায় আওয়ামী সরকার। অবশ্য হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় জামায়াত-শিবির। মাত্র ২৬ দিনের মাথায় নিষিদ্ধের আদেশটিও বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে দলটির ৩৫৮ জন শহীদ হন। ক্রসফায়ারে নিহত হন ৮৬ জন। মহিলা জামায়াতের ছয়জন এবং ছাত্রী সংস্থার একজন বিভিন্ন সময় শহীদ হন। ১৪ হাজার ৮২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন এক লাখ ১০ হাজার ৯০১ জন নেতাকর্মী। এরমধ্যে জামায়াতের পুরুষ ৯১ হাজার ৬৭৫ জন, নারী এক হাজার ৮৭ জন, ছাত্র ১৭ হাজার ৪৬৩ জন এবং ৬৭৬ জন ছাত্রী গ্রেপ্তার হন। বিভিন্নভাবে আহত হন ৭৫ হাজার ৫৮৫ নেতাকর্মী। পঙ্গু হন পাঁচ হাজার ২০৪ জন। পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতিত হন ৯৬ হাজার ৯৩ জন আর গুম-অপহরণের শিকার হন ২৫ জন, যাদের মধ্যে এখনো অন্তত সাতজন নিখোঁজ।
আওয়ামী শাসনামলে দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের নেতাকর্মীদের পাঁচ হাজার বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ওই সময়ে জামায়াতের তিন হাজার ২১টি দলীয় অফিস বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষতি হয় ৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া জামায়াত নেতাদের সংশ্লিষ্ট ২২০টি ব্যবসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হামলা এবং লুটপাটে ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
এদিকে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে জামায়াত-শিবির সমর্থিত ৮৫৮ নেতাকর্মী শহীদ হন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে। তবে এসব শহীদের আলাদা দলীয় পরিচয় দিতে চাইছে না দলটি। এ ছাড়া গত সাড়ে ১৫ বছরে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে যেসব সমর্থক নিহত হয়েছেন, তাদের পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়নি।
শিবির সূত্রে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী আমলে তাদের ১০১ জন নেতাকর্মী শহীদ হন। মামলা হয় ১৭ হাজারের বেশি। ওই সব মামলায় গ্রেপ্তার হন ৬৬ হাজার নেতাকর্মী।
সূত্রমতে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল জামায়াতের। অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই চলত দলীয় কার্যক্রম। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর থেকেই চরম জুলুম-নির্যাতন ও দমনের মুখে পড়ে দলটি। একই ভাবে নির্যাতনের শিকার হয় সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরও। অবশ্য ক্ষমতায় আসার আগেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাধ্যমে জামায়তবিরোধী অবস্থানের জানান দেয় আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী জুলুম-নির্যাতন প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, পতিত আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে কঠিন আঘাত করা হয় জামায়াতের ওপর। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ওপর পিলখানায় আঘাতের পর জামায়াতকে বেছে নিয়েছিল তাদের আঘাতের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে। ওই আঘাত দিয়ে তারা মনে করেছিল জামায়াত এ দেশের মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। দেশের মানুষের সঙ্গে আর থাকতেই দেবে না, কাজও করতে দেবে ন। শেষ করে দেবে। ওই পথেই তারা এগিয়েছিল।
জামায়াত আমির আরো বলেন, তারা প্রথম আঘাত হিসেবে জামায়াত নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে অত্যন্ত বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য ট্রায়ালের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালে সাজা দিয়েছে। কাউকে ফাঁসি দিয়েছে, কাউকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। ব্রিটেনের একজন বিচারক বলেছেনÑ এটা ছিল ‘জেনোসাইড অব জাস্টিজ’ বা বিচারিক গণহত্যা। এরপর তারা অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ করা জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এককভাবে তখন লক্ষ্যবস্তু ছিল জামায়াত। তবে কঠিন সময়ে জামায়াত তার কার্যক্রম একদিনের জন্যও বন্ধ করেনি। শেষ আঘাত হিসেবে আওয়ামী সরকার জামায়াতকে অন্যায়ভাবে নিষিদ্ধ করে।
জামায়াতের ওপর আওয়ামী দমননীতি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, এটা হাসিনার একটা কৌশল ছিল। পশ্চিমা দেশগুলোর মনরক্ষায় মৌলবাদ ধ্বংসের কাজে সম্পৃক্ততা ছিল হাসিনা সরকারের। অবশ্য জামায়াতের সঙ্গে তারা রাজনীতিও করেছে। তাদের রাজনীতিটা ঘোলাটে। পরিষ্কার কোনো অবস্থান তাদের দেখা যায় না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই তাদের স্ট্যান্ডগুলো নেয়। জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে তারা খুব কম কৌশল নেয়। এতে তারা দলগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের নামে প্রহসন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১০ সালে। এর মধ্য দিয়ে জামায়াত নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে দলটিকে দমনে সর্বোচ্চ তৎপরতা শুরু করে আওয়ামী সরকার। সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে সাজানো মামলায় বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে একে একে দলটির সাবেক আমির ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা এবং নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
যাবজ্জীবন দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে বিনা চিকিৎসাসহ বিভিন্ন নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক নেতা বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে কারা হেফাজতে চিকিৎসার নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ করে জামায়াত।
এ ছাড়া ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু হয় দলটির নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুস সুবহান, নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ এবং সাতক্ষীরা জেলা আমির ও সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুল খালেক মণ্ডলের। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে এখনো কারাগারে আছেন দলটির সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম।
ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের নির্দেশে সাজানো মামলা, সাক্ষী আর আওয়ামী আস্থাভাজন বিচারকদের মাধ্যমে এ বিচার কার্যক্রম চালানো হয়। মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নামে বিচারিক হত্যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল আওয়ামী সরকার। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও প্রবাসী আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন ফাঁসের মধ্য দিয়ে তার প্রমাণ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া জোর করে সাক্ষ্য দেওয়ারও অভিযোগ করেন অনেক সাক্ষী।
হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার আর বানোয়াট মামলা দিয়ে কারারুদ্ধ করার বিষয়টি ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। মিছিল-মিটিং করলেই ধাওয়া বা ঘেরাও করে যেমন গ্রেপ্তার করা হতো, তেমনি দিনে-রাতে বাসাবাড়ি, অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে কাউকে পাওয়া গেলেই ধরে নিয়ে যেত পুলিশ। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পরিচিত নেতাকর্মীদের কেউ প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারতেন না। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে বা নিরাপদ স্থানে থাকতেন সবাই। এতে অনেকেই চরম হয়রানির পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং কাজকর্ম থেকে বঞ্চিত হন। পরিবারের সদস্যরাও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন।
দলীয় সূত্রমতে, বিগত আওয়ামী শাসনামলে ১৪ হাজার ৮২৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন এক লাখ ১০ হাজার ৯০১ জন নেতাকর্মী। ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এটিএম আজহারুল ইসলাম ছাড়া তেমন নেতাকর্মী জেলে না থাকলেও অধিকাংশ মামলা এখনো চলমান।
এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল জানান, জামায়াত নেতাকর্মীদের মামলা এখনো চলমান। তবে সরকার রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে জামায়াতের মামলাগুলোও প্রত্যাহার হবে বলে আশা করছি।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের নায়েবে আমির অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন জানান, বিচারিক প্রক্রিয়ায় মাত্র হাজারখানেক মামলা শেষ হয়েছে। আর সরকার যে মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া করছে, তাতে প্রাথমিকভাবে জামায়াতের ৬০০ মামলা আছে। এ ছাড়া মহানগর দক্ষিণের এক হাজার ৭০৫টি এবং উত্তরের এক হাজার 0৫০০ মামলার তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা এখনো চলমান। এর মধ্যে আমিরে জামায়াত থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয়, মহানগরসহ সারা দেশের শীর্ষ নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। তবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী মামলাগুলোয় হাজিরার ক্ষেত্রে শিথিলতা রয়েছে। আইনজীবীরাই হাজিরা দিচ্ছেন।
আদালত ও থানায় বিপুল খরচ
আওয়ামী আমলে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মামলা চালাতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে জামায়াত ও শিবিরের। দলীয়ভাবে কিছু খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবার থেকেও লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। শুধু মামলা পরিচালনায় আইনজীবীদের পেছনেই নয়, থানা পুলিশ এবং জেলখানায় নির্যাতন থেকে রেহাই পেতেও অনেককে বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে বলে জানা গেছে।
বারবার গ্রেপ্তার, রিমান্ডে বর্বর নির্যাতন
জামায়াত নেতাকর্মীদের নির্যাতনের অন্যতম একটি প্রক্রিয়া ছিল দফায় দফায় গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে নির্যাতন। এক্ষেত্রে আইনকানুনের কোনো তোয়াক্কা করা হতো না। অনেক প্রক্রিয়া করে আদালত একবার জামিনে মুক্তির আদেশ দিলেও জেলগেট থেকে ফের আটক করে নতুন বা পুরোনো মামলায় জড়িয়ে কারাগারে পাঠানো হতো। এভাবে অসংখ্য নেতাকর্মীকে বছরের বছর পর জেলে কাটাতে হয়েছে। রিমান্ডে নির্যাতন আর দীর্ঘ জেলজীবন থেকে মুক্তি পেলেও অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
কয়েক দফায় গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে চার বছর জেল খাটেন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। গ্রেপ্তারের পর একটানা ৬৭ দিন রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ে তার ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। আজও সে নির্যাতনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। একই ভাবে গ্রেপ্তারের পর নির্যাতনের শিকার হন জামায়াতের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা।
এ বিষয়ে ড. মাসুদ বলেন, রিমান্ডের বিভিন্ন সময় আমাকে ক্রসফায়ার, ছাদ থেকে ফেলা দেওয়াসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এ ছাড়া আমাকে শারীরিকভাবে ব্যাপক নির্যাতনের একপর্যায়ে অবস্থা খারাপ হলে গোপনে পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও জানাজানির আশঙ্কায় পরে ডিবিতে নিয়ে নামমাত্র চিকিৎসা দেওয়া হয়। ব্রেন ও পায়ের নিচে আঘাতের কারণে এখনো বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমি সুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার হলেও আদালতে নেওয়া হতো হুইলচেয়ারে।
জামায়াতের এই নেতা আরো বলেন, আদালত ‘নো অ্যারেস্ট, নো হ্যারেজ’ রায় দিলেও তা মানত না পুলিশ। মুক্তির সময় জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তার করা হতো। চিকিৎসার আদেশ দিলেও আওয়ামী চিকিৎসকরা আমাদের ভর্তি না করে সামান্য কিছু ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দিত।
একই ভাবে জামায়াতের বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেনসহ শীর্ষ অনেক নেতা দফায় দফায় রিমান্ডে নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি এক থেকে চার বছর পর্যন্ত জেল খেটেছেন। এ ছাড়া রিমান্ডে ও কারাগারে নির্যাতনের শিকার কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য অধ্যাপক তাসনীম আলম মুক্তির পরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। বর্তমানে প্যারালাইজড অবস্থায় আছেন তিনি। এভাবে বহু নেতাকর্মীর জীবন বিপন্ন করে দিয়েছে আওয়ামী সরকার।
গুম-অপহরণ
শুধু গ্রেপ্তার-নির্যাতনই নয়, জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে অপহরণ ও দীর্ঘদিন গুম করে রাখা হয় গত সাড়ে ১৫ বছরে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী গুম হওয়া বেশ কয়েকজন ফিরে আসার পর নির্যাতনের ভয়াবহতা প্রকাশ পায়। তবে এক যুগ আগে ইবি শাখা শিবির নেতা ওয়ালী উল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসসহ বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া অন্তত সাতজনের এখনো সন্ধান মেলেনি। জামায়াত পরিবারের সদস্যরাও রেহাই পাননি গুম থেকে। এর মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহিল আমান আল আযমী এবং মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমান আট বছর পর আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান। আরো তিন শিবির নেতা তিন বছর গুমের পর অসুস্থ অবস্থায় ফেরত আসেন।
সব অফিস ছিল বন্ধ
জামায়াত দমনের অংশ হিসেবে একপর্যায়ে দলটির কেন্দ্রীয়, মহানগরসহ সব কার্যালয় অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেয় ফ্যাসিস্ট সরকার। কার্যালয়সহ জামায়াত নেতাদের বাসা, অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় থাকত পুলিশ ও গোয়েন্দা নজরদারি। এ অবস্থায় বিকল্প অফিস এবং গোপনীয়তা রক্ষা করে চলত জামায়াত-শিবিরের কার্যক্রম।
কোরআন-হাদিসের আলোচনায় ছিল বাধা
আওয়ামী আমলে জামায়াত-শিবিরের সাংগঠনিক বই প্রকাশ্যে রাখা ও পড়ার ক্ষেত্রে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। এমনকি জামায়তের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের লেখা তাফসির ও অন্যান্য ইসলামী বইপত্রও পড়া এবং বহন করা যেত না। কোথাও ধর্মীয় বই পেলেই জামায়াত-শিবির সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালানো হতো। ধর্মীয় অনেক বই বেচাকেনা বা প্রকাশনায়ও ছিল বাধা। কাউকে আটক করলেই সঙ্গে ধর্মীয় বই রেখে তাকে জিহাদি বই আখ্যা দিয়ে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রচার চালাত পুলিশ-র‌্যাব।
কার্যক্রম দেখলেই পুলিশের অ্যাকশন
মিছিল-মিটিং বা কোনো কর্মসূচি পালন করলেই চালানো হতো পুলিশি অ্যাকশন। টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ ছাড়াও অতর্কিত গুলি চালানো হতো জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর। ধরে নিয়ে কাছ থেকে গুলি করারও বহু ঘটনা ঘটেছে। নেতাকর্মীদের ওপর প্রথমে হামলা চালিয়ে সেটাকে পুলিশের ওপর হামলা-আক্রমণ বলে অপপ্রচার চালানো হতো বিভিন্ন মিডিয়ায়। এতে গ্রেপ্তার-নির্যাতন সহজ হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। শুধু প্রকাশ্যে নয়, কোনো বাসা বা অফিসে সাংগঠনিক বৈঠক বা কোরআন-হাদিসের আলোচনা করার খবর পেলেই তা রাষ্ট্রবিরোধী গোপন কার্যক্রম হিসেবে অপপ্রচার করে নির্যাতন চালাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আওয়ামী নির্যাতন প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের যুব বিভাগের সেক্রেটারি হাসানুল বান্না চপল বলেন, ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর গভীর রাতে আমার বাসায় হানা দেয় ডিবি পুলিশ। পরিবারকে জিম্মি করে বিনা অপরাধে আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে তুলেই চোখ বেঁধে শুরু হয় নির্যাতন। একপর্যায়ে ক্রসফায়ারে দিয়ে লাশ গুম করারও হুমকি দেওয়া হয়। দীর্ঘ দুই মাস পর জামিনে মুক্তি পেলেও পরবর্তীতে আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি আমার। শুধু আমি নই, দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী এমন পরিস্থিতির শিকার হন। তবে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছি।
ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার শিবির
শিক্ষাঙ্গনকে শিবিরমুক্ত করতে ব্যাপক ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী সরকার। ছাত্রলীগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে একের পর এক হামলা, গ্রেপ্তারসহ চতুর্মুখী নির্যাতন চালানো হয়। শিবির সন্দেহ হলেই ধরে নির্যাতন ও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া যেন অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এতে প্রকাশ্য কার্যক্রম চালানো তো দূরের কথা, শিবির পরিচয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
শিবির সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী আমলে ১৭ হাজার ১৮১টি মামলায় শিবিরের ৬৬ হাজার ২৪০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। রিমান্ডে নির্যাতিত হন ১৯ হাজার ১৯৬ জন। অনেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত হন। এ সময় ১০১ জন শহীদ, ৩১ হাজার ২৫৭ জন আহত এবং ১৩৩ জন পঙ্গু হন।
শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ জানান, শিবির নেতাকর্মীদের নামে এখনো ১১ হাজার রাজনৈতিক মামলা চলমান। এগুলো নিষ্পত্তির জন্য আইন উপদেষ্টাকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, দেশের ইতিহাসে গত দেড় দশক ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সবচেয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়। ওই সময় হাসিনার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ছাত্রশিবির। তাই শিবির নিধনের এক জঘন্য কৌশল অবলম্বন করে আওয়ামী লীগ। চিরুনি অভিযানের নামে হাসিনার পোষা বাহিনী শিবিরের নেতাকর্মীদের মেস ও বাসাবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়। তারা অসংখ্য নিরপরাধ কর্মীর সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের অধিকার হরণ করে। কোরআন-হাদিসের ক্লাস, ঘরোয়া প্রোগ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি মসজিদে নামাজরত অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে গুম ও হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করেনি।
শিবির সভাপতি আরো বলেন, গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকার শিবিরের ১০১ জনকে হত্যা এবং সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে চিরতরে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ওই সময় অজস্র কর্মীকে গুম করে। এখনো তাদের মধ্যে সাতজন নিখোঁজ। সবচেয়ে নির্মম বিষয় হলো, রাবি শিবির সেক্রেটারি শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানীসহ সারা দেশের প্রায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে ভিকটিমদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়। শিবির সম্পৃক্ততার কারণে হাজারো বৈধ শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। অনেককে ক্লাস-পরীক্ষায়ও অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। অসংখ্য শিবিরকর্মী তাদের ছাত্রজীবন সময়মতো শেষ করতে পারেননি। কারো কারো গোটা ক্যারিয়ারই ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু শারীরিক নির্যাতনই নয়, শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে শত শত যোগ্য ও মেধাবী যুবককে বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ বা পেশাগত জীবন থেকেও বঞ্চিত করা হয়। জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ওই ভয়াল ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করেছি।
ক্রসফায়ারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঝিনাইদহের নিজ বাসা থেকে আটক করা হয় শিবির নেতা সাইফুল ইসলাম মামুনকে। কিন্তু তাকে আটকের কথা অস্বীকার করে পুলিশ। একপর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে মামুনকে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ১৯ জুলাই রাতের আঁধারে হত্যা করে পুলিশ। এভাবে ঝিনাইদহ এলাকায়ই একের পর এক জামায়াত-শিবিরের অন্তত ১৭ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। জামায়াত-শিবির দমনে সম্ভাবনাময় ও সক্রিয় নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি ক্রসফায়ার নাটকের মধ্য দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড চালায় ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ ও র‌্যাব।
দলীয় সূত্রমতে, পতিত আওয়ামী আমলে জামায়াত-শিবিরের ৮৬ নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ার দেওয়া হয় ঝিনাইদহে। একই ভাবে ক্রসফায়ার আর হত্যা-নির্যাতনের জন্য আতঙ্কিত জনপদ ছিল সাতক্ষীরা। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী।
ঝিনাইদহে হত্যা-নির্যাতনের বিভীষিকাময় চিত্র তুলে ধরে সদর উপজেলা জামায়াতের আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা ড. হাবিবুর রহমান বলেন, সে সময় খুবই ভয়ঙ্কর অবস্থা গেছে। পুলিশ ধরলেই বেঁচে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। প্রথমে গুম করত পুলিশ, পরে টিভিতে ক্রসফায়ারের কথা জেনে পরিবার গিয়ে লাশ শনাক্ত করত।
নির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও ২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট উপজেলা পরিষদ থেকে ডিসি ও ইউএনওর উপস্থিতিতে গ্রেপ্তার হন ড. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ওই সময় জামায়াত-শিবিরের কোনো নেতাকর্মী শহরে ঢুকতে বা কোথাও বসে কথা বলতে পারতেন না। প্রকাশ্যে কোনো বৈঠকও করা যেত না। খবর পেলেই পুলিশ হানা দিত। ডিএসবির মুরাদ নামে এক পুলিশ সদস্য (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ধরিয়ে দেওয়ার কাজ করত। কামরুল নামে সাবেক এক শিবিরকর্মী এখনো গুম আছে বলেও তিনি জানান।
ক্রসফায়ারের পাশাপাশি জামায়াত-শিবির দমনে ভয়াবহ তৎপরতা চালানো হয় সাতক্ষীরায়। মাওলানা সাঈদীর রায়কে ঘিরে আন্দোলনের সময় ওই এলাকায় গুলি করে অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করে পুলিশ। অনেককে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার জামায়াতকর্মী আব্দুল্লাহ রুম্মান বলেন, আওয়ামী আমলে সাতক্ষীরা ছিল একটি আতঙ্কের জনপদ। এখানে জামায়াত নেতাদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। নেতাকর্মীদের ধরে পায়ে গুলি, মিছিল-মিটিং বা বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে ধরে নিয়ে মামলা, হামলার ঘটনা ছিল স্বাভাবিক। বিগত ১৫ বছর এ এলাকার জামায়াত নেতাকর্মীরা কেউ নিজের বাড়িতে ঠিকমতো থাকতে পারেননি। কারো জানাজায় গেলেও ধরে নিয়ে যেত পুলিশ।
রেহাই পাননি নারী কর্মীরাও
২০০৯ সালে পিরোজপুরে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার চার নেত্রীকে বোরকা পরা অবস্থায় ইসলামী বই-পুস্তকসহ আটক করে জঙ্গি বলে প্রচার চালিয়ে আওয়ামী সরকার তার ইসলাম নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করে। এরপর বিগত ১৬ বছরে দেশের সর্বত্র ইসলাম পালন করাকে ভয়ানক দেশবিরোধী অপরাধ হিসেবে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালায় বিগত পতিত সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোয় বোরকা ও হিজাব-নিকাব পরা, নামাজ আদায় করা, ইসলামী বই পড়া ও সংগ্রহে রাখার কারণে জঙ্গি বলে নারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ছাড়াও রমজান মাসের ইসলামী আলোচনা, কোরআন তালিম, তারাবির নামাজ এবং দলীয় সাধারণ প্রোগ্রামগুলোয় সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সশস্ত্রভাবে হানা দিয়ে শত শত নারীকে গ্রেপ্তার করে। বোরকা পরতে না দিয়ে বেপর্দা অবস্থায় জেল থেকে কোর্টে হাজিরা দিতে আনা হয় অনেককে। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে শুধুমাত্র ইসলাম পালনের কারণে। বিগত সময়ে জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগ ও ইসলামী ছাত্রী সংস্থার এক হাজার ৮৭৮ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীণ করে আওয়ামী সরকার। ওই সময়ে ছাত্রী সংস্থার এক কর্মী ও জামায়াতের ছয় নারী শহীদ হন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রী সংস্থার কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
আওয়ামী নির্যাতন প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার বলেন, আওয়ামী শাসনামলে আমাদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত কোথাও আমাদের নেতাকর্মীরা গত সাড়ে ১৫ বছরে স্বাভাবিকভাবে কোনো কাজ করতে পারেননি। হাজার হাজার নেতাকর্মী বেকার হয়ে পড়েন। এখনো পাঁচ হাজারের বেশি নেতাকর্মী পঙ্গু অবস্থায় আছেন। এসব জুলুম-নির্যাতনের প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা আমাদের সবার দাবি।
দৈনিক আমার দেশ