ঢাকা ১২:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

স্বাধীনতার সঙ্গে বেঈমানি ও আওয়ামী লীগ

গোলাম সোহরাওয়ার্দি
  • আপডেট সময় : ০৭:০১:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
  • / 228
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। বহু দশক ধরে দেশের ইতিহাসকে তারা আকার দিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব ছিল তাদের। চল্লিশ বছরের বেশি সময় রাজনীতিতে আধিপত্যও করেছে তারা। তাদের একটা গভীর ছাপ রাজনীতিতে আছে।

একসময় স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মানুষ তাদের গ্রহণ করেছিল। এখন তারা পড়েছে কঠিন সমালোচনার মুখে। তাদের বৈধতা নিয়েই এখন মানুষ প্রশ্ন তুলেছে। এই নিবন্ধে আওয়ামী লীগের এই রূপান্তরকে খতিয়ে দেখা হয়েছে। মুক্তির আন্দোলন থেকে কীভাবে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অশুভ শক্তি হয়ে উঠল, সেটাই এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

তাদের শাসনে গণতন্ত্রের কীভাবে অধঃপতন হলো, বিদেশিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে কীভাবে হতাশার বিস্তার হলো, সেটার বিশ্লেষণ থাকবে এখানে। এই কঠিন যাত্রাপথে আমরা দেখতে পাব, কীভাবে এককালের বড় একটি দল শেষ পর্যন্ত একটি কর্তৃত্ববাদী শক্তি হয়ে উঠল, যে ধরনের শক্তির বিরুদ্ধে তারা নিজেরাই একসময় লড়েছিল। আমরা এটাও খতিয়ে দেখব, নতুন নেতৃত্বের অধীনে বাংলাদেশ কীভাবে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারবে।

একটি অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা

সহিংস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা এবং শিক্ষার্থীরা বিশাল ত্যাগ স্বীকার করেছে। আনুষ্ঠানিক বয়ানে দাবি করা হয়, এই যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে, বিবিসির সিরাজুর রহমানের মতো সাংবাদিকদের হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল তিন লাখের মতো। এই বিতর্কের আজও অবসান হয়নি। তারপরও এই যুদ্ধের বেদনা আর ক্ষতি অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।

শেখ মুজিবুর রহমান, যাকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তিনি ছিলেন এই যুদ্ধের প্রধান চরিত্র। যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে ছিলেন তিনি। তাকে তাই সরাসরি যুদ্ধ করতে হয়নি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যখন তিনি ফিরে আসেন, তখন জনগণ তাকে বীরের মর্যাদা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল। নতুন জাতি তখন গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম এবং মুক্তির স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো দ্রুত খানখান হয়ে যায়।

যুদ্ধের পর মুজিব সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে। ১৯৭৫ সালে তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়। স্বাধীন মিডিয়াগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। এই পদক্ষেপ বহুত্ববাদী সমাজের আশাকে গুঁড়িয়ে দেয়। পার্লামেন্ট হয়ে পড়ে ক্ষমতাহীন। ঐক্যের অজুহাতে নাগরিক অধিকারকে সংকুচিত করা হয়।

সমালোচকরা বলেন, বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সেটাই শুরু। মুজিবের কর্মকাণ্ড এমন একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করে, যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তার মেয়ে শেখ হাসিনাও পরে একই পথে হেঁটেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ তাদের থেকে অনেক আগেই হারিয়ে যায়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই ধারাটা এখনো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেছেন শেখ হাসিনা। তার বাবার মডেলকে তিনি আরো জোরদার করেছেন। সরকারের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপ্তি আরো বাড়িয়েছেন। বিচার বিভাগকে তিনি দুর্বল করে দিয়েছেন। নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তার শাসন আর বাকশালের যুগের মধ্যে অনেকেই সাদৃশ্য খুঁজে পান। এই ধারায় শক্তিশালী, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার একটা পারিবারিক ঐতিহ্য ফুটে উঠেছে, যে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের জন্মের সময়।

গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের ১৫ বছর

শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের শাসনকাল ছিল গণতন্ত্রের জন্য একটা অন্ধকার সময়। তার সরকার সাংবিধানিক সুরক্ষার জায়গাগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংস করেছে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচন কোনোভাবেই আর অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। ভোট কারচুপি, হুমকি এবং বিরোধী পক্ষের ওপর হামলার বিষয়গুলো অতি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছিল।

তার সরকার বর্বরতার জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তার আমলে এলিট বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) বহু বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গ্রুপ পরে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিল। বহু অ্যাকটিভিস্ট, সাংবাদিক এবং সরকারের সমালোচক তার আমলে নিখোঁজ হয়ে গেছে অথবা রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা যে গোপন বন্দিশালা বানিয়েছিল, এখন সেটাকে মানুষ আয়নাঘর নামে চেনে। এই বন্দিশালায় বহু মানুষকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতন করা হতো। এই আয়নাঘর আওয়ামী সরকারের নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বাকস্বাধীনতা আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভীষণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। সরকারের সমালোচক সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে অথবা দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। সমালোচকদের কণ্ঠস্বর চেপে ধরতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন গ্রুপের ওপর কঠোর নজরদারি করা হয়েছে। শ্রমিক ইউনিয়ন এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর ওপর বর্বর সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়েছে।

ভারতের সঙ্গে হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তিনি অর্থনৈতিক সহযোগিতা আর আঞ্চলিক সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, তার স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোয় ভারতকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ভারতকে তিনি মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিয়েছেন। ভারতকে বাংলাদেশের রেলওয়ে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, তিস্তা ও পদ্মা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিবাদ জিইয়ে রেখেছেন তিনি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের নাক গলানোর কারণে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। ২০১৩ সালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করেছিলেন। তিনি সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। অনেকেই বলেছেন, ওই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ২০০৮ সাল থেকে ভারত হাসিনা সরকারকে যেভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে, তাতে মনে হয়েছে তারা বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে, কোনো বন্ধুর মতো আচরণ তারা করেনি।

বহু বাংলাদেশি মনে করেন ভারত বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বন্দর সুবিধা এবং জ্বালানি করিডোরের মতো প্রকল্পগুলো ভারতকে অনেক বেশি সুবিধা দিয়েছে। এই চুক্তিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনমতের কোনো প্রতিফলন ছিল না। এমনকি অনেক চুক্তি পার্লামেন্টেও যাচাই-বাছাই করা হয়নি। জনরোষ এতে আরো বেড়ে গেছে।

ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা গল্প প্রচারের অভিযোগও করেছেন অনেকে। ভারতীয় মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদদের অনেকে দাবি করেছেন, বাংলাদেশ ইসলামি চরমপন্থার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সমালোচকরা বলেছেন, এই দাবিগুলো অতিরঞ্জিত। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান এবং মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে এর মাধ্যমে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক জনমতকে বাংলাদেশের বিপক্ষে নেওয়ার জন্যই এগুলো করা হচ্ছে।

ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগও উঠেছে। সাবেক কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিছু রাজনীতিবিদ ভারতের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ভারতের লক্ষ্য হাসিলের জন্য তারা রাজনীতি সাজিয়েছেন। এ ধরনের তৎপরতা ভারতবিদ্বেষী মনোভাব উসকে দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থাও এতে কমে গেছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নিজেদের বেশি প্রতারিত মনে করে। ভারতের কর্মকাণ্ডকে তারা এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ হিসেবে দেখে, অংশীদারত্ব হিসেবে নয়। এই ক্ষোভের সঙ্গে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য আর অর্থনৈতিক সংগ্রাম যুক্ত হয়ে নতুন একটা জাতীয়তাবাদী ঢেউয়ের জন্ম হয়েছে। এই ঢেউই আবার গণতন্ত্রের জন্য জোয়ার তৈরি করেছে।

সেনাবাহিনী আনুগত্যে বিভক্তি : রক্ষকদের প্রতি জাতির প্রশ্ন

২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা অস্পষ্ট ও বিতর্কিত। সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। অনেকে অভিযোগ করেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের ৬২৬ জন নেতাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। তিনি সামরিক ঘাঁটিগুলোয় তাদের আশ্রয় দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এই সংকটকালীন সময়ে তারা বিচার এড়িয়ে বিদেশে পালানোর সুযোগ পেয়েছেন। প্রথম দিকে জেনারেল ওয়াকার হাসিনার আদেশ অনুসরণ করেছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু বিক্ষোভ যখন বাড়তে থাকল, তখন বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করতে বলা হয় তাকে। তখন সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়।

মাঝারি স্তরের কর্মকর্তাদের অনেকেরই তরুণ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তারা বেসামরিক জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেন। সামরিক বাহিনীর ঐক্য এতে ভেঙে পড়ে। জেনারেল ওয়াকারের কর্তৃত্বও দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকেই এটাকে বিভাজন হিসেবে দেখেছেন। সাধারণ সেনারা মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু শীর্ষ নেতারা রাজনীতিবিদদের অনুগত ছিলেন বলে মনে হয়। জনগণ এখন দেখতে পাচ্ছেন, জেনারেল ওয়াকার ছাড় দিয়েছিলেন। কেউ কেউ এমনটাও দাবি করেছেন, বিদেশি স্বার্থ, বিশেষ করে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন ওয়াকার।

জর্জ অরওয়েল বলেছেন, ‘একটা প্রতারণার মুহূর্তে সত্য বলাটাও একটা বিপ্লবী কাজ।’ বাংলাদেশিদের জন্য সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সত্য জানাটা ছিল যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু সেটার দরকার ছিল। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল জাতিকে রক্ষা করা। তারা যেসব কাজ করেছেন, সেগুলো খতিয়ে দেখার জন্য এখন স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের মধ্যে সংস্কারের দাবি উঠেছে।

আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ

অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। কারণ হিসেবে তারা এই দলের সহিংসতার ইতিহাস উল্লেখ করেছে। অতীতের ভুলের নিন্দা জানাতে তাদের অস্বীকৃতির বিষয়টি তুলে ধরেছে। দলের রাজনৈতিক নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতের নির্বাচনে তারা অংশ নিতে পারবে না। কেউ কেউ উদ্বেগ জানিয়েছেন, এতে গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ক্ষতি হবে। তবে সরকার বলেছে, স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য এটা প্রয়োজন ছিল। ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন’ গঠনের পরিকল্পনার কথাও শোনা গেছে। জাতির পুরোনো ক্ষত মেরামত ও আস্থা পুনর্গঠনের জন্য এই কমিশন সাহায্য করতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ফাটলরেখা

বাংলাদেশের সমস্যার সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি জড়িয়ে আছে। ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বিভিন্ন শক্তির টার্গেটে পরিণত করেছে। বার্মা অ্যাক্টের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী শক্তিকে সমর্থন দিচ্ছে। চীন ও রাশিয়াও এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এখানে একটা জটিল বৈশ্বিক খেলায় আটকা পড়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত অবশ্যই এখানে তাৎপর্য বহন করে।

মিজোরামের মতো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বাংলাদেশ সমস্যায় পড়লে এই পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। ঢাকাকে অবশ্যই একটা স্মার্ট পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করাতে হবে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। কোনো শক্তির ফাঁদে পড়লে তাদের চলবে না।

আগামীর পথ নির্ধারণ

বাংলাদেশ একটা বাঁকবদলের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। এর অর্থ হলো ছোটখাটো পরিবর্তন দিয়ে কাজ হবে না। দেশের সুশাসনব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তার পুরোটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। স্বচ্ছতা, অন্তর্ভুক্তি এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে এই কাজ এগিয়ে নিতে হবে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগণকে সেবা দেওয়া, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা নয়। নির্বাচনকে অবশ্যই সুষ্ঠু হতে হবে। সেখানে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক থাকতে হবে। নাগরিক অধিকার অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সেটা প্রতিশোধের জন্য নয়, বরং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং জাতির ক্ষত মেরামতের জন্য।

ঐক্য এখানে মূল চাবিকাঠি। বাংলাদেশিরা অকল্পনীয় সাহস দেখিয়েছেন। তারা সহিংসতা, মিথ্যা এবং বহু দশকের দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন। নিজেদের অধিকারের দাবিতে এবং ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে তারা লড়াই করেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের তাদের কথা অবশ্যই শুনতে হবে। তাদের শক্তি জোগাতে হবে। তাদের সেবা দিতে হবে।

বিশ্বকে অবশ্যই এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আর গণতান্ত্রিক যে মূল্যবোধ, সেটাকে সমর্থন দিতে হবে। এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ানো চলবে না। বাংলাদেশ যেভাবে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেভাবেই তারা গণতান্ত্রিক চেতনাও ফিরিয়ে আনতে পারবে। অন্যদেরও তারা উজ্জীবিত করতে পারবে। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘কোনো কাজ না হওয়া পর্যন্ত সবসময়ই সেটা অসম্ভব মনে হতে থাকে।’ এখন সময়টা বাংলাদেশের।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাউথ এশিয়া জার্নালের প্রকাশক

সূত্র: দৈনিক আমার দেশ

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

স্বাধীনতার সঙ্গে বেঈমানি ও আওয়ামী লীগ

আপডেট সময় : ০৭:০১:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। বহু দশক ধরে দেশের ইতিহাসকে তারা আকার দিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব ছিল তাদের। চল্লিশ বছরের বেশি সময় রাজনীতিতে আধিপত্যও করেছে তারা। তাদের একটা গভীর ছাপ রাজনীতিতে আছে।

একসময় স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মানুষ তাদের গ্রহণ করেছিল। এখন তারা পড়েছে কঠিন সমালোচনার মুখে। তাদের বৈধতা নিয়েই এখন মানুষ প্রশ্ন তুলেছে। এই নিবন্ধে আওয়ামী লীগের এই রূপান্তরকে খতিয়ে দেখা হয়েছে। মুক্তির আন্দোলন থেকে কীভাবে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অশুভ শক্তি হয়ে উঠল, সেটাই এখানে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

তাদের শাসনে গণতন্ত্রের কীভাবে অধঃপতন হলো, বিদেশিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে কীভাবে হতাশার বিস্তার হলো, সেটার বিশ্লেষণ থাকবে এখানে। এই কঠিন যাত্রাপথে আমরা দেখতে পাব, কীভাবে এককালের বড় একটি দল শেষ পর্যন্ত একটি কর্তৃত্ববাদী শক্তি হয়ে উঠল, যে ধরনের শক্তির বিরুদ্ধে তারা নিজেরাই একসময় লড়েছিল। আমরা এটাও খতিয়ে দেখব, নতুন নেতৃত্বের অধীনে বাংলাদেশ কীভাবে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারবে।

একটি অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা

সহিংস মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা এবং শিক্ষার্থীরা বিশাল ত্যাগ স্বীকার করেছে। আনুষ্ঠানিক বয়ানে দাবি করা হয়, এই যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে, বিবিসির সিরাজুর রহমানের মতো সাংবাদিকদের হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল তিন লাখের মতো। এই বিতর্কের আজও অবসান হয়নি। তারপরও এই যুদ্ধের বেদনা আর ক্ষতি অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।

শেখ মুজিবুর রহমান, যাকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তিনি ছিলেন এই যুদ্ধের প্রধান চরিত্র। যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে ছিলেন তিনি। তাকে তাই সরাসরি যুদ্ধ করতে হয়নি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যখন তিনি ফিরে আসেন, তখন জনগণ তাকে বীরের মর্যাদা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল। নতুন জাতি তখন গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম এবং মুক্তির স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো দ্রুত খানখান হয়ে যায়।

যুদ্ধের পর মুজিব সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে। ১৯৭৫ সালে তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করে। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দেয়। স্বাধীন মিডিয়াগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করে দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। এই পদক্ষেপ বহুত্ববাদী সমাজের আশাকে গুঁড়িয়ে দেয়। পার্লামেন্ট হয়ে পড়ে ক্ষমতাহীন। ঐক্যের অজুহাতে নাগরিক অধিকারকে সংকুচিত করা হয়।

সমালোচকরা বলেন, বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সেটাই শুরু। মুজিবের কর্মকাণ্ড এমন একটা সরকার প্রতিষ্ঠা করে, যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তার মেয়ে শেখ হাসিনাও পরে একই পথে হেঁটেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ তাদের থেকে অনেক আগেই হারিয়ে যায়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই ধারাটা এখনো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেছেন শেখ হাসিনা। তার বাবার মডেলকে তিনি আরো জোরদার করেছেন। সরকারের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপ্তি আরো বাড়িয়েছেন। বিচার বিভাগকে তিনি দুর্বল করে দিয়েছেন। নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তার শাসন আর বাকশালের যুগের মধ্যে অনেকেই সাদৃশ্য খুঁজে পান। এই ধারায় শক্তিশালী, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার একটা পারিবারিক ঐতিহ্য ফুটে উঠেছে, যে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের জন্মের সময়।

গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের ১৫ বছর

শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের শাসনকাল ছিল গণতন্ত্রের জন্য একটা অন্ধকার সময়। তার সরকার সাংবিধানিক সুরক্ষার জায়গাগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংস করেছে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং রাষ্ট্রীয় মিডিয়া ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচন কোনোভাবেই আর অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। ভোট কারচুপি, হুমকি এবং বিরোধী পক্ষের ওপর হামলার বিষয়গুলো অতি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছিল।

তার সরকার বর্বরতার জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তার আমলে এলিট বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) বহু বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িয়েছিল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গ্রুপ পরে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিল। বহু অ্যাকটিভিস্ট, সাংবাদিক এবং সরকারের সমালোচক তার আমলে নিখোঁজ হয়ে গেছে অথবা রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা যে গোপন বন্দিশালা বানিয়েছিল, এখন সেটাকে মানুষ আয়নাঘর নামে চেনে। এই বন্দিশালায় বহু মানুষকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতন করা হতো। এই আয়নাঘর আওয়ামী সরকারের নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বাকস্বাধীনতা আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভীষণভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। সরকারের সমালোচক সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে অথবা দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। সমালোচকদের কণ্ঠস্বর চেপে ধরতে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন গ্রুপের ওপর কঠোর নজরদারি করা হয়েছে। শ্রমিক ইউনিয়ন এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর ওপর বর্বর সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়েছে।

ভারতের সঙ্গে হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠতা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তিনি অর্থনৈতিক সহযোগিতা আর আঞ্চলিক সম্পর্কের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, তার স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোয় ভারতকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ভারতকে তিনি মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিয়েছেন। ভারতকে বাংলাদেশের রেলওয়ে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, তিস্তা ও পদ্মা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বিবাদ জিইয়ে রেখেছেন তিনি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের নাক গলানোর কারণে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। ২০১৩ সালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করেছিলেন। তিনি সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। অনেকেই বলেছেন, ওই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ২০০৮ সাল থেকে ভারত হাসিনা সরকারকে যেভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে, তাতে মনে হয়েছে তারা বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে, কোনো বন্ধুর মতো আচরণ তারা করেনি।

বহু বাংলাদেশি মনে করেন ভারত বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বন্দর সুবিধা এবং জ্বালানি করিডোরের মতো প্রকল্পগুলো ভারতকে অনেক বেশি সুবিধা দিয়েছে। এই চুক্তিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনমতের কোনো প্রতিফলন ছিল না। এমনকি অনেক চুক্তি পার্লামেন্টেও যাচাই-বাছাই করা হয়নি। জনরোষ এতে আরো বেড়ে গেছে।

ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা গল্প প্রচারের অভিযোগও করেছেন অনেকে। ভারতীয় মিডিয়া এবং রাজনীতিবিদদের অনেকে দাবি করেছেন, বাংলাদেশ ইসলামি চরমপন্থার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সমালোচকরা বলেছেন, এই দাবিগুলো অতিরঞ্জিত। ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান এবং মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে এর মাধ্যমে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক জনমতকে বাংলাদেশের বিপক্ষে নেওয়ার জন্যই এগুলো করা হচ্ছে।

ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগও উঠেছে। সাবেক কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিছু রাজনীতিবিদ ভারতের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ভারতের লক্ষ্য হাসিলের জন্য তারা রাজনীতি সাজিয়েছেন। এ ধরনের তৎপরতা ভারতবিদ্বেষী মনোভাব উসকে দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থাও এতে কমে গেছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নিজেদের বেশি প্রতারিত মনে করে। ভারতের কর্মকাণ্ডকে তারা এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ হিসেবে দেখে, অংশীদারত্ব হিসেবে নয়। এই ক্ষোভের সঙ্গে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য আর অর্থনৈতিক সংগ্রাম যুক্ত হয়ে নতুন একটা জাতীয়তাবাদী ঢেউয়ের জন্ম হয়েছে। এই ঢেউই আবার গণতন্ত্রের জন্য জোয়ার তৈরি করেছে।

সেনাবাহিনী আনুগত্যে বিভক্তি : রক্ষকদের প্রতি জাতির প্রশ্ন

২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা অস্পষ্ট ও বিতর্কিত। সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন। অনেকে অভিযোগ করেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের ৬২৬ জন নেতাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। তিনি সামরিক ঘাঁটিগুলোয় তাদের আশ্রয় দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এই সংকটকালীন সময়ে তারা বিচার এড়িয়ে বিদেশে পালানোর সুযোগ পেয়েছেন। প্রথম দিকে জেনারেল ওয়াকার হাসিনার আদেশ অনুসরণ করেছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু বিক্ষোভ যখন বাড়তে থাকল, তখন বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করতে বলা হয় তাকে। তখন সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়।

মাঝারি স্তরের কর্মকর্তাদের অনেকেরই তরুণ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তারা বেসামরিক জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেন। সামরিক বাহিনীর ঐক্য এতে ভেঙে পড়ে। জেনারেল ওয়াকারের কর্তৃত্বও দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকেই এটাকে বিভাজন হিসেবে দেখেছেন। সাধারণ সেনারা মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু শীর্ষ নেতারা রাজনীতিবিদদের অনুগত ছিলেন বলে মনে হয়। জনগণ এখন দেখতে পাচ্ছেন, জেনারেল ওয়াকার ছাড় দিয়েছিলেন। কেউ কেউ এমনটাও দাবি করেছেন, বিদেশি স্বার্থ, বিশেষ করে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন ওয়াকার।

জর্জ অরওয়েল বলেছেন, ‘একটা প্রতারণার মুহূর্তে সত্য বলাটাও একটা বিপ্লবী কাজ।’ বাংলাদেশিদের জন্য সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সত্য জানাটা ছিল যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু সেটার দরকার ছিল। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল জাতিকে রক্ষা করা। তারা যেসব কাজ করেছেন, সেগুলো খতিয়ে দেখার জন্য এখন স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের মধ্যে সংস্কারের দাবি উঠেছে।

আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ

অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। কারণ হিসেবে তারা এই দলের সহিংসতার ইতিহাস উল্লেখ করেছে। অতীতের ভুলের নিন্দা জানাতে তাদের অস্বীকৃতির বিষয়টি তুলে ধরেছে। দলের রাজনৈতিক নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতের নির্বাচনে তারা অংশ নিতে পারবে না। কেউ কেউ উদ্বেগ জানিয়েছেন, এতে গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ক্ষতি হবে। তবে সরকার বলেছে, স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য এটা প্রয়োজন ছিল। ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন’ গঠনের পরিকল্পনার কথাও শোনা গেছে। জাতির পুরোনো ক্ষত মেরামত ও আস্থা পুনর্গঠনের জন্য এই কমিশন সাহায্য করতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ফাটলরেখা

বাংলাদেশের সমস্যার সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি জড়িয়ে আছে। ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বিভিন্ন শক্তির টার্গেটে পরিণত করেছে। বার্মা অ্যাক্টের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী শক্তিকে সমর্থন দিচ্ছে। চীন ও রাশিয়াও এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এখানে একটা জটিল বৈশ্বিক খেলায় আটকা পড়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত অবশ্যই এখানে তাৎপর্য বহন করে।

মিজোরামের মতো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বাংলাদেশ সমস্যায় পড়লে এই পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। ঢাকাকে অবশ্যই একটা স্মার্ট পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করাতে হবে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। কোনো শক্তির ফাঁদে পড়লে তাদের চলবে না।

আগামীর পথ নির্ধারণ

বাংলাদেশ একটা বাঁকবদলের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। এর অর্থ হলো ছোটখাটো পরিবর্তন দিয়ে কাজ হবে না। দেশের সুশাসনব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তার পুরোটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। স্বচ্ছতা, অন্তর্ভুক্তি এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে এই কাজ এগিয়ে নিতে হবে।

গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগণকে সেবা দেওয়া, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা নয়। নির্বাচনকে অবশ্যই সুষ্ঠু হতে হবে। সেখানে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক থাকতে হবে। নাগরিক অধিকার অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সেটা প্রতিশোধের জন্য নয়, বরং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং জাতির ক্ষত মেরামতের জন্য।

ঐক্য এখানে মূল চাবিকাঠি। বাংলাদেশিরা অকল্পনীয় সাহস দেখিয়েছেন। তারা সহিংসতা, মিথ্যা এবং বহু দশকের দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়েছেন। নিজেদের অধিকারের দাবিতে এবং ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে তারা লড়াই করেছেন। রাজনৈতিক নেতাদের তাদের কথা অবশ্যই শুনতে হবে। তাদের শক্তি জোগাতে হবে। তাদের সেবা দিতে হবে।

বিশ্বকে অবশ্যই এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আর গণতান্ত্রিক যে মূল্যবোধ, সেটাকে সমর্থন দিতে হবে। এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ানো চলবে না। বাংলাদেশ যেভাবে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেভাবেই তারা গণতান্ত্রিক চেতনাও ফিরিয়ে আনতে পারবে। অন্যদেরও তারা উজ্জীবিত করতে পারবে। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘কোনো কাজ না হওয়া পর্যন্ত সবসময়ই সেটা অসম্ভব মনে হতে থাকে।’ এখন সময়টা বাংলাদেশের।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাউথ এশিয়া জার্নালের প্রকাশক

সূত্র: দৈনিক আমার দেশ