নজির হোসেন একটা গৌরবের ইতিহাস

- আপডেট সময় : ০৩:৪২:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ১৭১ বার পড়া হয়েছে
একে কুদরত পাশা
নজির হোসেন বাংলাদেশের একজন আলোচিত রাজনিতিবিদ। তিনি জাতীয় সংসদের ২২৪নং আসন সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর) থেকে ১৯৯১ সালে সিপিবি থেকে এ আসনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ১৫ অক্টোবর ১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগদান করেন। পরে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বার ও ২০০১ সালে তৃতীয়বারের মতো বিএনপি থেকে একই আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, ১০ বছর সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, ৫ বছর জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
নজির হোসেন ১৯৪৯ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শাহপুর গ্রামে মোঃ আব্দুল গণী ও সুয়েতুন নেছার ঔরসে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এটি ঐতিহাসিক লাউর রাজ্যে কাগজী পরিবার নামে খ্যাত এক ঐতিহ্যবাহী ও সম্ভ্রান্ত বংশ। পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত অত্র পরিবার তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। বাবা ছিলেন একজন ধার্মিক মৌলানা এবং ছোট ঔষধ ব্যবসায়ী। নজির হোসেনের পত্নী সালমা আক্তার একজন ব্যাংকার।
শিশুকাল থেকেই নজির হোসেন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, যার প্রথম জানান দেন পঞ্চম শ্রেণিতে স্কলারশিপ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বৃত্তি পেয়ে। দারিদ্রের কারণে সেই বাল্যকাল থেকেই টিউশনী করে পড়াশুনা চালিয়ে যান। অষ্টম শ্রেণি পাশের পর বাবা আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশুনা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মা ছিলেন ছেলের পড়াশুনার পক্ষে, মায়ের কাছ থেকে চার আনা পয়সা চেয়ে নিয়ে সেই ১৯৫৭ সালে ভাগ্য এবং নিজের দৃঢ় মনোবলের উপর নির্ভর করে বাড়ি থেকে অজানার পথে বেরিয়ে পড়েন।
নজির হোসেন ১৯৬৩ ইং সনে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পাশ করেন। সে সময়ে প্রথম বিভাগ একমাত্র অনন্য মেধাবী ও চরম অধ্যবসায়ী ছাত্রেরাই পেতেন। অতঃপর সিলেট এম.সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় এইচ.এস.সি এবং বি.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গনিত বিভাগে এম.এস.সিতে ভর্তি হন।
ছাত্রাবস্থায় নজির হোসেন ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে গোপন কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করে কঠোর অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও সততার মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে সিলেট জেলা কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য নির্বাচিত হন। ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ৬৯ সালের শেষের দিকে সুনামগঞ্জ জেলা সিপিবির দায়িত্ব লাভ করে দলকে সংগঠিত করতে সুনামগঞ্জ চলে আসেন। সুনামগঞ্জ মহকুমার গোপন কমিউনিষ্ট সেলের প্রধান ছিলেন জনাব নজির হোসেন।
১৯৭১ সালে জুনের প্রথম দিকে শিলং এর সানী হোটেলে কমরেড বরুণ রায়, পীর হাবিবুর রহমান, বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও সরদার লতিফের উপস্থিতিতে গোপন কমিউনিষ্ট পার্টির সিদ্ধান্তের আলোকে টেকেরঘাট সাব সেক্টর একটি গেরিলা যুদ্ধের জোন হিসেবে গড়ে ওঠে। বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত সেক্টর কমাণ্ডার ও নজির হোসেন টেকেরঘাট সাব সেক্টরের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি সুনামগঞ্জ মহকুমা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৪ সালে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে ১৮ মাসব্যাপী রাজনৈতিক পড়াশুনার জন্যে মস্কোতে ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৪ বছর আত্নগোপনে ছিলেন এবং মুস্তাক সরকার বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে সুনামগঞ্জ অঞ্চলের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৫ সালে নিরাপত্তা আইনে ৬ মাস কারাবরণ করেন।
রাজনীতির স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালের ১৫ অক্টোবর বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি প্রথমে সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি পদাধিকারবলে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। বিএনপিতে দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল হিসেবে গণমানুষের নেতা হিসেবে ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কান্ডারি নেতা হিসেবে জনতার রায়ে ১,২৮,৪৪৮ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান শ্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে ৩২,৮৭৪ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বৃহত্তর সিলেট বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে নজির হোসেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন । তিনি ৮ম সংসদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন।
নজির হোসেন বুঝতে পারেন কোথায়, কেন এবং কি করে এই হাওর জনপদকে অন্যান্য এলাকা থেকে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের সিংহভাগ কেটেছে এই অবহেলিত জনপদকে সামনে নিয়ে যেতে। তাঁর সময়ে তিনি মাটির কাজের জন্য গম বরাদ্দ ও টাকার সংস্থান করেছেন। দৃষ্টি নন্দন প্রকল্প, আদর্শ গ্রাম প্রকল্প, কৃষককে ঋণ প্রকল্প, বেহেলী গ্রামের বিশেষ ঋণ প্রকল্প, কৃষিঋণ মওকুফ, গ্রামীণ স্যানিটেশন বাস্তবায়নে অবদান রাখেন। সর্বোপরি এমপি ব্যক্তিত্বকে জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন।
তাঁর প্রজ্ঞা ও মেধা স্থানীয় ও দেশীয় বলয় পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন পলিসিকে বাংলাদেশের অনুকূলে নিয়ে আসতে ব্যাপকভাবে কার্যকরী হয়েছে। যেমন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে দেওয়া তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় সম্ভব হয় ৷ তিনি সৌদি সংসদ এবং বাংলাদেশ সংসদের মধ্যে মৈত্রিবন্ধন স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ শ্রমবাজার অন্বেষণে তিনি সংসদীয় টীম নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বহুদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি স্পেনে অবৈধ বাংলাদেশীদের বৈধ করণে সহায়তা করেন। ৮ম সংসদে বেসরকারি সদস্যদের বিল প্রস্তাব সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অবকাঠামোর ক্ষেত্রে হাওর ডিজাইনটি প্রস্তাব করেন এবং সংসদীয় কমিটিতে পাশ করান। তাঁর একক প্রচেষ্টায় সুনামগঞ্জ জেলায় চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইনড্রাষ্টি অনুমোদন লাভ করে। তিনি রেডক্রস সোসাইটি এবং চেম্বার অব কমার্স সুনামগঞ্জ এর আজীবন সদস্য।
সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকার অর্থনৈতিক জীবনমানের উন্নয়নের জন্য সারা জীবন তিনি জনমনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। হাওরের ফসল রক্ষায় বহুমাত্রিক আন্তরিক প্রচেষ্টা ও বাঁধে বাঁধে পথসভা জনগণের প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। যোগাযোগ, শিক্ষা, হাওর উন্নয়ন (বন্যা নিয়ন্ত্রণ, আগাম বন্যা প্রতিরোধ সহ) কৃষি, শিল্পায়ন, পর্যটন ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারার রূপকল্প সারা নির্বাচনী এলাকার চেহারা একেবারেই পাল্টে দিতে পারে। সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন কৌশল নিয়ে তাঁর গবেষণামূলক লেখা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। অবকাঠামো নদী খনন, অকাল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মৎস্য সম্পদ রক্ষা, পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীব বৈচিত্র্য, শিল্পায়ন, পর্যটন, হাওর জীবনের বেঁচে থাকার কৌশল নিয়ে তাঁর সৃজনশীল গবেষণাধর্মী লেখনী আমাদের জনগণের পাথেয় হয়ে থাকবে। একদিকে তিনি আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, উজবেকিস্তান, ফ্রান্স, ইতালী, স্পেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, আমিরাত সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে বিশ্ব-পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেছেন। যার জন্যে তিনি পরিবর্তনশীল ও বিকশিত জীবনে বিশ্বাসী একজন মানুষ। অপরদিকে অকাল বন্যার সময় বাঁধে পড়ে থাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের পাশে থাকা, জনগণের বিপদ আপদে আর্থিক সাহায্য প্রদান, নির্যাতিতের পাশে দাঁড়ানো, ন্যায় বিচারের পক্ষে থাকা, সকলের টেলিফোন রিসিভ করা, ব্যক্তিগতভাবে মানুষের ঘরে ঘরে যাওয়া, কাজ প্রত্যাশিতদের কাজ করে দেওয়ার আন্তরিকতা, নিরঃঅহংকার, সাদাসিদে জীবন, দুর্নীতি ও অন্যায়ের প্রতি আপোসহীনতা প্রমাণ করে তিনি সব সময় মাটি ও মানুষের আপনজন। এটাই হলো তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার মূর্ত প্রতীক তিনি। সেবাই তাঁর ধর্ম। তিনি বিশ্বাস করেন “সেবার মধ্যেই শান্তি, উৎসর্গে আত্মার তৃপ্তি”। সর্বোপরি নজির হোসেন জনগণের একান্ত বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধ যার জীবনের গর্ব, সে কখনো শুধু একটা নাম হতে পারে না, তাই নজির হোসেন একটা গৌরবের ইতিহাস ও একটা প্রতিষ্ঠানের নাম।