ঢাকা ০৪:১৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

নাহিয়ান: সফেদ ঘুড়ি উড়ে গেলো নীলাকাশে

এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম
  • আপডেট সময় : ০৯:১৬:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫
  • / 148
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আমাদের সফেদ ঘুড়িটা নীলাকাশে উড়ে গেলো। আর ফেরা হবেনা তার। একসময় নাটাইয়ের সাথে সুতা দিয়ে বাঁধা সাদা ঘুড়িটা নীলাকাশে উড়তো। দোলা দিতো। আনন্দ দিতো। গতকাল সেই ঘুড়িটা সুতা ছিড়ে চিরদিনের মতো উড়াল দিলো আকাশে, নীল আকাশে, অনন্ত অসীমে, চাঁদের দেশে, জান্নাতের অনন্ত জীবনে। আমাদের মায়ার বাঁধনগুলো এভাবেই সুতার মতো একদিন ছিড়ে যায়। আর চলে যেতে হয় জীবন ঘুড়ির প্রকৃত নাটাই যার হাতে, সেই মহান রবের কাছে।

মুত্যু চিরন্তন, অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। তেমনি এক মৃত্যু আমাদের ভাতিজা নাহিয়ানের।

নাহিয়ানের বয়স ১২ বছর। সিলেটের স্কলার্সহোম শিবগঞ্জ শাখার ৫ম শ্রেণীর ছাত্র। চটপটে অথচ নম্র ও ভদ্র। সদা হাসিখুশি, চঞ্চল। কথা ও আচরনে মুগ্ধতা ছড়াতো। ঘুড়ি উড়ানো তার শখ। চোখে মুখে মননে তার আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। কে জানতো! এই ঘুড়ি উড়ানোই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে।

গতকাল ০৯ মে ২০২৫ শুক্রবার বিকেলে সিলেট নগরীর যতরপুরের ৭তলা বাসার ছাদে সাথীদের নিয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল নাহিয়ান। এসময় অসাবধানতাবশত সে উপর থেকে নিচে পড়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে জরুরী ভিত্তিতে নগরীর ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র একটু চিন্তা করলে আমাদেরকে আঁৎকে উঠতে হবে! চোখ বুঝে একটু কল্পনা করি- একটি ছোট্ট ছেলে বাসার সাততলা ছাদে খেলছে, হাসছে, ঘুড়ি উড়াচ্ছে, আনন্দ করছে! হঠাৎ করে ছাদ থেকে পড়ে গেলো, পড়ছে,,, পড়ছে,,, অতঃপর একেবারে নিচে পড়ে গেলো,,,, উফ! সহ্য করার মতো নয়!

অ্যাডভোকেট দিলোয়ার হোসেন শামীম মৃত নাহিয়ানের বাবা। তিনি সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারী ও শাবিপ্রবি শাখার সাবেক সভাপতি। সিলেট বারের সুদক্ষ আইনজীবী।

নাহিয়ানের বাবা মা’র অঝোরে কান্না আর স্বজনদের আহাজারি আকাশ বাতাসকে ভারী করে তুলছিল। বিশেষ করে ছেলের জানাজা পূর্ব বক্তব্যে আমার শামীম বলেছিল, আল্লাহ! ছাত্র জীবন থেকে অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি, কিন্তু আজকের এই পরীক্ষা অনেক বড় কঠিন। এই কঠিন পরীক্ষায় ধৈর্য্য ধারনের শক্তি দাও।

সুনামগঞ্জ সদরের বুড়িস্থল মড়লবাড়ী নিবাসি অ্যাডভোকেট শামীম বার কয়েক কারাবরণ করেছেন। তার ছেলে নাহিয়ানের জন্মের সময়ও তিনি জেলে ছিলেন। দুর্ঘটনার সময়ও বাসায় ছিলেন না। অথচ মাঝখানের জীবনে বাবার সাথেই তার ইনটিমিসি, ঘনিষ্ঠতা, মিথস্ক্রিয়া, মান অভিমান, ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি ছিল। আহা! কি বিচিত্র জীবন!

বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ! এটি দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী জিনিস। ছেলের জানাজায় ইমামতি করলেন বাবা। এরপর দাফনের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ছেলের দাফনের সময় পিতা শামীমকে দৃঢ়চেতা এক মানব মনে হলো। কবরে নামলেন। পরম মমতায় ছেলের লাশ নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিলেন, যেন ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। কবর থেকে উঠে দাফন শেষে শামীম মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন: হে আল্লাহ! তুমি অনুগ্রহ করে নাহিয়ানকে দিয়েছিলে, আবার তোমার ইচ্ছায় নিয়ে গেছো। তোমার অনুগ্রহ ও ইচ্ছায় আমরা সন্তোষ্ট। আলহামদুলিল্লাহ। উফ!! তার কান্না আমাদের হৃদয়টা খান খান করে দিচ্ছিলো।

আজ ১০ মে সকাল ১০ টায় শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুল এন্ড কলেজ (মিরাবাজার) মাঠে নাহিয়ানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর থাকে মানিকপীর র. কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ছোট্ট ছেলে নাহিয়ানের দুর্ঘটনাজনিত হৃদয়বিদারক মৃত্যু মেনে নেয়া যে কারো জন্য কষ্টকর। তথাপি আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘সব প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ তাই চির অবধারিত মৃত্যুকে আমাদের মেনে নিতে হয়।

মহান আল্লাহ পাক মরহুম নাহিয়ানের মা-বাবাসহ স্বজনদের এই শোক সইবার শক্তি দিন ও তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকামের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।
আমীন।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস : আমার সুনামগঞ্জ | Amar Sunamganj

নাহিয়ান: সফেদ ঘুড়ি উড়ে গেলো নীলাকাশে

আপডেট সময় : ০৯:১৬:০১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫

আমাদের সফেদ ঘুড়িটা নীলাকাশে উড়ে গেলো। আর ফেরা হবেনা তার। একসময় নাটাইয়ের সাথে সুতা দিয়ে বাঁধা সাদা ঘুড়িটা নীলাকাশে উড়তো। দোলা দিতো। আনন্দ দিতো। গতকাল সেই ঘুড়িটা সুতা ছিড়ে চিরদিনের মতো উড়াল দিলো আকাশে, নীল আকাশে, অনন্ত অসীমে, চাঁদের দেশে, জান্নাতের অনন্ত জীবনে। আমাদের মায়ার বাঁধনগুলো এভাবেই সুতার মতো একদিন ছিড়ে যায়। আর চলে যেতে হয় জীবন ঘুড়ির প্রকৃত নাটাই যার হাতে, সেই মহান রবের কাছে।

মুত্যু চিরন্তন, অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। তেমনি এক মৃত্যু আমাদের ভাতিজা নাহিয়ানের।

নাহিয়ানের বয়স ১২ বছর। সিলেটের স্কলার্সহোম শিবগঞ্জ শাখার ৫ম শ্রেণীর ছাত্র। চটপটে অথচ নম্র ও ভদ্র। সদা হাসিখুশি, চঞ্চল। কথা ও আচরনে মুগ্ধতা ছড়াতো। ঘুড়ি উড়ানো তার শখ। চোখে মুখে মননে তার আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। কে জানতো! এই ঘুড়ি উড়ানোই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে।

গতকাল ০৯ মে ২০২৫ শুক্রবার বিকেলে সিলেট নগরীর যতরপুরের ৭তলা বাসার ছাদে সাথীদের নিয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল নাহিয়ান। এসময় অসাবধানতাবশত সে উপর থেকে নিচে পড়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে জরুরী ভিত্তিতে নগরীর ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র একটু চিন্তা করলে আমাদেরকে আঁৎকে উঠতে হবে! চোখ বুঝে একটু কল্পনা করি- একটি ছোট্ট ছেলে বাসার সাততলা ছাদে খেলছে, হাসছে, ঘুড়ি উড়াচ্ছে, আনন্দ করছে! হঠাৎ করে ছাদ থেকে পড়ে গেলো, পড়ছে,,, পড়ছে,,, অতঃপর একেবারে নিচে পড়ে গেলো,,,, উফ! সহ্য করার মতো নয়!

অ্যাডভোকেট দিলোয়ার হোসেন শামীম মৃত নাহিয়ানের বাবা। তিনি সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরের সাবেক সেক্রেটারী ও শাবিপ্রবি শাখার সাবেক সভাপতি। সিলেট বারের সুদক্ষ আইনজীবী।

নাহিয়ানের বাবা মা’র অঝোরে কান্না আর স্বজনদের আহাজারি আকাশ বাতাসকে ভারী করে তুলছিল। বিশেষ করে ছেলের জানাজা পূর্ব বক্তব্যে আমার শামীম বলেছিল, আল্লাহ! ছাত্র জীবন থেকে অসংখ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি, কিন্তু আজকের এই পরীক্ষা অনেক বড় কঠিন। এই কঠিন পরীক্ষায় ধৈর্য্য ধারনের শক্তি দাও।

সুনামগঞ্জ সদরের বুড়িস্থল মড়লবাড়ী নিবাসি অ্যাডভোকেট শামীম বার কয়েক কারাবরণ করেছেন। তার ছেলে নাহিয়ানের জন্মের সময়ও তিনি জেলে ছিলেন। দুর্ঘটনার সময়ও বাসায় ছিলেন না। অথচ মাঝখানের জীবনে বাবার সাথেই তার ইনটিমিসি, ঘনিষ্ঠতা, মিথস্ক্রিয়া, মান অভিমান, ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি ছিল। আহা! কি বিচিত্র জীবন!

বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ! এটি দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী জিনিস। ছেলের জানাজায় ইমামতি করলেন বাবা। এরপর দাফনের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ছেলের দাফনের সময় পিতা শামীমকে দৃঢ়চেতা এক মানব মনে হলো। কবরে নামলেন। পরম মমতায় ছেলের লাশ নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিলেন, যেন ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। কবর থেকে উঠে দাফন শেষে শামীম মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন: হে আল্লাহ! তুমি অনুগ্রহ করে নাহিয়ানকে দিয়েছিলে, আবার তোমার ইচ্ছায় নিয়ে গেছো। তোমার অনুগ্রহ ও ইচ্ছায় আমরা সন্তোষ্ট। আলহামদুলিল্লাহ। উফ!! তার কান্না আমাদের হৃদয়টা খান খান করে দিচ্ছিলো।

আজ ১০ মে সকাল ১০ টায় শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া স্কুল এন্ড কলেজ (মিরাবাজার) মাঠে নাহিয়ানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর থাকে মানিকপীর র. কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ছোট্ট ছেলে নাহিয়ানের দুর্ঘটনাজনিত হৃদয়বিদারক মৃত্যু মেনে নেয়া যে কারো জন্য কষ্টকর। তথাপি আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘সব প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ তাই চির অবধারিত মৃত্যুকে আমাদের মেনে নিতে হয়।

মহান আল্লাহ পাক মরহুম নাহিয়ানের মা-বাবাসহ স্বজনদের এই শোক সইবার শক্তি দিন ও তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকামের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।
আমীন।